দেহঘড়ি পর্ব-০১৬
2023-04-30 15:28:51

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

টিসিএমে সারে নাক দিয়ে রক্তপড়া

মাঝে মাঝে নাক দিয়ে রক্ত পড়া একটা সাধারণ ব্যাপার। একে নোজব্লিড বা নাসাভঙ্গ বলা হয়। নাকের অভ্যন্তরীণ আস্তরণটি ক্ষুদ্র রক্তনালীতে পরিপূর্ণ। এগুলো খুব নাজুক ও সংবেদনশীল। বাতাস যখন খুব শুষ্ক থাকে বা আপনি যদি জোরে নাক ঝাড়েন, তাহলে সহজেই নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ হতে পারে। নাসাভঙ্গ একটি যন্ত্রণা বটে, তবে এটি গুরুতর কোনও রোগের লক্ষণ নয়। সাধারণ নাসাভঙ্গ এমনি এমনিই ঠিক হয়ে যায়। তবে আপনার যদি ঘন ঘন নাক দিয়ে রক্তপাত হয় বা যদি রক্তপাত ভারী হয় এবং তা বন্ধ করা কঠিন হয়, তাহলে আপনার ডাক্তারে শরণাপন্ন হওয়া উচিত। যেসব কারণে নাক দিয়ে রক্ষক্ষরণ হতে পারে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস, সাইনোসাইটিস, সংক্রামক রোগ, উচ্চরক্তচাপ ও রক্তপাতজনিত ব্যাধি। কোনও রোগীর নাসাভঙ্গের কারণ কোনটি তা নির্ণয় করার জন্য ক্লিনিকাল পরীক্ষার দরকার হয়। যদি ক্লিনিকাল পরীক্ষায় নাক দিয়ে রক্তপাতের কোনও কারণ ধরা না পড়ে, তাহলে এর উপশমের জন্য ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএম ব্যবহার করে দেখতে পারেন।

টিসিএমে মনে করা হয়, সাধারণত রক্তের অতিরিক্ত উত্তাপের কারণে নাক দিয়ে রক্তপাত হয় এবং এর উপশমের জন্য শীতল প্রকৃতির ঔষধিগুলো ভালো কাজ করে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে পালঙ্ক ঘাসের মৌলকাণ্ড, এগ্রিমোনিয়া ভেষজ, ব্লেটিলা বা অর্কিড এবং আরবোর্ভিটার পাতাযুক্ত ডাল।

ক্রমাগত বা বারবার নাক দিয়ে রক্তপাত একটি অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যহীনতার ইঙ্গিত হতে পারে এবং এক্ষেত্রে তাপের উত্সটি নির্মূল করার প্রয়োজন হয়। এ রোগ নিরাময়ের জন্য ভেষজ নির্বাচনের সময় টিসিএম চিকিৎসকরা রক্তপাতের বৈশিষ্ট্যগুলো যেমন রক্তপাতের ব্যাপ্তি, বিরতি, রক্তপাতের পরিমাণ, রক্তের রঙ ও গঠন এবং শরীরের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনায় নেন।

ফুসফুসের মেরিডিয়ানে তাপজনিত নাসাভঙ্গ

ফুসফুসের মেরিডিয়ানে অতিরিক্ত তাপ জমা হলে অনুনাসিক ফোঁটা উজ্জ্বল লাল হয়, চরম শুষ্কতা দেখা দেয় এবং নাকের পথে সংবেদনশীলতা বাড়ে। এছাড়া শুষ্ক কাশি, মুখের শুষ্কতা বা জ্বরের অনুভূতিও হতে পারে। জিহ্বা লাল ও হলুদ আবরণে আবৃত হয় এবং নাড়ি দ্রুত হয়। এই ভারসাম্যহীনতা প্রায়ই শুষ্ক মৌসুমে বা সাধারণ ঠান্ডার সময় ঘটে। এর প্রতিকারে ব্যবহার করা হয় তুঁত পাতা ও চন্দ্রমল্লিকা ক্বাথের সঙ্গে পিওনি মূলের ছাল, পালঙ্ক ঘাসের মৌলকাণ্ড ও আর্বোর্ভিটার পাতাযুক্ত ডাল।

