ইতিহাসে, প্রাচীন সিল্ক রোড প্রায় ২ হাজার বছর আগে থেকে পূর্ব ও পশ্চিমকে সংযোগকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোর ছিল। এর নামটি এসেছিল ওই রুটে বহন করা চীনা সিল্কের লাভজনক বাণিজ্য থেকে। ১০ বছর আগে ২০১৩ সালে কাজাখস্তান সফরের সময়, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং চীন ও মধ্যএশিয়ার সহযোগিতা বাড়াতে একটি নতুন সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট গড়ে তোলার প্রস্তাব করেছিলেন।
১০ বছর পর ২০২৩ সালের ১৯ মে চীনের সি’আনে মধ্যএশিয়ার ৫টি দেশের নেতাদের নিয়ে শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট সি’র কি-নোট স্পিসে সঙ্গত কারণেই বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআই গুরুত্ব পেয়েছে। এক দশকে সি’র অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কৌশলগত দিকনির্দেশনা প্রাচীন সিল্ক পথকে অভিন্ন সমৃদ্ধির পথ হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করেছে এবং চীন-মধ্য এশিয়া সহযোগিতার প্রধান অনুঘটক হয়ে উঠেছে এ উদ্যোগ।
গত এক দশকে, চীন এবং মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য শক্তিশালী বৃদ্ধির গতি বজায় রেখেছে। সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যানে দেখায যায়, গত বছর দুই পক্ষের মধ্যে বাণিজ্য ৭০.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশগুলোর বাণিজ্য আগের বছরের তুলনায় ২২ শতাংশ বেড়েছে।
চীন ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কৃষি, সহযোগিতার একটি প্রধান ক্ষেত্র। কাজাখস্তান থেকে উটের দুধ, কিরগিজস্তান থেকে মধু, তাজিকিস্তান থেকে শুকনো ফল, তুর্কমেনিস্তান থেকে তুলা এবং উজবেকিস্তান থেকে চেরিসহ মধ্যএশিয়ার কৃষিপণ্যের একটি বিশাল বৈচিত্র্যময় সম্ভার চীনা বাজারে প্রবেশ করেছে। গত বছর, এ দেশগুলো থেকে চীনের কৃষি, জ্বালানি এবং খনিজ পণ্য আমদানি ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে।
মধ্যএশিয়া চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সরবরাহকারী অঞ্চল। ২০২২ সালে চীন-মধ্য এশিয়া পাইপলাইনের মাধ্যমে চীন তার প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ৩০ শতাংশ পেয়েছে।
সহযোগিতার এ ঐতিহ্যগত ক্ষেত্রগুলি ছাড়াও, চীন এবং মধ্যএশিয়ার দেশগুলি উদ্ভাবন এবং সবুজ উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে বাণিজ্য ও বিনিয়োগে নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার জন্য একসঙ্গে কাজ করছে।
বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভি চীন ও মধ্যএশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ ব্যাপকহারে বাড়িয়েছে। দেশগুলো তাদের শহরগুলোকে সংযুক্ত করার জন্য সরাসরি ফ্লাইট চালু করার পাশাপাশি, বিআরআই কাঠামোর মধ্যে বহু অবকাঠামো প্রকল্পের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করেছে।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে চীন-কিরগিজস্তান-উজবেকিস্তান রেলপথের কিরগিজ বিভাগে সহযোগিতার একটি সমঝোতাস্মারক স্বাক্ষর করে চীন, কিরগিজস্তান এবং উজবেকিস্তান, যা ইউরেশীয় মহাদেশে একটি পরিবহন করিডোর নির্মাণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।
মধ্যএশিয়া হয়ে চীন-ইউরোপ মালবাহী ট্রেন, চীন-কাজাখস্তান হরগোস ইন্টারন্যাশনাল ফ্রন্টিয়ার কো-অপারেশন সেন্টার এবং চীন-কাজাখস্তান ইন্টারন্যাশনাল লজিস্টিক বেস এবং চীনের পূর্বাঞ্চলীয় লিয়ানইউনকাং বন্দরে মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর জন্য বৈশ্বিক বাজারের দরজা খুলে দিতে সাহায্য করেছে।
শীর্ষ সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট সি এ বিষয়টিতে আবা্রও জোর দিয়ে বলেন, বিশ্বের একটি আন্তঃসংযুক্ত মধ্যএশিয়া প্রয়োজন। অনন্য ভৌগোলিক সুবিধা নিয়ে ইউরেশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ কেন্দ্রে পরিণত হওয়ার এবং বিশ্ববাণিজ্যে অনন্য অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে মধ্যএশিয়ার।
বিআরআই উদ্যোগের অধীন প্রকল্পগুলো কেবল ছয়টি দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক কার্যক্রমকে উন্নীত করেনি, বরং সাংস্কৃতিক এবং জনগণের মধ্যে আদান-প্রদানের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষদের আরও কাছাকাছি এনেছে।
কিরগিজ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এবং আলা-তু ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক কুবানিচবেক তাবালদিভ বলেন, প্রাচীন সিল্ক রোডের ধারে মধ্য এশিয়া অবস্থিত এবং এই অঞ্চলের সব দেশই বিভিন্ন উপায়ে বিআরাই-উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেছে। মধ্য এশীয় অঞ্চলের সমস্ত দেশ চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যা সকল পক্ষকে উপকৃত করছে’।
কাজাখস্তান টুডে নিউজ এজেন্সির মহাপরিচালক এবং এডিটর-ইন-চিফ তৈমুর কুভাতভ বলেন, প্রেসিডেন্ট সি’র বিআরআই উদ্যোগ খুবই ফলপ্রসূ হয়েছে। প্রাচীন সিল্করোডের চেতনাকে পুনরুজ্জীবনের মাধ্যমে নতুন বিআরআই উদ্যোগ ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। মাধ্যএশিয়া অঞ্চলে বসবাসকারীসহ বিশ্বের সকল মানুষের জন্য এটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
বিআরই উদ্যোগের উজ্জ্বল সফলতার আলোকে প্রেসিডেন্ট সি শীর্ষ বৈঠকে মধ্যএশিয়াসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে আবা্রও উদাত্ত আহ্বান জানান, ‘আসুন আমরা অভিন্ন উন্নয়ন, অভিন্ন সমৃদ্ধির জন্য একসাথে কাজ করি এবং একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতকে আলিঙ্গন করি’।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।