দেহঘড়ি পর্ব-০১৮
2023-05-14 16:37:01

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

কিডনির স্বাস্থ্য রক্ষায় টিসিএম

ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে কিডনি ও এর সঙ্গে যুক্ত অঙ্গগুলোকে শরীরের শক্তির উৎস বা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শক্তি ব্যবস্থা হিসাবে বিবেচনা করা হয়। পাশ্চাত্য ও চীনা ওষুধ উভয় চিকিৎসা ব্যবস্থাতেই শরীরে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখা এবং প্রস্রাবের মাধ্যমে বর্জ্য নির্গমনে কিডনির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাকে স্বীকার করা হয়। কিডনি শরীরের অন্যান্য তরল যেমন অশ্রু, লালা, ঘাম, অস্থিসন্ধির তরল ইত্যাদিও নিয়ন্ত্রণ করে।

টিসিএমে মনে করা হয়, দেহের অন্যান্য অঙ্গের মতো কিডনিতেও মূল শক্তি বা ‘ছি’ এবং তার দুটি উপাদান ‘ইয়িন’ ও ‘ইয়াং’ বিদ্যমান। ইয়িন হলো ঠান্ডা শক্তি আর ইয়াং তাপ শক্তি। এই দুটি শক্তি বিপরীতধর্মী আবার একে অন্যের পরিপূরক। যে কোনও অঙ্গের স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ‘ইয়িন’ ও ‘ইয়াং’য়ের ভারসাম্য দরকার। এদের মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হলে অঙ্গের কর্মক্ষমতা কমে যায়।

কিডনিতে যদি ইয়াংয়ের ঘাটতি হয়, তবে ইয়িনের প্রভাব বেড়ে যায়। এর ফলে শরীরে মূত্রসহ অন্যান্য তরলে ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়, যার কারণে শরীরে ক্লান্তি আসে এবং যৌনক্ষমতা কমে যায়। অন্যদিকে, কিডনিতে ইয়িনের ঘাটতি দেখা দিলে, ইয়াং অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে। এ ক্ষেত্রেও প্রস্রাবে ভারসাম্য নষ্ট হয়, যার ফলে জীবনীশক্তি কমে যায় এবং মাথা ঘোরা দেখা দেয়।

কিডনির স্বাস্থ্যের জন্য চীনা ওষুধ

‘ফিউশন কিডনি টনিক’ হলো একটি প্রাচীন চীনা ভেষজ ফর্মুলেশনের আধুনিক রূপ। এই ফর্মুলেশনের আদি নাম ছয়-উপাদানের ‘রেহমাননিয়া পিল’, যা ৯ শ বছর আগে আবিস্কৃত হয়েছিল। টিসিএমে কিডনি কেবল শরীরের তরল নিয়ন্ত্রণ করে না; তার চেয়ে বেশি কিছু করে। এছাড়া কিডনি ইয়িন ও ইয়াং শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখে এবং ‘জিং’ নামে পরিচিত জীবনী শক্তি সঞ্চয় করে, যা আসলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে হ্রাস পেতে থাকে। ফিউশন কিডনি টনিকের মূল উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে:

গোজি বেরি: গোজি বেরি কিডনিকে শক্তিশালী করতে, ইয়িন ও ইয়াংয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে এবং ‘জিং’কে শক্তিশালী করতে এবং কিডনি ইয়াংয়ের ঘাটতিজনিত ক্লান্তি দূর করতে অসাধারণ কাজ করে। কিডনিতে ইয়িনের ঘাটতি থাকলে, সেক্ষত্রে গোজি বেরি জীবনীশক্তি যোগায় এবং হালকা মাথা ঘোরা থেকে মুক্তি দেয়। এ ফলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্যও রয়েছে।

রেহমানিয়া: কিডনিতে ইয়িনের ঘাটতি দেখা দিলে শরীরের তরল নিয়ন্ত্রণ করতে এবং প্রস্রাবের স্বাভাবিকতা বজায় রাখতে রেহমাননিয়া ভাল কাজ করে। এ ভেষজকে ইয়িন ঘাটতি মেটানোর টনিক হিসাবে নেওয়া হয়। এছাড়া একে রক্তের টনিক হিসাবেও গ্রহণ করা হয়, যার ফলে অনিদ্রা ও মাসিকের অনিয়ম থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

