প্রবীণদের সেবায় ঝুঁকছেন চীনা তরুণেরা
2023-05-17 17:25:52


 

চীনে অতীতে প্রবীণদের সেবায় নিয়োজিত ছিলেন প্রধানত মধ্যবয়সী ও অশিক্ষিতরা, কারণ এ কাজে আয় অনেক কম ছিল। তবে, এখন অবস্থা বদলে গেছে। এখন আরও বেশি তরুণ, যারা গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে কিংবা একবিংশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করেছেন, এ সেবায় যোগ দিচ্ছেন। তাই তরুণরা প্রবীণদের সেবা করছেন এমন দৃশ্য খুব স্বাভাবিক। উদ্যমী ও ভাল শিক্ষিত তরুণেরা এ ক্ষেত্রে আরও বেশি এগিয়ে আসছেন।

 

ইয়ান ইয়াং চুন ছি বয়স্কদের গোসল করতে সাহায্য করেন।  এ পর্যন্ত তিনি ২০০ বারের মতো প্রবীণদেরকে গোসল করিয়েছেন। তার কাজ আসলে সহজ নয়। প্রতিবার প্রবীণদেরকে সেবা দেয়ার আগে তাকে প্রবীণদের সব তথ্য জানতে হয়। যেমন: প্রবীণদের চিকিৎসা ইতিহাস, ত্বকের অবস্থা, রক্তে শর্করা কেমন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করার ক্ষমতা আছে কিনা ইত্যাদি। প্রবীণদের অবস্থা অনুযায়ী, আগে থেকে প্রস্তুতি নেন তিনি। পাশাপাশি, প্রবীণদের পরিবারকে তাদের কাজের কিছু ভিডিও পাঠান। কখনও কখনও অক্ষম প্রবীণদেরকে গোসল করাতে তিনজন লাগে। একজন গোসল করান, একজন পানি পরিবর্তন করেন এবং একজন প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলেন ও তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন। পুরো প্রক্রিয়া ১ ঘণ্টা লাগে।

 

ইয়ান ইয়াং চুন ছি বলেছেন, এ কাজ করতে পেশাদারিত্ব প্রয়োজন। পাশাপাশি শারীরিক শক্তিও অপরিহার্য। ক্লান্ত হলেও প্রবীণদের আনন্দ দেখে আমি খুব সন্তুষ্ট হয়।

 

শৈশবের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে ইয়ান ইয়াং চুন ছি এ কাজ বেছে নেন। ছোট বেলা থেকে মাধ্যমিক স্কুলে পড়া পর্যন্ত তিনি তার নানা-নানীর সঙ্গে বাস করেছেন। তখন তাদের বয়স ছিল ৭০-এর ঘরে। তারা খুব কম গোসল করতেন। কারণ বাথরুম পিচ্ছিল এবং অন্ধকার ছিল। তারা গোসল করতে চাইলেও পারতেন না। পরে তিনি জানতে পেরেছেন, অনেক প্রবীণ তার নানা-নানীর মতো দুর্দশার শিকার। তাই তিনি এ কাজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

 

সাতাশ বছর বয়সী ওয়াং চেং শাংহাই শহরে ৫ বছর ধরে কাজ করে আসছেন। তিনি শাংহাই শহরের প্রথম ২১ জন সিনিয়র নার্সিং টেকনিশিয়ানের অন্যতম। চলতি বছর তিনি শাংহাই শহরের ‘শ্রমিক পদক’ পেয়েছেন। হাই স্কুল থেকে স্নাতক হবার পর তিনি স্বেচ্ছায় বয়স্কদের সেবা এবং ব্যবস্থাপনা পেশা বেছে নিয়েছেন। তার মতে চীনে প্রবীণদের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে এবং তাদেরকে সেবা প্রদানকারীর সংখ্যা অপ্রতুল। এ শিল্পে আরও বেশি তরুণদের প্রয়োজন। ওয়াং চেং বলেন, গত ৫ বছরে তার কোম্পানিতে ৩০ জন যুব কর্মী যোগ দিয়েছেন।

 

