পিতামাতার সাথে না-থাকা বাচ্চাদের যত্নে সহকারী শিক্ষকদের প্রচেষ্টা
2023-05-22 15:00:05

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনা সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে, নগরায়নের কারণে গ্রামাঞ্চলের অনেক শ্রমিক বড় শহর বা জেলায় কাজ করছেন। এর ফলে তাদের অনেকের বাচ্চা গ্রামাঞ্চলেই থেকে যাচ্ছে। গত কয়েক দশক ধরেই এমন প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চীনের গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে অনুন্নত এলাকায় এ প্রবণতা বেশি। পিতামাতা সাথে না-থাকায় এ ধরনের বাচ্চারা বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়ে থাকে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা তাদের দেখাশোনায় গ্রামাঞ্চলের সহকারী শিক্ষকদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা নিয়ে কিছু কথা বলব।

 

২০২২ সালের অগাস্ট মাসে, চীনের গণনিরাপত্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশম মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের দলের সদস্য হিসেবে, লিন লেই ও তাঁর সহপাঠীরা, কুইচৌ প্রদেশের পু’আন জেলায়, সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১০ জন সহকারী শিক্ষককে জেলার তিনটি প্রাথমিক স্কুলে পাঠানো হয়। সহকারী শিক্ষকের মেয়াদ মাত্র এক বছর, তবে শিক্ষক লিন আন্তরিকতা ও পরিশ্রমের সাথে এ দায়িত্ব পালন করতে চান।

 

ছিংশান প্রাথমিক স্কুলে যোগ দেওয়ার পর, শিক্ষক লিন উ ছিং নামের এক মেয়ে সম্পর্কে জানেন। মেয়ে উ ছিং প্রাথমিক স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে পড়াশোনা করে এবং সে ও তাঁর ছোট বোন আলাদাভাবে জীবন কাটায়। তাদের পিতামাতার বিবাহবিচ্ছেদ ঘটেছে আগেই। তাদের নানীও তাদের সাথে থাকেন না। প্রতিদিন বাড়ি থেকে ৭ কিলোমিটার পথ হেঁটে দু’বোন স্কুলে আসে। মাঝে মাঝে তাঁরা আত্মীয়স্বজনদের গাড়িতেও স্কুলে যায়। এমন অবস্থা স্থানীয় গ্রামের পরিবারগুলোতে আকসার দেখা যায়।  একবার মেয়ে উ ছিং এক সপ্তাহের মধ্যে দুই-তিনবার ছুটি নেয় এবং প্রত্যেকবার কারণ হিসেবে অসুস্থতার কথা বলেন। শিক্ষক লিন এতে উদ্বিগ্ন হন। তিনি জেলার দোকান থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও খাবার কিনে মেয়ে উ ছিংয়ের বাড়ি যান।

 

পাহাড়াঞ্চলে রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার; রাস্তার চলাফেরা করা কঠিন। গাড়ি থেকে নেমে খানিকটা পথ হাঁটার পর তিনি অবশেষে মেয়ে উ ছিংয়ের বাড়ি পৌঁছান। শিক্ষক লিনের দৃষ্টিতে মেয়ে উ ছিংয়ের বাড়ির অবস্থা খুবই খারাপ। ধূসর ইটের তৈরি বাড়ির মধ্যে শুধু কয়েকটি প্লাস্টিকের চেয়ার আর একটি ছোট টেলিভিশন রয়েছে। বাড়ির সবকিছুই অগোছালো ও এলোমেলো। প্রথমবারের মতো উ ছিংয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা স্মরণ করে শিক্ষক লিন বলেন, “মেয়েরা আমাকে দেখে খুশি হয়নি। তারা অভিযোগের সুরে বলে, ‘শিক্ষক, আপনার আসার দরকার ছিল না, আমরা একে অপরের দেখভাল করতে জানি।’” শিক্ষক লিনের কাছে তাঁরা যেন হেজহগের মতো, কারও সাথে ঘনিষ্ঠ হতে চায় না।

 

মেয়েদের বাড়ির অবস্থা দেখে শিক্ষক লিনের খুবই দুঃখ হয়। পরের দিন তিনি আবারও অন্যান্য সহকারী শিক্ষকের সাথে জেলার দোকান থেকে গরম পানির পাত্রসহ বিভিন্ন জিনিস কিনে উ ছিংয়ের বাড়িতে যান। তাঁরা তাদের বাড়িঘর পরিষ্কার করেন এবং ঘরের কাজ কিভাবে করা যায়, তা মেয়েদের শিখিয়ে দেন।

 

কয়েক দিন পর আবারও স্কুল থেকে ছুটি নেয় উ ছিং। এবার শিক্ষক লিন আবারও তাদের বাড়ি আসেন। তখন মেয়ে দরজাও খুলতে নারাজ। জিজ্ঞেস করে জানতে পারেন, উ ছিংয়ের বাবা দু’মেয়েকে একটি স্মার্ট ফোন কিনি দিয়েছেন, যাতে তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে পারেন। কিন্তু মেয়ে উ ছিং দ্রুতই মোবাইল ফোনে গেমস খেলায় আসক্ত হয়ে যায়। রাত দুটা পর্যন্তও সে গেমস খেলতে থাকে। ফলে স্কুলে যাওয়ার সময় মিস করে। আর তাঁর ছোট বোন দিন-রাত টেলিভিশন দেখে। সেও প্রায়ই স্কুলে যায় না।

