গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে উচ্চশিক্ষিত যুব-গবেষক ছেন লিউ পিংয়ের প্রচেষ্টা
2023-05-01 10:30:27

গত কয়েক বছর ধরেই চীনের গ্রামাঞ্চলের পুনরুজ্জীবন বাস্তবায়নের কাজকে দেশের উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে বিভিন্ন ধরনের সেরা ও দক্ষ ব্যক্তিদের যৌথ প্রয়াস দরকার। তাই, অনেক যুবক-যুবতী উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর, বিশেষ করে যাদের জন্মস্থান গ্রামাঞ্চলে, তাঁরা সুন্দর গ্রাম গড়ে তুলতে আবার গ্রামে ফিরে গেছেন ও যাচ্ছেন। ছেন লিউ পিং তাদের একজন। তিনি কৃষি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেছেন এবং গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে নিজের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা তাঁর গল্প শোনাব।

১৯৯১ সালের অক্টোবর মাসে ছেন লিউ পিং চীনের হ্যনান প্রদেশের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরে তিনি চীনের উত্তর-পশ্চিম কৃষি ও বন বিশ্ববিদ্যালয়ের (Northwest A&F University)  শস্য জেনেটিক্স এবং প্রজনন বিভাগ থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। বর্তমানে চীনের হ্যনান প্রদেশের সিনইয়াং কৃষি বিজ্ঞান প্রযুক্তি লিমিডেট কোম্পানির সিইও হিসেবে কাজ করছেন তিনি।

নতুন যুগে নতুন ধরনের কৃষক হবেন—এটাই ছিল তাঁর মূল লক্ষ্য। কৃষক হিসেবে নিজের কর্তব্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ২০১১ সালে কাওখাও পরীক্ষা শেষ করে তিনি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের মানা সত্ত্বেও কৃষি বিভাগে ভর্তি হন। তাঁর গণিত মেজর ছিল এবং স্কোরও ভালো ছিল। কিন্তু তিনি গণিত ছেড়ে কৃষি বিভাগে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেন। ২০১২ সালে তিনি কৃষি বিভাগের বীজ বিজ্ঞান ও প্রজনন মেজরে ভর্তি হন এবং গম ও মিষ্টি আলু বীজ প্রজনন বিশেষজ্ঞদের কাছে থেকে বিভিন্ন জ্ঞান শিখতে শুরু করেন।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি উঁচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে, গম ও মিষ্টি আলুর বীজ প্রজনন গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি চেয়েছিলেন, বীজ প্রজননের মাধ্যমে কৃষিক্ষেত সোনার ক্ষেতে পরিণত হবে। আর সেটি তাঁর জন্মস্থানের উন্নয়নে ইতিবাচক ভুমিকা রাখবে। তখন থেকে তিনি নিজেই কৃষির খামার চালু করা এবং বীজ প্রজনন কোম্পানি স্থাপন করার চেষ্টা করতে শুরু করেন। এভাবে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জিত জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগান তিনি।

একটি কোম্পানি আর খামার প্রতিষ্ঠা করা সহজ ব্যাপার নয়। এ প্রক্রিয়ায় তিনি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুরুত্ব অনুভব করেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং গবেষণায় দক্ষতার অভাব হলে, কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান শক্তিশালী হতে পারে না। তখন থেকে তিনি আধুনিক কৃষিকাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণার ওপর অনেক গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে তিনি হ্যনান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি একাডেমির শস্য জেনেটিক্স এবং প্রজনন বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী হিসেবে যোগ দেন এবং জিন ক্লোনিং, জেনেটিক্যালি মডিফাইডসহ বিভিন্ন প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনা করেন। ২০২০ সালে আবার এ মেজরের পিএইচডি শিক্ষার্থী হন তিনি। চীনের বীজ প্রজনন বিশেষজ্ঞদের সাথে গম বীজ প্রজননের গবেষণা নিয়ে কাজ করেন তিনি।

চীনের হ্যনান প্রদেশের ফুইয়াং শহরের ছিংফেং জেলার একটি গ্রামে মিষ্টি আলুর চাষাবাদ ঘাঁটিতে কাজ করতে করতে রোদে ছেন লিউ পিংয়ের চেহারা কালো হয়ে যায়। তিনি স্থানীয় কৃষকদের কাছ থেকে কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ ও দক্ষ চাষবাসের প্রযুক্তি শিখে ফেলেন। এ ঘাঁটি ছিল দারিদ্র্যবিমোচন প্রকল্পের অংশ। তিনি প্রকল্পের দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে, মিষ্টি আলু ক্ষেতের উন্নয়নে ব্যাপক প্রচেষ্টা করেন।

তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায়, এ ঘাঁটির মিষ্টি আলুর মান বেশ ভালো হয়। মিষ্টি স্বাদ ও সুগন্ধের কারণে এই আলু দ্রুত ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। স্থানীয় কৃষকরা মিষ্টি আলু বিক্রি করে অনেক টাকা উপার্জন করেন। তুয়ান গ্রামের কৃষক ওয়াং পিং হাই বলেন, চমত্কার মিষ্টি আলু চাষ করার জন্য স্থানীয় গ্রামবাসী ছেন লিউ পিংকে ‘মিষ্টি আলু ভাই’ বলে ডাকে।

বস্তুত, শুরুর দিকে এ প্রকল্পে অনেক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। ২০১৫ সালে ছেন লিউ পিং ছিংফেং জেলায় মিষ্টি আলু চাষের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখা শুরু করেন। তখন শুরুতে গ্রামবাসীদের মধ্যে অনেকেই একে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখেন।  মিষ্টি আলুর দাম বেশি নয়। এটি চাষ করে কিভাবে বেশি টাকা উপার্জন করা সম্ভব? অনেকের মনে এমন প্রশ্ন জেগেছে।

লিউ পিং তখন গ্রামবাসীদের মনে আস্থা সৃষ্টি করতে, ছিংফেং জেলার কৃষি শিল্প পরিষেবার সাহায্যে একটি পরীক্ষামূলক দল গঠন করেন। তুয়ান গ্রামে একটি মিষ্টি আলু পরীক্ষামূলক ঘাঁটি স্থাপিত হয়। বীজ প্রজনন, বিনা খরচের মেশিনচাষ, সম্পূর্ণ প্রক্রিয়ার চাষ প্রযুক্তির পরামর্শ, এবং ফসল সংগ্রের পর নির্দিষ্ট দামে ক্রয়সহ বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে, স্থানীয় গ্রামবাসীদের আয় বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে তিনি সফল হন।

বর্তমানে ছেন লিউ পিংয়ের মিষ্টি আলু চীনের ২০টিরও বেশি শহরে বিক্রি হয়। তাদের মিষ্টি আলু কেবল স্বাদে ভালো নয়, বরং সুগন্ধযুক্ত এবং সহজে কীটপতঙ্গে আক্রান্ত হয় না। তাঁর প্রভাবে এখন ছিংফেং জেলায় প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে  মিষ্টি আলুর চাষ হয় এবং এ থেকে বছরে আয় হয় ৩০ কোটি ইউয়ান।

এখন ছেনের কোম্পানিতে গম ও মিষ্টি আলু চাষাবাদের সম্পূর্ণ চেইন গঠিত হয়েছে। এখানে বার্ষিক গমবীজ উত্পাদন হয় এক কোটি কেজির বেশি এবং মিষ্টি আলুর বীজ উত্পন্ন হয় ১৫ লাখ কেজির বেশি। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণাগারের সাথে সহযোগিতায় বিভিন্ন সেরা বীজ প্রজনন ও গবেষণার কাজ অব্যাহতভাবে চলছে। ফলে কোম্পানিতে দেশি-বিদেশি সেরা গমবীজের প্রজাতির ধরণ ১০০০টিরও বেশি।

নিজের কোম্পানির উন্নয়ন সম্পর্কে ছেন লিউ পিং বলেন, “একা একা সমৃদ্ধ হওয়া বড় ব্যাপার নয়। আমার জন্মস্থানের গ্রামবাসীদের সুখী ও সমৃদ্ধ জীবন আমার কাছে অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।” তাঁর কোম্পানিতে স্থানীয় ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। তা ছাড়া, বিভিন্ন কৃষি প্রশিক্ষণ ক্লাসের মাধ্যমে তিনি কৃষকদের জন্য বিনা খরচে বিভিন্ন প্রজনন ও চাষাবাদের নতুন তত্ত্ব শিখিয়ে দেন। সেটিও স্থানীয় কৃষিশিল্পের উন্নয়নে ইতিবাচক ভুমিকা রাখছে। তাঁর সহায়তা ও প্রশিক্ষণে স্থানীয় কৃষকদের গম উত্পাদনও ব্যাপকভাবে  বেড়েছে। তাদের বার্ষিক আয়ও দেড় কোটি ইউয়ানে উন্নীত হয়েছে।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)