সম্প্রতি চীনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচালিত একটি জরিপে অংশগ্রহণকারী ৪০ হাজার মানুষের ৬০ শতাংশ মনে করেন, বয়স্কদের সেবা খাতের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল এবং অনেকে এতে যোগ দিতে চায়।

 

যৌবন এবং বার্ধক্য হলো জীবনের দুটি পর্যায়। বয়স্কদের সেবায় জড়িত যুবকরা এ খাতের প্রাণশক্তি। হ্য নান প্রদেশের একটি নার্সিং হোমে খুলা হয়েছে একটি কম্পিউটার গেম রুম। এখানকার যুবক কর্মীদের সাহায্যে প্রবীণরা তিন দিনের মধ্যে কম্পিউটার গেম খেলতে পারেন। ছাব্বিশ বছর বয়সী ফান চিন লিন নার্সিং হোমের দায়িত্বশীল ব্যক্তি। প্রবীণদেরকে কম্পিউটার গেম খেলতা শিখানোর ধারণাটি তার মাথা থেকেই এসেছে। তিনি ও তার দল প্রবীণদের খাওয়া-পরার সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি তাদেরকে নিজের জগতে নিয়ে আসেন।

 

ফান চিন লিন বলেন, ‘আমি প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বেশ গুরুত্ব দিই। আশা করি, তাঁরা এখানে আনন্দে বাস করতে পারেন। ফান চিন লিন প্রবীণদেরকে নিয়ে ছোট ভিডিও বানান, গেম খেলেন, কম্পিউটার গেম তৈরি করেন। তার তৈরি ভিডিও অনলাইনে ৩০ লাখের বেশি অনুরাগীকে আকর্ষণ করেছে। প্রাণবন্ত  প্রবীণের দেখে নার্সিং হোম সম্পর্কে অনেকের ধারণাও বদলে গেছে।

 

বয়স্কদের সেবা ভালভাবে করার জন্য ফান চিন লিন নানা স্বীকৃতি ও প্রশংসা কুড়িয়েছেন। যেমন: নার্সিং, সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার, ফায়ার ফ্যাসিলিটি অপারেটর ইত্যাদি। তাঁর নার্সিং হোমে নার্স, ডায়েটিশিয়ান, সাইকোলজিক্যাল কাউন্সিলর এবং মেডিক্যাল স্টাফরা মিলে প্রবীণদের জন্য উপযোগী গেম বা অনুষ্ঠান তৈরি করেন এবং তাঁদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যক্তিগত যত্নের পরিকল্পনা তৈরি করেন।

 

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ চীনে ৬৫ বা তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ২১ কোটি। অনুমান অনুযায়ী, ২০৩৫ সালে  ৬০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ৪০ কোটি ছাড়িয়ে যাবে। তখন চীনের মোট লোকসংখ্যায় প্রবীণদের অনুপাত ৩০ শতাংশ দাঁড়াবে। চাহিদার তুলনায় এ খাতে কর্মীর সংখ্যা এখনও যথেষ্ট নয়।

 

আরও বেশি মানুষকে এ খাতে যোগ দিতে উত্সাহ যোগাতে নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সরকার। যেমন: ২০২০ সাল থেকে চেং তু শহরে টানা ৩ বছরের মতো প্রবীণদের যত্ন প্রতিযোগিতা  আয়োজিত হয়েছে।  এ প্রতিযোগিতায় যারা প্রথম হয়েছেন, তাদেরকে গৌরবময় খেতাব দেয়া হয়। প্রথম, দ্বিতীয়, ও তৃতীয় স্থানের মানুষকে স্বর্ণ, রৌপ্য এবং ব্রোঞ্জ পদক দেয়া হবে। শহর, প্রদেশ ও জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় যারা পদক পান, তাদেরকে বোনাস দেয়া হয়। পাশাপাশি, যারা এ খাতে তিন বছরের মতো কাজ করেছেন, তাদেরকে বিশেষ বেতন দেয়া হয়।

 

আয় বৃদ্ধি, নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং কাজের প্রযুক্তিগত উন্নতি বয়স্কদের সেবা খাতে আরও বেশি যুবককে আকর্ষণ করবে বলে বিশ্বাস করা হয়। (শিশির/এনাম/রুবি)