পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন কাংয়ের পদাঙ্ক অনুসরণ করে চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুন ওয়েইতোংও দায়িত্ব গ্রহণের পর তার প্রথম বিদেশ সফরে বাংলাদেশে আসেন গত শুক্রবার। গত কয়েক মাসের মধ্যে তৃতীয় শীর্ষ কর্মকর্তা হিসেবে তার বাংলাদেশ সফরকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদমাধ্যমে তার সফরের খবর গুরুত্ব দিয়ে প্রচার ও প্রকাশ করেছে।
শনিবার সফরের প্রথম দিনে চীনা উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ ও চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বাদশ কনসালটেশন বৈঠকে অংশ নেন। এতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে দেন পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন। চীনা প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে ছিলেন চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠক শেষে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় একটি সংবাদবিজ্ঞপ্তিতে বৈঠকের গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বলা হয় যে, দশ বছর পর বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পরিচালিত বাংলাদেশের অভাবনীয় উন্নয়ন অর্জন দেখে তিনি খুবই মুগ্ধ।
উভয় প্রতিনিধি দল পারস্পরিক স্বার্থ এবং বহুপাক্ষিক ফোরামে সহযোগিতার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। চীনা পক্ষ এক চীন নীতিতে অব্যাহত সমর্থনের জন্য বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা পুনর্ব্যক্ত করেছে। তারা সাম্প্রতিক উচ্চ-পর্যায়ের রাজনৈতিক বিনিময় ও বৈঠকের কথা স্মরণ করেন যা সহযোগিতার কৌশলগত অংশীদারিত্বকে আরও গভীর করেছে। কোভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় চীনের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ আবারও ধন্যবাদ জানিয়েছে বেইজিংকে।
উভয়পক্ষ বাংলাদেশের বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পের অগ্রগতি পর্যালোচনা করে এবং কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল এবং পদ্মা সেতুর রেল সংযোগের মতো মেগাপ্রকল্পের আসন্ন উদ্বোধনকে স্বাগত জানায়। উভয় পক্ষ বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতে কয়েকটি অতিরিক্ত প্রকল্প প্রস্তাব সংক্রান্ত অনিস্পন্ন বিষয়ের সুরাহা করতে সম্মত হয়েছে।
উভয়পক্ষ ১ সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে কার্যকর হওয়া ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্ক এবং কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা ব্যবহার করে চীনে রপ্তানি বাড়ানোর উপায় নিয়েও আলোচনা করে। চীনা পক্ষ প্রয়োজনীয় পণ্যমান ঠিক রেখে বাংলাদেশ থেকে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা এবং হিমায়িত খাবার আমদানির আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বাংলাদেশ পক্ষ চীনের সাথে বিদ্যমান বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা কমাতে ডিএফকিউএফ কভারেজের মধ্যে শাকসবজি, ওষুধ, কাঁচা চামড়া, জুতা, নন-নিট পোশাক ইত্যাদির মতো অন্যান্য রপ্তানি পণ্য অন্তর্ভুক্ত করার অনুরোধ জানিয়েছে।
চীনা উপমন্ত্রী চট্টগ্রামে চীনা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিনিয়োগে উৎসাহিত করবেন বলে আশ্বাস দেন। তারা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ঢাকা-কুয়াংচৌ সরাসরি ফ্লাইট পুনরায় চালুর আগ্রহের কথা জানিয়ে চীনা বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়ার পরামর্শ দেন। দু’পক্ষ ভিসা সংক্রান্ত সমস্যা, বিশেষ করে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত কনস্যুলার পরামর্শ চালু করতে সম্মত হয়েছে।
বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তি এবং বায়োটেকনোলজিতে উদ্ভাবনের বিষয়ে চীনের সাথে একত্রে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। উভয় পক্ষ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের আওতায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক সংযোগে অবদান রাখতেও আগ্রহ দেখিয়েছে।
উভয়পক্ষ বিদ্যমান প্রতিরক্ষা সহযোগিতায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং নিয়মিত স্টাফ পর্যায়ের আলোচনা এবং বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছে। অনলাইন জুয়া এবং মাদক পাচারের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সক্ষমতা তৈরিতে চীন সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। জননিরাপত্তা ইস্যুতে সংলাপে দু’পক্ষ নীতিগতভাবে সম্মত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড় ও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় আবহাওয়া স্যাটেলাইটের তথ্য শেয়ার করার জন্য বাংলাদেশ চীনকে ধন্যবাদ জানিয়েছে।
রোহিঙ্গা সংকটসহ অন্যান্য বহুপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বিষয় নিয়েও আলোচনা করে দু’পক্ষ। চীনা পক্ষ বাংলাদেশ থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের দ্রুত, নিরাপদ, টেকসই এবং স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে। চীনা উপমন্ত্রী উল্লেখ করেন যে দ্রুত প্রত্যাবাসন বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং সমগ্র অঞ্চলের জন্য কল্যাণকর হবে।
পররাষ্ট্রসচিব চীনকে তাদের সহযোগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে অব্যাহত স্বেচ্ছাসেবী ও টেকসই প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য বাংলাদেশের চলমান প্রচেষ্টার ওপর জোর দেন।
চীন-বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ এ বৈঠকটির ফলাফল নিয়ে প্রথম আলো, ডেইলিস্টার, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, বণিকবার্তাসহ দেশের প্রথমসারির সংবাদপত্র এবং বেতার-টিভি সচিত্র সংবাদ প্রকাশ করেছে। এ সব সংবাদে চীনা উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে ফলপ্রসু ও তাৎপর্যপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়েছে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।