সকাল ৮টায় স্টার্টিং বন্দুকের শব্দ শুনে লুও সু চিয়ান স্ট্রোলার ঠেলে হাজার হাজার মানুষের সঙ্গে দৌড় শুরু করেন। স্ট্রোলারে বসে থাকে তার ১৪ বছর বয়সী ছেলে সিয়াও পেই। এক ঘণ্টা ৪৩ মিনিট পর বাবা ও ছেলে ২১ কিলোমিটার পথের যাত্রা শেষ করেছেন। এটা তাদের ৫৮তম ম্যারাথন এবং তাদের একসাথে দৌড়ানোর অষ্টম বছর। একজন অসহায় বাবা ও একজন মৃগী রোগে আক্রান্ত ছেলে ম্যারাথনে কিছুক্ষণের জন্য হলেও স্বাধীনতা উপভোগ করেন।
২০১০ সালে ছেলেকে নিয়ে ম্যারাথনে অংশগ্রহণের চিন্তা শুরু করেন লুও সু চিয়ান। তিনি মার্কিন একটি তথ্যচিত্র দেখেছেন। সেখানে ডিক হোইট নামে একজন বাবা তার মৃগী রোগে আক্রান্ত ছেলেকে নিয়ে এক হাজার বার ম্যারাথনে ও ট্রায়াথলনে অংশগ্রহণ করেছেন। আগে বিশ্বের সবচেয়ে পুরাতন ম্যারাথন বোস্টন ম্যারাথনে একজন অন্য একজনকে ঠেলে দৌড়ানো নিষিদ্ধ ছিল। তবে, হোইট এ নিয়ম ভেঙে দিয়েছেন এবং ছেলেকে নিয়ে ৩২ বছরের মতো দৌড়েছেন।
২০১৫ সালে লুও প্রথম ছেলেকে নিয়ে ম্যারাথনে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ওই সময় মৃগী রোগে আক্রান্ত ছেলের অবস্থা দিন দিন খারাপ হয়। ছেলে এবং নিজেকে উদ্ধার করতে কিছু করতে চান লুও। ২০১৫ সালের মে মাস থেকে তিনি ম্যারাথনের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। প্রতিদিন সাড়ে চারটায় তিনি জেগে উঠেন এবং ৫টায় পাহাড়ে দৌড়ানো শুরু করেন। দিনের কাজ শেষ করে তিনি বাসায় সাইকেল মেশিন দিয়ে প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখেন। ছেলে ঘুমানোর পর তিনি কোর প্রশিক্ষণ শুরু করেন। গ্রীষ্মকালে সাঁতার কাটেন। শুরুতে তিনি মাত্র ৩-৪ কিলোমিটার দৌড়াতে পারতেন এবং পরে তিনি ১৩-২০ কিলোমিটার দৌড়াতে শিখেন।
২০১৫ সালের ১১ নভেম্বর তিনি প্রথমবারের মতো ছেলেকে নিয়ে তিনি মিনি ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করেন। ওই দিন বৃষ্টি ছিল। তাই সাত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে তাদের দেড় ঘণ্টা লেগেছিল। ছয় বছর বয়সী সিয়াও পাই বৃষ্টিতে হৈচৈ করে এবং হাত তালি দেয়। ছেলের আনন্দ দেখে লুও এটি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি নিয়মিত প্রশিক্ষণ শুরু করেন এবং মিনি ম্যারাথন থেকে অর্ধেক ম্যারাথন ও পুরো ম্যারাথনের দিকে তিনি ও তার ছেলে ধাপে ধাপে এগিয়ে যান। ভালভাবে দিক নিয়ন্ত্রণ করতে লুও স্ট্রোলারকে রূপান্তর এবং ছেলের জন্য সিট বেল্ট তৈরি করেছেন। স্ট্রোলারের সামনে একটি লাল পতাকা লাগানো হয়। বাতাসে পতাকা উড়তে দেখলে খুশি হয় সিয়াও পাই।
তার স্ত্রী ও মেয়ে সমাপ্তি পয়েন্টে লুও ও ছেলের জন্য অপেক্ষা করে। ম্যারাথনে অংশগ্রহণ করতে তার পরিবার সারা চীনে ঘুরে বেড়িয়েছে।
সাধারণ ছেলেদের তুলনায় সিয়াও পাই খুব ছোট। চৌদ্দ বছর বয়সী হলেও তার ওজন মাত্র ১৫ কেজির একটু বেশি। তাই স্ট্রোলারে বসতে হয় তাকে।
