চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিশন কার্যালয়ের পরিচালক ওয়াং ই গত বুধবার অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভানের সঙ্গে দেখা করেন। তাদের আলোচনা ছিল অকপট, গভীর, সারগর্ভ, গঠনমূলক এবং সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দু’পক্ষের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের মতবিনিময়।
এ বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র, চীনের একটি আবহাওয়া বেলুন গুলি করে নামানোর পর থেকে কার্যত বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্ক অধিকতর শীতল একটা পর্যায়ে প্রবেশ করে।
ভিয়েনা বৈঠকের আগে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এবং ট্রেজারি সেক্রেটারি জ্যানেট ইয়েলেনের মতো জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তারা হয় চীন সফর করার বা বেইজিংয়ের সাথে যোগাযোগের লাইন খোলা রাখার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিছু মিডিয়া রিপোর্ট অনুসারে, ওয়াশিংটন অভিযোগ করেছে যে তাদের যোগাযোগের ইচ্ছার প্রতি চীন শীতল প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে।
তবে প্রকৃত বিষয় হচ্ছে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যোগাযোগ বজায় রেখেছে। সুলিভানের সাথে ওয়াং ইয়ের বৈঠক ছাড়াও, চীনের স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন কাং এবং বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েনতাও সম্প্রতি মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকোলাস বার্নসের সাথে বেইজিংয়ে সাক্ষাৎ করেছেন।
তবে বেইজিং মনে করে, শুধু কথা বলার খাতিরে ওয়াশিংটনের সঙ্গে কথা বলা সম্পর্কোন্নয়নে খুব একটা কাজে আসবে না। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সম্পূর্ণ আন্তরিকতা প্রদর্শন ও প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে।
কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, চীনের মূল স্বার্থ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বৈত আচরণ পারস্পরিক আস্থা নষ্ট করছে।
উদাহরণ হিসেবে তাইওয়ানের প্রসঙ্গটি তোলা যায়। এটি চীনের মূল স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে প্রথম রেডলাইন যা কোনোভাবে অতিক্রম করা ওয়াশিংটনের সমীচীন নয়। যদিও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং তার প্রশাসনের অনেক সিনিয়র কর্মকর্তা প্রকাশ্যে এক-চীন নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকার এবং ‘তাইওয়ানের স্বাধীনতা’ সমর্থন না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
তবে ওয়াশিংটন তাইওয়ান প্রণালী জুড়ে উত্তেজনা সৃষ্টির দিকে ঝুঁকছে, অন্তত এ অঞ্চলে যুদ্ধজাহাজ এবং ফাইটার জেট পাঠিয়েছে, চীনা দ্বীপে অস্ত্র বিক্রি বাড়িয়েছে এবং অতি সম্প্রতি, তাইওয়ান নেতা সাইয়ের তথাকথিত ‘ট্রানজিট’ ভিজিটের ব্যবস্থা করেছে। এতে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তি মার খাচ্ছে এবং অঞ্চলটিকে একটি বিপজ্জনক ফ্ল্যাশপয়েন্টে পরিণত করছে।
ওয়াশিংটন কীভাবে চীনের উত্থানের সাথে মোকাবিলা করে তাও তার দ্বিমুখী চালচলনের প্রমাণ দেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একদিকে দাবি করে যে তারা চীন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে না এবং চীনের উন্নয়নে বাধা দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই, অন্যদিকে চীনের সঙ্গে তার প্রযুক্তিগত সম্পর্ক ছিন্ন করেছে, চীনা সংস্থাগুলোর ওপর বহু দফা চিপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অকাস ও কোয়াডের মতো জোট গঠন করে এশিয়া-প্যাসিফিকে চীনকে ঘেরাও করতে চাইছে এবং আঞ্চলিক দেশগুলোকে পক্ষ নিতে বাধ্য করছে।
ওয়াশিংটনের দ্বৈততা মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের মধ্যে চীনের উত্থান নিয়ে বাড়তে থাকা উদ্বেগ থেকে উদ্ভূত হয়েছে। আত্মকেন্দ্রিক বিভ্রান্তিতে পুড়তে থাকা ওই কর্মকর্তারা একগুঁয়েভাবে বিশ্বাস করে যে আমেরিকাকে এগিয়ে রাখতে চীনকে নামিয়ে আনতে হবে। তারা একে ‘প্রতিযোগিতা’ বলে।
অতি=-আন্তনির্ভরতার এ যুগে, একটি স্থিতিশীল চীন-মার্কিন সম্পর্ক মহামারি ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে বিশ্বের সম্মিলিত লড়াইয়ের চেয়েও বেশি অপরিহার্য।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং গত বছরের শেষ দিকে ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে তাদের বৈঠকে বাইডেনকে বলেছিলেন যে সম্পর্কগুলো একটি শূন্য-সমষ্টির খেলা হওয়া উচিত নয় যেখানে এক পক্ষ অন্য পক্ষের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বা উন্নতি লাভ করে। সি দুই দেশকে ইতিহাস, বিশ্ব এবং জনগণের জন্য দায়িত্ববোধ, নতুন যুগে একে অপরের সাথে থাকার সঠিক উপায় অন্বেষণ এবং সম্পর্ককে সঠিক পথে আনার আহ্বান জানান।
বেইজিং, বরাবরের মতো, ওয়াশিংটনের সাথে বিনিময়কে স্বাগত জানায় এবং বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হিসাবে বিস্তৃতভাবে স্বীকৃত চীন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ভেঙে দেওয়ার কোন ইচ্ছা নেই।
কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি ভ্রান্ত নীতি অনুসরণ করে উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে তাহলে কোনোভাবেই বেইজিং-ওয়াশিংটন সম্পর্কের ক্রমাবনতি ঠেকানো যাবে না।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।