 

শিক্ষক লিন তাদের জন্য প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার ও টেলিভিশন দেখার সময় নির্ধারণ করে দেন এবং তাদের লেখাপড়ার সঠিক পরিকল্পনাও ঠিক করে দেন।

 

মেয়ে উ ছিংয়ের বাড়িঘরের অবস্থা অনেক দুর্বল, বাতাস বা বৃষ্টি থেকে বাঁচা মুশকিল। বাড়িতে বিভিন্ন বিদ্যুতলাইনও এলোমেলো ও বিপজ্জনকভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। পরে ছিংশান প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় তাদের বিদ্যুতলাইন ঠিক করা হয়।

 

শিক্ষক লিনের প্রচেষ্টায় জেলা থেকে বিশেষ ভাতা পেয়েছে উ ছিং। ভাতার টাকা দিয়ে তাদের বাড়িঘরের জন্য নিষ্কাশনব্যবস্থা নির্মাণ করা হয়েছে এবং বাড়িঘর মেরামতও করা হয়েছে। মেয়ে উ ছিংয়ের সাথে পরিচিত হওয়ার পর বহুবার তাদের বাড়িতে গেছেন শিক্ষক লিন। এভাবে টানা দুই সেমিস্টার পার করেন শিক্ষক লিন। ধীরে ধীরে মেয়ে উ ছিংয়ের জীবনযাপনের অবস্থায় ইতিবাচক পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করে। তাঁরা সুশৃঙ্খলভাবে বাড়িতে বিভিন্ন জিনিস রাখা শেখে এবং নির্দিষ্ট স্থানে আবর্জনা ফেলতে শেখে। নতুন টেবিলে সময়মতো হোমওয়ার্ক সম্পন্ন করতেও শুরু করে তাঁরা। শিক্ষক লিনের প্রতি দু’মেয়ের দৃষ্টিভঙ্গিও বদলে যায়। এ সম্পর্কে শিক্ষক লিন বলেন, এ দুটি  মেয়ের মানসিক অবস্থা ভালো নয়। তারা যেন হেজহগের মতো। তবে, তাদের সাথে নরম ও আন্তরিক ব্যবহার করা দরকার। এভাবেই তাদের জীবনপদ্ধতি বদলে দেওয়া সম্ভব।

 

যদিও মেয়ে উ ছিং ও তার ছোট বোন নিজেদের জীবন নিজেরাই যাপন করে, তবে তাদের আর্থিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। কিছু কিছু বাচ্চার জীবনের বোঝা ও চাপ সহকারী শিক্ষকদের জন্য কষ্টের ব্যাপার। কিছু পরিবারের বাচ্চারা একদিনে কেবল একবার খাবার খেতে পারে। কিছু পরিবারে নানা-নানীর শরীর দুর্বল, তাঁরা বাচ্চাদের যত্ন নিতে পারেন না; বাচ্চাদেরই বরং তাদের দেখাশোনা করতে হয়। কোনো কোনো বাচ্চাকে শীতকালেও গ্রীষ্মকালের হালকা কাপড় ও স্কুলের ইউনিফর্ম পরে থাকতে হয়।

 

সহকারী শিক্ষক তৌ ওয়েন থাও নিয়মিত তাঁর ছাত্রছাত্রীদের বাসায় যান। তাঁর ক্লাসের বাচ্চারা কেউ কেউ দৈনিক ১০ কিলোমিটার হেঁটে স্কুলে পৌঁছায়। শুক্রবার বিকেলে স্কুল থেকে ক্লাস শেষ করে শিক্ষক তৌ ছাত্রছাত্রীদের সাথে পাহাড়ের পথ ধরে হেঁটে তাদের বাড়ি যান। একদিন রাতে তিনি স্কুলে ফিরে যাওয়ার সময় পথ হারিয়ে ফেলেন। নভেম্বর মাসে পাহাড়াঞ্চলে রাত কাটানো বেশ কষ্টের ব্যাপার। সেটি তাঁর স্মৃতিতে এখনও জ্বলজ্বল করছে।

 

বাচ্চাদের কাছে যুব-শিক্ষকদের সাথে আড্ডা করা বেশ মজার ব্যাপার। তাই, স্কুলের ক্লাস শেষ করে তারা সবসময় শিক্ষকদের সাথে কথাবার্তা বলতে চায়, গল্প করতে চায়। শিক্ষক লিনের সাথে বেশ সুসম্পর্ক স্থাপন করেছে ছেলেমেয়েরা। শিক্ষক তৌ ভালো গিটার বাজাতে পারেন, তাই স্কুলের ক্লাস শেষ করে ছেলেমেয়েরা সবসময় তাঁর গিটার শুনতে আগ্রহী।