পেটে তাপজনিত নাসাভঙ্গ

এক্ষেত্রে রক্তপাত হয় গুরুতর এবং রক্তের রং হয় উজ্জ্বল লাল বা গাঢ় লাল। এছাড়াও অনুনাসিক প্যাসেজে শুষ্কতা, নিঃশ্বাসে দুর্গন্ধ, মুখের শুষ্কতা, মাড়ির ফোলাভাব, তৃষ্ণা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং প্রস্রাব কমার সঙ্গে জ্বালাপোড়া হতে পারে। জিহ্বা লাল ও হলুদ আবরণে আচ্ছাদিত হয় এবং নাড়ি দ্রুত বয়। যারা অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত ও মশলাদার খাবার বা অ্যালকোহল গ্রহণ করে, তাদের মধ্যে এই ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়। এর প্রতিকারের জন্য ব্যবহার করা হয় জেড ওমেন ক্বাথের সঙ্গে খাগড়ার মৌলকাণ্ড, আর্বোর্ভিটা পাতাযুক্ত ডাল এবং পালঙ্ক ঘাসের মৌলকাণ্ড।

লিভারে তাপজনিত নাসাভঙ্গ

এক্ষেত্রে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয় এবং রক্তের রং হয় গভীর লাল। এর অন্য যেসব বৈশিষ্ট থাকে সেগুলো হলো মাথাব্যথা, ঝাপসা দৃষ্টি, মুখে তিক্ত স্বাদ বা মুখে শুষ্কতা, লাল মুখ, রক্তাক্ত চোখ, বিরক্তি ও পাঁজরের পাশে অস্বস্তি। জিহ্বা লাল ও হলুদ আবরণে আবৃত হয় এবং নাড়ি দ্রুত বয়। এর প্রতিকার সম্ভব জেন্টিয়ান ক্বাথের সঙ্গে খাগড়ার মৌলকাণ্ড, আরবোর্ভিটা পাতাযুক্ত ডাল এবং ইন্ডিয়ান ম্যাডারের শিকড়ের ফর্মুলেশন ব্যবহারের মাধ্যমে।

কিডনি ও লিভারের তাপজনিত নাসাভঙ্গ

এর লক্ষণ হলো নাক দিয়ে থেমে থেমে হালকা রক্ত পড়া। এছাড়া মুখের শুষ্কতা, মাথা ঘোরা, ঝাপসা দৃষ্টি, কানে আওয়াজ, ধড়ফড়, অনিদ্রা, হাতের তালুর উষ্ণতা দেখা দিতে পারে। জিহ্বা গভীর লাল বা কোমল দেখাতে পারে এবং সামান্য আবরণে আবৃত হতে পারে। এক্ষেত্রে নাড়ি দ্রুত বয়। এই ভারসাম্যহীনতা তাদের মধ্যে ঘটে, যারা দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি বা রোগে ভুগছে। এর প্রতিকারে ব্যবহার করা হয় রেহমাননিয়া ফুল গাছের পিলের সঙ্গে অ্যানিমারহেনার মৌলকাণ্ড, আমুর কর্ক গাছের ছাল, লাল পিওনি গাছের শিকড়, পিওনির ছাল এবং পালঙ্ক ঘাসের মৌলকাণ্ড।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

চেচিয়াং ক্যান্সার হাসপাতাল

চেচিয়াং ক্যান্সার হাসপাতাল চীনের প্রথম দিকের শীর্ষ চারটি বিশেষায়িত ক্যান্সার হাসপাতালের একটি। পূর্বচীনের চেচিয়াং প্রদেশের রাজধানী হাংচৌয়ে ১৯৬৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এ হাসপাতালটি। রোগীর যত্ন, ক্যান্সার প্রতিরোধ, গবেষণা, শিক্ষা ও পুনর্বাসনে শ্রেষ্ঠ মান বজায় রাখার কারণে গত ৮ বছর ধরে এ হাসপাতালটি চীনের সেরা ১০টি ক্যান্সার হাসপাতালের মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এছাড়া ২০২০ সালে প্রথমবারের মতো প্রকাশিত জাতীয় পাবলিক হাসপাতাল-সক্ষমতা মূল্যায়নে এ হাসপাতালটি চীনের ক্যান্সার হাসপাতালগুলোর মধ্যে তৃতীয় স্থান অর্জন করে।