ব্যারেনওয়োর্ট (Barrenwort): 

কিডনির ইয়াং ঘাটতি দূর করা মাধ্যমে শরীরে তরলের ভারসাম্যহী বজায় রাখতে, প্রস্রাবের স্বাভাবিকতা ধরে রাখতে এবং স্বাস্থ্যকর যৌনক্ষমতা অটুট রাখতে টনিক হিসাবে ব্যবহার করা হয় ব্যারেনওয়োর্ট ভেষজ। ইয়াংকে পুষ্ট করার মাধ্যমে হাড়ের শক্তি বাড়ানো এবং অস্থিসন্ধির ব্যথা উপশমের জন্যও টিসিএমে এ ভেষজ ব্যবহার করা হয়।

কিডনির প্রাকৃতিক সুরক্ষা

কতগুলো প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চললে কিডনি সুস্থ থাকে।

·         কিডনি ও মূত্রাশয় ঠান্ডার প্রতি সংবেদনশীল। তাই ঠান্ডা আবহাওয়ায় উষ্ণ কাপড় পরুন এবং পিঠের নীচের অংশ যাতে ঠান্ডা হয়ে না যায়, সেজন্য বিশেষ যত্ন নিন।

·         যখন প্রয়োজন হয়, পিঠের নিচের অংশে গরম পানির বোতল বা হিট প্যাক লাগিয়ে কিডনি ও এর সঙ্গে সংযুক্ত অংগুলোকে উষ্ণ রাখুন। প্রচুর পানি পান করে হাইড্রেটেড থাকুন। তবে অ্যালকোহল, কোমল পানীয় ও কফি বেশি গ্রহণ করবেন না।

·         কিডনি ও এর সঙ্গে যুক্ত অঙ্গগুলোর সুস্থতা রঙের সঙ্গেও সম্পৃক্ত টিসিএমে মনে করা হয়। বিশ্বাস করা হয়, নীল ও কালো খাবারগুলো কিডনিকে শক্তিশালী ও পুষ্ট করে। তাই আপনার খাদ্যতালিকায় বেগুন, কালো তিল, কালো মটরশুটি, কাঠে জন্ম নেওয়া মাশরুম, বরই ও সামুদ্রিক শৈবাল অন্তর্ভুক্ত করুন।

·         সুস্থ ব্যক্তির জন্য টিসিএম সামান্য লবণকে উপকারী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে খেয়াল রাখুন পরিমাণ যাতে বেশি না হয়।

·         কিডনির জন্য পুষ্টিকর হিসাবে বিবেচিত অন্যান্য খাবারের মধ্যে রয়েছে আখরোট, ডুমুর, কিশমিশ, বাদামী চাল, গোটা শস্য ও হৃৎপিণ্ডের স্যুপ।

#চিকিৎসার_খোঁজ

থিয়ানচিন চক্ষু হাসপাতাল

থিয়ানচিন চক্ষু হাসপাতাল চীনের শীর্ষস্থানীয় চক্ষু হাসপাতালগুলোর অন্যতম। হুয়াইয়াং অন্ধত্ব প্রতিরোধ সমিতির কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ১৯২৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ হাসপাতালটি এখন একটি জাতীয় থ্রি-এ স্তরের হাসপাতাল, যেটি সরাসরি থিয়ানচিন স্বাস্থ্য ব্যুরোর সঙ্গে যুক্ত। হাসপাতালটির নতুন নামকরণ করা হয়েছে নানখাই বিশ্ববিদ্যালয় চক্ষু হাসপাতাল হিসাবে। এটি থিয়ানচিন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল কলেজও। এছাড়া এ হাসপাতালটি চক্ষুবিদ্যা ও ভিজ্যুয়াল সায়েন্স বিষয়ে থিয়ানচিনের গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগার এবং থিয়ানচিন আই ব্যাংক হিসাবে কাজ করে এবং এখানে অবস্থিত থিয়ানচিন অন্ধত্ব প্রতিরোধ কার্যালয়।

হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, এ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত ৪০৬ জন কর্মী, যাদের মধ্যে ১২২ জন ডাক্তার, ১০৯ জন নার্স এবং ৬২ জন মেডিকেল টেকনিশিয়ান। ৪০ হাজার বর্গ মিটারেরও বেশি ফ্লোরস্পেসের ওপর নির্মিত ২৪০-শয্যাবিশিষ্ট এ হাসপাতালে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় এবং বছরে এখান থেকে চিকিৎসা পান ১০ লাখের মতো রোগী। এর মধ্যে ৩০ হাজার রোগীকে শল্যচিকিৎসা দেওয়া হয়।

স্ট্র্যাবিসমাস ও শিশু চক্ষুরোগ, ছানি, দৃষ্টিত্রুটি, ভিট্রিয়াস ও রেটিনার রোগ, গ্লুকোমা, দৃষ্টি-সংক্রান্ত রোগ এবং অকুলারপ্লাস্টি, কর্নিয়ার রোগ ইত্যাদির চিকিৎসার ক্ষেত্রে হাসপাতালটির খ্যাতি চীনেই সীমাবদ্ধ নয়; ছড়িয়ে পড়েছে বাইরের দেশগুলোতেও।

স্ট্র্যাবিসমাস ও শিশু চক্ষুবিজ্ঞান কেন্দ্র

থিয়ানচিন চক্ষু হাসপাতালের স্ট্র্যাবিসমাস ও পেডিয়াট্রিক কেন্দ্রটি ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠার পেছনের মূল কারিগর ছিলেন বিখ্যাত অধ্যাপক হে ইয়ুশি, যার লেখা ‘স্ট্র্যাবিসমাস’ নামের বইটি স্ট্র্যাবিসমাস সম্পর্কে প্রাচীনতম মনোগ্রাফ এবং এখনকার চিকিৎসকদের জন্য একটি ধ্রুপদী রেফারেন্স। বিগত ৬০ বছরে এ কেন্দ্রে অসংখ্য ক্লিনিকাল গবেষণা পরিচালিত হয়েছে, বহু জটিল চক্ষুরোগের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এবং অগনিত চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এ কেন্দ্রে কর্মরত আছেন চীনের স্ট্র্যাবিসমাস ও শিশু চক্ষুবিজ্ঞান সমিতির সভাপতি এবং চীনের চক্ষুবিজ্ঞান সমিতির প্রাক্তন চেয়ারম্যান অধ্যাপক চাও খানসিংয়ের মতো বেশ কিছু বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ। স্ট্র্যাবিসমাস ও শিশু চক্ষুবিজ্ঞান কেন্দ্রে বছর ৪ হাজারেরও বেশি স্ট্র্যাবিসমাস সার্জারি করা হয়। এ কেন্দ্রের রোগীদের মধ্যে ৬৫-৭০ শতাংশ স্থানীয় নন; তারা তাইওয়ানসহ চীনের অন্যান্য অঞ্চল এবং বাইরের দেশ থেকে আসেন।

#ভেষজের গুণ

চীনা খেজুরের বীজ

জুজুবি বরই-জাতীয় একটি ফল, যদিও এটি লাল খেজুর বা চীনা খেজুর নামেও পরিচিত। এই ফলের বীজ অন্তত ৩ হাজার বছর ধরে অনিদ্রার প্রতিকার হিসাবে ওষুধে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আধুনিক বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে যে, এই ভেষজটি একটি প্রাকৃতিক নিরাময়কারী হিসাবে কাজ করে। যখন আপনার মন ও শরীর বা উভয়ই নিজে নিজে স্থির হতে পারে না, তখন আপনাকে বিশ্রাম নিতে সাহায্য করে জুজুবি বীজ।

আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণা দেখা গেছে, এই ফলটি স্যাপোনিন নামক যৌগে সমৃদ্ধ, যা স্নায়ুতন্ত্রের উপর প্রশান্তিদায়ক প্রভাব ফেলে এবং শরীরকে শিথিল করতে সাহায্য করে। এর ফলে ঘুম চলে আসে। ঘুমের জন্য যেসব ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধ বা টিসিএম ব্যবহার করা হয়, তার একটি অন্যতম উপাদান জুজুবি বরইয়ের বীজ।

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।