দেহঘড়ি পর্ব-০১৯
2023-05-21 19:03:43


‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

মুখের ক্ষত চিকিৎসায় টিসিএম

মুখের ক্ষত বা স্টোমাটাইটিস অ্যাপটোসা হলো এক ধরনের ছোট সাদা ঘা, যা মুখগহ্বর ও মাড়ির যে কোনো জায়গায় হতে পারে। কখনও কখনও এটি হলুদাভ হয় এবং চারিদিকে লাল থাকে। এ ঘা আকারে একটি পিন থেকে মসুর ডালের মতো হয়। তবে এটি চিবানো, গেলা ও কথা বলা কষ্টদায়ক করে তোলে। ছোট ঘাগুলো দশ দিনের মধ্যে এমনিতে সেরে যায়, তবে বড়গুলো কয়েক সপ্তাহ সময় নিতে পারে এবং মুখগহ্বরে স্থায়ী দাগ ফেলতে পারে।

পশ্চিমা চিকিৎসায় মুখের ক্ষতের কারণ এখনও অজানা। তাই এর চিকিত্সাও স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত হয়নি। তবে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থায় মনে করা হয়, নানা কারণে মুখের ঘা হতে পারে। এবং একেক কারণে সৃষ্ট ঘায়ের লক্ষণ বা উপসর্গ একেক রকমের। চলুন জেনে নেই এসব কারণ, লক্ষণ ও চিকিৎসা।

একজন টিসিএম চিকিৎসক খুঁজে বের করার চেষ্টা করেন কোনও রোগীর মুখের ঘা হয়েছে হৃৎপিণ্ডের তাপ, পেটের তাপ নাকি কিডনির দুর্বলতার কারণে। পেটের তাপের কারণে যে ঘা হয়, সেটা হয় মূলত মুখের ভিতরে বা মাড়িতে। এ ঘাতে খুব বেশি ব্যথা হয় এবং এর চারপাশটা লাল থাকে। জিহ্বায় হলুদ আবরণও পড়ে এ ঘা হলে।

পাকস্থলী ও প্লীহায় ‘ছি’র ভারসাম্যহীনতার কারণে যখন মুখের ঘা হয়, তখন সেটা হয় মূলত গালের ভিতরে বা নীচের মাড়িতে। এ ঘায়ের প্রান্ত থাকে ফ্যাকাসে। এ ঘায়ের সঙ্গে আরও যেসব লক্ষণ থাকে সেগুলো হলো মুখ ফ্যাকাশে বা শুকনো হওয়া, ঠোঁট ফাটা, মুখে বারবার গরম অনুভূতি হওয়া কিন্তু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ঠান্ডা থাকা, মাঝে মাঝে গলায় ব্যথা হওয়া, বদহজম ও ক্ষুধামন্দা, পা ও হাতের দুর্বলতা ও ক্লান্তি।

বৃহদান্ত্রে তাপের কারণে সৃষ্ট ঘায়ের বৈশিষ্ট হলো এটা হয় মাড়ির উপরের অংশে এবং এতে জিহ্বায় হলুদ আবরণ দেখা দেয়। হৃদপিণ্ডে তাপজনিত ঘা হয় জিভের ডগায়। এর সঙ্গে অন্য যেসব উপসর্গ থাকে সেগুলো হলো দ্রুত হৃদস্পন্দন, অনিদ্রা, অস্থির স্বপ্ন, স্নায়ুবিক দুর্বলতা, মুখে তিক্তভাব এবং তৃষ্ণা বৃদ্ধি।

যকৃতের তাপের কারণে যখন মুখের ঘা হয়, তখন সেগুলো হয় মুখের ভিতরে। এটা লাল রঙের ও খুব বেদনাদায়ক হয়। এর সঙ্গে যে উপসর্গগুলো থাকে সেগুলো হলো মুখ লাল হয়ে যাওয়া, মাথা ঘোরা ও মাথাব্যথা, ঘন ঘন রাগ ওঠা, কোষ্ঠকাঠিন্য, তৃষ্ণা বৃদ্ধি, এবং প্রস্রাব গাঢ় হয়ে যাওয়া।

টিসিএম চিকিৎসকরা উপসর্গের ভিত্তিতে মুখের ঘায়ের ওষুধ বা ভেষজ ফর্মুলেশন প্রেসক্রাইব করেন। তবে সাধারণত যেসব ওষুধ ও ভেষজ সূত্র ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো তা হুয়াং, শাং তি হুয়াং, লিউ ওয়েই তি হুয়াং ওয়ান। ভেষজগুলো খাওয়া যায় আবার গুড়ো করে সরাসরি ঘায়ের ওপর প্রয়োগ করা যেতে পারে।

যারা মুখের আলসারে ভুগছেন তাদের মশলাদার খাবার, কড়া ভাজা খাবার বা অ্যাসিডিক ফল যেমন সাইট্রাস ফল এড়িয়ে চলতে হবে; খাদ্যতালিকায় প্রচুর পরিমাণে সবুজ শাক অন্তর্ভুক্ত করতে হবে; কোষ্ঠকাঠিন্য না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে এবং পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করতে হবে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