চেচিয়াং ক্যান্সার হাসপাতাল চেচিয়াং চাইনিজ মেডিকেল ইউনিভার্সিটি-অধিভুক্ত একটি হাসপাতাল। বিশেষায়িত চিকিৎসার পাশাপাশি এটি চিকিৎসকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দেয়। এসব শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মধ্যে রয়েছে স্নাতকদের ক্লিনিকাল অনুশীলন, স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষা, অবিরত চিকিৎসা শিক্ষা এবং নবীণ চিকিৎসদের প্রশিক্ষণ। এখানে রয়েছে ৯টি শাখা। এগুলো হলো সার্জারি, ইন্টারনাল মেডিসিন, রেডিয়েশন অনকোলজি, অ্যানেস্থেসিওলজি, ক্লিনিক্যাল প্যাথলজি, মেডিকেল ল্যাবরেটরি, রেডিওলজি, আল্ট্রাসাউন্ড মেডিসিন এবং নিউক্লিয়ার মেডিসিন। বছরে এখান থেকে দেড় শ’ জনেরও বেশি আবাসিক প্রশিক্ষণার্থীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

এ হাসপাতালটিকে জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের হাসপাতাল ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের সার্জিক্যাল কেন্দ্রের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের "প্রথম প্রাদেশিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র"; চীনা মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের ক্লিনিকাল ফার্মাসিস্টদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; চেচিয়াং প্রদেশের চিকিৎসা প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; দীর্ঘস্থায়ী রোগ ব্যবস্থাপনা-ক্যান্সার নির্ণয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের কার্ডিওভাসকুলার জরুরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

বর্তমানে এ হাসপাতাল ও এর অধীন ইনস্টিটিউটগুলোতে ৫৫ জন ডক্টরেট সুপারভাইজারসহ মোট ১৭৩ জন স্নাতক সুপারভাইজার রয়েছেন। ২০২২ সালে সালে এখানে ৩৬৩ জন পূর্ণকালীন স্নাতক-পর্যায়ের শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। বর্তমানে এখানে ২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন পর্যায়ের প্রশিক্ষণার্থী রয়েছেন। একটি দৃঢ় ভিত্তি, অসাধারণ বিশেষত্ব এবং বিস্তৃত শৃঙ্খলা নিয়ে একটি অতুলনীয় চিকিৎসা-প্রতিভা প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে চেচিয়াং ক্যান্সার হাসপাতাল ।

 

#ভেষজের গুণ

অ্যাস্ট্রাগালাস মূল

অ্যাস্ট্রাগালাস একটি ভেষজ যা প্রধানত এশিয়ায় জন্মে। পশ্চিমাদের কাছে খানিকটা অপরিচিত হলেও, ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থায় এ ভেষজটি হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হচ্ছে। চীনা ভাষায় এ ভেষজটিকে বলা হয় ‘হুয়াং ছি’।

অ্যাস্ট্রাগালাস পরিচিত রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী হিসাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যাস্ট্রাগালাসে থাকা রাসায়নিক যৌগগুলো শরীরের জারণ-সংক্রান্ত চাপ কমাতে সাহায্য করার পাশাপাশি প্রদাহ হ্রাস করে এবং কোষ-স্তরে ইমিউন প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে।

মনে করা হয়, যারা সামগ্রিকভাবে ভাল স্বাস্থ্যের অধিকারী তারা যখন রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিতভাবে অ্যাস্ট্রাগালাসের মূল গ্রহণ করে তখন এটি সবচেয়ে ভালো কাজ করে। সারা বছর ধরে অ্যালার্জি ও অন্যান্য অসুস্থতায় ভোগে যারা, তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেও এটা ব্যবহার করা হয়।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।