 

চলতি বছরের বসন্তকালে স্কুলে হোস্টেল চালু হয়েছে। তখন থেকে মেয়ে উ ছিং ও তার ছোট বোন হোস্টেলে থাকা শুরু করে। তাদের জীবন এখন আগের চেয়ে সুশৃঙ্খল হয়েছে। আরও ২ মাস পর শিক্ষক লিনের স্কুলের সহকারী শিক্ষকের মেয়াদ শেষ হবে। উ ছিং বলেন, নতুন শিক্ষক আসলে তাকে দুই বোনের যত্ন নিতে অনুরোধ জানাবেন তিনি।

 

বেইজিংয়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে বিভিন্ন পদ্ধতির প্রয়োগ

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিংয়ের বিভিন্ন উচ্চবিদ্যালয় ও কারিগরি স্কুলে বিভিন্ন ধরনের শ্রম প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সঠিক শ্রমচেতনা তৈরির চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীদের দক্ষতাও উন্নত হয়েছে ও হচ্ছে। স্কুলের তৃণভূমির রূপান্তরকাজে অংশগ্রহণ থেকে শুরু করে বাসায় নিজের কাপড়চোপড় গুছিয়ে রাখার মতো অনেককিছুই শিক্ষার্থীরা শিখছেন।

২০২২ সালের নভেম্বর মাসে বেইজিংয়ের শিক্ষা কমিটি বিভিন্ন কারিগরি স্কুলের জন্য ১৫ ধরনের শ্রম ক্লাসের ভিডিও প্রদান করে। এ জন্য শুরুতে বেইজিংয়ের ৫টি কারিগরি স্কুলকে বেছে নেওয়া হয়। এসব স্কুল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য শ্রম-প্রশিক্ষণঘাঁটি হিসেবে কাজ করে থাকে। এভাবে আরও বেশি শিক্ষার্থী শ্রম প্রশিক্ষণের সুযোগ পেতে পারে।

বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের শ্রমের সঠিক চেতনা গঠনের লক্ষ্যে, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বণ্টন বিভাগ থেকে অভিজ্ঞ প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ করে, প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করানো হচ্ছে। এভাবে শ্রম প্রশিক্ষণ ক্লাসের শিক্ষকের চাহিদাও মিটেছে। তাঁরা ভালোভাবে শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী প্রশিক্ষণ দিতে পারছেন।

শ্রম প্রশিক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়নে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি স্কুলে বিভিন্ন প্রয়োজনীয় শ্রম ক্লাসও চালু করা হয়েছে। সাধারণত, প্রতি সেমিস্টারে ৩২টি ক্লাস থাকে। স্কুলের সাধারণ পাঠ্যসূচিতে শ্রম শিক্ষার বিষয় এবং ছাত্রছাত্রীদের ব্যক্তিগত জীবন ও সামাজিক জীবনকে যুক্ত করা হয়েছে। এভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শ্রমের কাজের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে গভীরভাবে বন্টন বিভাগের পরিষেবা ও পেশাদার শিক্ষা কোর্সের সংযুক্তির ফলে হর্টিকালচার কলেজের অনুশীলন ক্লাস চালু হয়েছে। আর তার মাধ্যমে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী এবং বন্টন বিভাগের যৌথ প্রয়াসে ক্যাম্পাসের তৃণভূমি এলাকায় একটি সুন্দর উদ্যান গড়ে তোলা হয়েছে। বেইজিং নর্মোল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হোস্টেলের প্রশাসকের পরামর্শ অনুসারে, কাপড়চোপড় গুছিয়ে নেওয়ার পদ্ধতি শিখেছে এবং নিজেদের বসবাসের জায়গা আরো সুন্দর করেছে।

তা ছাড়া, চীনের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে টানা দুই বছর শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিরা ক্যাম্পাসের হিটিং ব্যবস্থা পরিচালনার দায়িত্ব পালন করছে। প্রতিবছরের শীতকালে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের হিটিং ব্যবস্থা পরিচালনা করে। শিক্ষার্থীদের রান্নাবান্নার দক্ষতা বাড়াতে বেইজিং বনায়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে চীনা ও কানাডীয় স্বাদের খাবার রান্নার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এতে শিক্ষার্থীরা কানাডায় গিয়ে কম সময়ের মধ্যে নিজেদের জন্য রান্না করতে পারবে।

উচ্চবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন কারিগরি স্কুলের শ্রম শিক্ষা চালুর পাশাপাশি, বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলে সংশ্লিষ্ট শ্রম ক্লাস চালুর পরিকল্পনাও কম সময়ের মধ্যে প্রণয়ন করা হবে, যাতে চীনা শিক্ষার্থীরা ছোটবেলা থেকে শ্রমের প্রতি সঠিক ধারণা ও চেতনা গঠন করতে পারে। এতে তারা শ্রমিকদের কাজের প্রতি  আরও বেশি সম্মান দেখানো শিখবে, সমাজ উন্নয়নে যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)