গত বুধবার প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে ইউক্রেন সংকট নিয়ে ফোনালাপ করেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং। চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত এবং বিশ্বে এর নানাবিধ বিরূপ প্রভাবের প্রেক্ষাপটে সি-জেলেনস্কি ফোনালাপকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ও মূল্যবান বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মহল। আশা দেখা দিয়েছে প্রলম্বিত ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের একটি রাজনৈতিক সমাধানের।
সম্প্রতি চীনের মধ্যস্থতায় সৌদি আরব ও ইরান দীর্ঘ দিনের বৈরিতা ভুলে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেছে। দুই রাষ্ট্রের ভিত্তিতে ফিলিস্তিন ও ইসরায়েল সংকট সমাধানে চেষ্টা চালাচ্ছে বেইজিং। দৃশ্যত মধ্যপ্রাচ্যসহ আন্তর্জাতিক মঞ্চে শান্তিস্থাপনকারী হিসেবে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে চীন। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট সি’র ফোনালাপ গোটা বিশ্বের কাছে তাই খুবই ইতিবাচক একটি বার্তা দিয়েছে।
জেলেনস্কির সঙ্গে ফোনালাপে প্রেসিডেন্ট সি জোর দিয়ে বলেন, ‘ইউক্রেন সংকটের বিষয়ে চীন বরাবরই শান্তির পক্ষে। দু’পক্ষকে শান্তি আলোচনায় বসানোর চেষ্টা চালাচ্ছে চীন। ‘রাজনৈতিকভাবে ইউক্রেন সংকট সমাধানে চীনের অবস্থান’ সম্পর্কিত দলিল প্রকাশের কথাও উল্লেখ করেন তিনি।
প্রেসিডেন্ট সি আরও স্পষ্ট করে বলেন, চীন ইউক্রেন সংকটের সৃষ্টিকারী বা তাতে কোনো পক্ষ নয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং দায়িত্বশীল বড় দেশ হিসেবে চীন সংঘাতের আগুনে ঘি ঢালবে না। এমনকি এ সুযোগে নিজের কোনো স্বার্থ হাসিলেরও চেষ্টা করবে না।
বিবদমান দু’টি পক্ষের প্রতি সংযম বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে চীনা নেতা বলেন, ইউক্রেন সংকট মোকাবিলার জন্য বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে বৈঠক করতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে বিশেষ দূত পাঠাবে বেইজিং।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইউরেশিয়া বিভাগের উপপরিচালক ইউ জুন দু’নেতার ফোনালাপের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন। ইউ বলেন, ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের অবস্থান স্পষ্ট এবং কখনো পরিবর্তন হয়নি। এ ব্যাপারে চীনের অবস্থান ন্যায্য অবস্থান। চীন বড় দেশ হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন।
ইউক্রেনের সংঘর্ষ শুরুর পর থেকেই, একটি দায়িত্বশীল দেশ ও জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশ হিসেবে, চীন ন্যায্য অবস্থান বজায় রেখেছে, শান্তি-আলোচনার ওপর গুরুত্ব দিয়ে আসছে, এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সাথে যোগাযোগ বজায় রেখে চলেছে।
কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট সি রাশিয়া সফর করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে গভীরভাবে মত বিনিময় করেন। এ ছাড়া, ফরাসি প্রেসিডেন্ট, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ও ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্টও সম্প্রতি চীন সফর করেন। এ সব সফরে ইউক্রেনের সংঘর্ষ ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। আন্তর্জাতিক সমাজও আশা করছে যে, চীন ইউক্রেনের সংকটে আরও বেশি ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
চীন ‘ইউক্রেন সংকট সমাধানের জন্য চীনা প্রস্তাব’ শীর্ষক দলিলপত্র প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন দেশের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করা, ঠান্ডাযুদ্ধের মানসিকতা পরিত্যাগ করা, যুদ্ধবিরতির জন্য কাজ করা, শান্তি-আলোচনার সূচনা করাসহ ১২-দফা প্রস্তাব আছে এতে। এ ছাড়া, চীন ইউক্রেনকে প্রয়োজনীয় অসামরিক সহায়তাও দিয়ে আসছে। চীন আন্তর্জাতিক সমাজের সঙ্গে ইউক্রেন সংকট সমাধানের জন্য গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে ইচ্ছুক।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের সর্বশেষ ফোনালাপকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ব্যাপকভাবে স্বাগত জানিয়েছে। অনেকেই আশা প্রকাশ করেছেন যে ইউক্রেন সংকটের সুরাহায় চীন একটি শান্তিপূর্ণ মীমাংসার ক্ষেত্রে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উপ-মুখপাত্র ফারহান হক বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ইউক্রেন সংকট সমাধানে চীন সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে জাতিসংঘ আশা করে।
ইউক্রেন সংঘাতের অন্যৃতম পক্ষ রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বুধবার বলেন যে, একটি আলোচনার প্রক্রিয়া শুরু করতে চীনের উদ্যোগকে স্বাগত জানায় মস্কো।
সি-জেলেনস্কি কথোপকথনকে "ইতিবাচক" বলে অভিহিত করে ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বুধবার এক বিবৃতিতে বলেছে যে ইউক্রেন সংকটের অবসান ঘটাতে চীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান মুখপাত্র এরিক মামারের মতে, ব্রাসেলসও সি-জেলেনস্কির কথোপকথনকে স্বাগত জানিয়েছে, কারণ এটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য হিসাবে তার দায়িত্ব পালনে চীনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
চীনে নিযুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রদূত সিয়াবোঙ্গা কুয়েল ইউক্রেন সংকটের রাজনৈতিক নিষ্পত্তির লক্ষ্যে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে মধ্যস্থতা করার চীনা প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন যে, শান্তিপ্রিয় দেশ হিসেবে চীনের এ উদ্যোগ উন্নয়নশীল দেশ এবং বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষ সমর্থন করে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।