জন্মের ৮১৮ দিন পর সিয়াও পাই প্রথমবারের মতো হাঁটে। তবে, অনেক পরে সে মৃগী রোগে আক্রান্ত হয়েছে। তার মানে তার জন্য কোন পুনর্বাসন প্রশিক্ষণ হতে পারে না এবং সে আর বড় হবে না। তার বুদ্ধি ১০ মাসের বাচ্চার সমান এবং তাকে সারা জীবন পরিবারের যত্নে থাকতে হবে।
পরিবারের জন্য লুও দৌড়ান। ছেলের চিকিৎসায় প্রতিবছর ৩০ হাজার ইউয়ান লাগে। মেয়ের লেখাপড়ার জন্যও টাকা প্রয়োজন। লুও এবং তার স্ত্রী উপার্জন করতে কাজ করেন। ছেচল্লিশ বছর বয়সী লুও ছোট একটি জেলায় ডেলিভারি কর্মী হিসেবে কাজ করেন। প্রতিদিন সকাল ৭টায় তিনি ছোট ভ্যান চালিয়ে ১৫ কিলোমিটার দূরের গুদাম থেকে প্যাকেজ নিয়ে আসেন এবং পরে শিল্প পার্কে এসব প্যাকেজ বিতরণ করেন। পঞ্চাশটি ভবনের মধ্যে আসা যাওয়া করে প্রতিদিন ১২ ঘণ্টার মতো কাজ করেন। সময় সাশ্রয় করতে তিনি লিফট ব্যবহার না করে দৌড়ে ডেলিভারি দেন।
২০১৯ সালের একটি ট্রায়াথলন প্রতিযোগিতায় স্ট্রোলারের টায়ার নষ্ট হয়ে যায়। স্ট্রোলার ঠেলে লুও শেষ ৫ কিলোমিটার হেঁটে শেষ করেছেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন, প্রতিবার দৌড়ানোর পর ছেলের মন ভাল হয়। সে হাসে। পাশাপাশি, তার নিজের শারীরিক অবস্থাও ভাল হয়। তার মেয়ের স্কুলে এমন একটি ফলক আছে। সেখানে লেখা আছে ভালবাসার জন্য দৌড়। সিয়াও পাই ও লুও শু চিয়ানের পা গল্প সবাইকে জানাতে এ ফলক তৈরি করা হয়। একবার স্কুলে ভাষণ দেয়ার সময় তার মেয়ে উচ্চ কণ্ঠে দর্শকদেরকে বলেন, আমার বাবা বলেছেন, একটি কাজে অবিচল থাকুন, কারণ এতে সফল হবেন- তা নয়, বরং এটি করা সঠিক সে কারণে।
প্রতিবছর লুও শু চিয়ান মৃগী রোগে আক্রান্ত শিশুদের পরিবারের জন্য দৌড় ও বিনোদন অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। বর্তমানে চীনে রয়েছে ৬০ লাখের বেশি মৃগী রোগে আক্রান্ত শিশু এবং প্রতিবছর নতুন করে ৪০-৫০ হাজার এমন শিশু জন্ম হয়। তাদের মধ্যে ২০ লাখের শিশুর বয়স ৬ বছরের কম।
লুও শু চিয়ান আবিষ্কার করেন যে যখন এমন শিশুরা একসাথে থাকে, তখন তারা শুধু শরীরের ভাষা এবং চোখের যোগাযোগের মাধ্যমে সহাবস্থান করতে পারে। পাশাপাশি, তারা এ জগতের মধ্যে কিছু যোগাযোগ সৃষ্টি করতে পারে।
এখনও প্রথম ম্যারাথনের কথা লুও শু চিয়ানের মাঝে মাঝে মনে পড়ে। যখন তারা শেষের দিকে পৌঁছান, তখন লুও তার ছেলেকে চুমু দেন। কারণ তারা প্রথমবারের মতো একসাথে মহান একটি কাজ শেষ করেছেন।
যদিও ছেলে কিছুই বুঝতে পারেনি, তবে লুও ছেলের জন্য নিয়মিত চিঠি ও কবিতা লিখেন। লুও শু চিয়ান ছেলেকে বলেছেন, তোমার সঙ্গে ম্যারাথনে গিয়ে আমি বাবা হিসেবে নিজের দায়িত্ব আরও বুঝি। আমরা ভাগ্য বেছে নিতে পারি না, তাই দুঃখের বদলে আমি দৌড়ানোকে বেছে নিয়েছি। তোমাকে ধন্যবাদ জানাই, কারণ তোমার কারণে আমার ভাগ্যের সঙ্গে লড়ার সাহস পেয়েছি। তুমি আমাকে বুঝিয়েছ ভালবাসার মানে কী? আমি যতক্ষণ দৌড়াতে পারি, তোমাকে ঠেলে নেবো। একেবারে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। (শিশির/এনাম/রুবি)