নানচিং ড্রাম টাওয়ার হাসপাতাল

নানচিং ড্রাম টাওয়ার হাসপাতাল চীনে পশ্চিমা চিকিৎসার সূচনাকারী প্রথম দিকের হাসপাতালগুলোর একটি। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠার পর গত এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই হাসপাতাল চিকিৎসা, চিকিৎসা শিক্ষা, গবেষণা ও রোগ ব্যবস্থাপনার প্রায় সকল ক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে এবং দ্রুত উন্নয়ন সাধন করেছে। নিয়মতান্ত্রিকতা, শক্তিশালী ফ্যাকাল্টি, অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি এবং শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক গবেষণা সক্ষমতা নিয়ে একটি সর্বোচ্চ স্তরের হাসপাতাল হিসাবে বিকশিত হয়েছে ড্রাম টাওয়ার হাসপাতাল।

চীনের পূর্বাঞ্চলীয় চিয়াংসু প্রদেশের রাজধানী নানচিংয়ে অবস্থিত হাসপাতালটিতে বর্তমানে শয্যা সংখ্যা সাড়ে ৩ হাজার এবং এখানে কর্মীর সংখ্যা ৬ হাজারেরও বেশি, যার মধ্যে রয়েছেন ৯শ জন অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক এবং ৩৯৫ জন মাস্টার্স ও ডক্টরাল পর্যায়ের সুপারভাইজার।

চীনে একটি আধুনিক হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নেওয়া একটি পাইলট প্রকল্পের আওতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ড্রাম টাওয়ার হাসপাতাল। এ প্রকল্পের পিছনে ছিলেন স্থাপত্যবিদ্যায় চীনের খ্যাতিমান পণ্ডিত অধ্যাপক ছি খাং এবং ক্যানাডিয়ান মিশনারি ডাক্তার ম্যাকলিন। ২০২০ সালে চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন দেশটির সর্বোচ্চ পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর কর্মক্ষমতা মূল্যায়নে যে র‌্যাংকিং করে, তাতে এ হাসপাতালটির অবস্থান ছিল জাতীয়ভাবে ১৯তম এবং প্রদেশ-পর্যায়ে প্রথম।

ড্রাম টাওয়ার হাসপাতালে রয়েছে ১০টি জাতীয়-পর্যায়ের মূল বিভাগ, ৩টি প্রাদেশিক-পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল চিকিৎসা কেন্দ্র, ৭টি প্রাদেশিক-পর্যায়ের মূল চিকিৎসা বিভাগ, ৪টি প্রাদেশিক-পর্যায়ের চিকিৎসা উদ্ভাবন দল, ২৯টি প্রাদেশিক-পর্যায়ের বিশেষ ক্লিনিকাল বিভাগ, ১০টি প্রাদেশিক মান নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র এবং ৮টি প্রাদেশিক-পর্যায়ের বিশেষ রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা কেন্দ্র।

ফুদান জেনারেল হাসপাতাল-তৈরি জাতীয় র‌্যাংকিংয়ে ড্রাম টাওয়ার হাসপাতালের রিউমাটোলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের অবস্থান চতুর্থ এবং প্রজনন ওষুধ বিভাগের অবস্থা ষষ্ঠ। এর অনকোলজি, এন্ডোক্রিনোলজি, প্লাস্টিক সার্জারি, অর্থোপেডিকস, অ্যানেস্থেসিওলজি, নিউরোলজি, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি ও ফার্মেসি জাতীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত।

 

#ভেষজের গুণ

চাইনিজ ইয়াম

চাইনিজ ইয়াম একটি লতাজাতীয় গাছ, যা এশিয়া ও উত্তর আমেরিকায় জন্মে। চীনা ভাষায় একে বলা হয় শান ইয়াও। চাইনিজ ইয়াম প্রধানত পেট ও প্লীহার পীড়া সারাতে ব্যবহৃত হয়। তবে ফুসফুস, কিডনি সমস্যা, ক্ষুধামন্দা, দীর্ঘস্থায়ী ডায়রিয়া, হাঁপানি, শুকনো কাশি, ঘনঘন মূত্রবেগ ও ডায়াবেটিসের চিকিৎসায়ও এটি সাহায্য করে। চাইনিজ ইয়ামের শিকড়ই মূলত খাদ্য হিসাবে খাওয়া হয়, যদিও এর বাল্ব খাওয়া যায়। এর শিকড়ে ডায়োসজেনিন থাকে, যা ল্যাবে ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরনের মতো স্টেরয়েড তৈরিতে ব্যবহার করা হয়।

চাইনিজ ইয়ামে থাকে অ্যালানটোইন। এটি একটি প্রাকৃতিক যৌগ যা সুস্থ টিস্যু বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং রোগ নিরাময়ের সময় কমায়। ত্বকের ক্ষত ও ফোঁড়া সারাতেও এটা প্রয়োগ করা যায়। এর পাতার রস বিচ্ছু ও সাপের বিষের প্রভাব কমায়।

চাইনিজ ইয়ামের শিকড়ে পাওয়া যায় ডায়োসজেনিন। এটি একটি প্রাকৃতিক উদ্ভিদ-ভিত্তিক ইস্ট্রোজেন।

ইঁদুরের পেট ও অন্ত্রের কার্যকারিতার উপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, চাইনিজ ইয়ামের নির্যাস কেবল হজমে সাহায্য করে না, পেটের কিছু অন্ত্রের ফ্লোরাকে সহায়ক ব্যাকটেরিয়াতে পরিণত হতে সাহায্য করে এ ভেষজ।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, চাইনিজ ইয়ামের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যও রয়েছে। এছাড়া এতে শরীরে প্রয়োজনীয় জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, আয়রন, কপার ও সেলেনিয়াম থাকে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।