কে বলেছে যে "কবিতা লেখা" শুধুমাত্র সংস্কৃতির অঙ্গনের লোকদের "অধিকার"? এমন একজন ‘কুরিয়ার কবি’ আছেন, যিনি বিগত ৫ বছরে দেড় লাখ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছেন পণ্য বিলি করার জন্য এবং ৪ সহস্রাধিক কবিতাও লিখেছেন। ডেলিভারির জন্য এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়ার পথে, লালবাতির সামনে, গ্রাহকের দরজার সামনে অপেক্ষার সময়...যখনই অনুপ্রেরণা এসেছে, তিনি একটি কাগজ লিখেছেন বা নিজের ফোনে রেকর্ড করেছেন কবিতা।
তাঁর নাম ওয়াং জিবিং। তিনি আগে ছুতারের কাজ করেছেন, ট্রাক চালিয়েছেন, জীবিকার জন্য শিনচিয়াংয়ে গিয়েছেন, এবং সুচৌতে বর্জ্যপণ্য সংগ্রহ করেছেন। এমনকি, তিনি জুনিয়র হাই স্কুলও শেষ করেননি। কিন্তু, বিগত ৩০ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি নিজেকে লেখালেখিতে ঠিকই নিয়োজিত রেখেছেন।
চলতি বছরের মার্চে তৃণমূল পর্যায়ের শ্রমিক ভ্রমণশীল কবি হিসেবে তিনি তার প্রথম কবিতা সংকলন “তাড়াহুড়োয় মানুষ” প্রকাশ করেন। দোবান তালিকায় এটি ৯.৪ পয়েন্ট পেয়েছে, এবং প্রায় ৮০% লোক এটিকে পাঁচ তারকা দিয়ে পছন্দ করেছেন। যে যুগে অনেকেই আওয়াজ তুলছেন যে "সাহিত্য অকেজো", সে যুগে কবিতা লিখে কীভাবে জীবন বদলানো যেতে পারে? ওয়াং জিবিংয়ের গল্প পড়লে আপনি উত্তর খুঁজে পেতে পারেন।
২০১৯ সালে, ওয়াং জিবিং যখন টেকওয়ে কুরিয়ার হিসেবে কাজ করছিলেন, তখন তিনি একটি খুব কঠিন অবস্থায় পড়েন। গ্রাহক ভুল ঠিকানা দিয়েছিলেন। তাই তাকে টানা ৩টি ভবনে মোট ১৮টি তলায় উঠতে হয়েছে। এ অর্ডারের কারণে পরবর্তী দুটি টেকওয়ে অর্ডার দেরি হয়ে যায় এবং তাকে কুরিয়ার ফির ৮০% জরিমানা করা হয়। সেই সময়ে, ওয়াং জিবিং একজন স্বামী এবং তিন সন্তানের বাবা। পরিবারের স্তম্ভ হিসেবে তার "তর্কবিতর্ক" করার মতো সুযোগ ছিল না, তাই তাঁকে মাথা নিচু করে অন্যের কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল। কিন্তু তার মনে তিক্ততা বাড়ছিল। বাড়ি ফেরার পথে, তিনি তার অকথ্য বিষন্নতা কবিতা আকারে প্রকাশ করেন, তাই এলো “তাড়াহুড়োয় মানুষ "——
"বায়ু থেকে বাতাস তাড়িয়ে দেয়, বাতাস থেকে ছুরি তাড়িয়ে দেয়। হাড় থেকে আগুন তাড়িয়ে দেয়, আগুন থেকে জল তাড়িয়ে দেয়। যে তাড়াহুড়ো করে তার কোনো ঋতু নেই, আছে শুধু স্টপ এবং স্টপ। পৃথিবী একটি জায়গার নাম, যেমন ওয়াং জুয়াং গ্রাম। প্রতিদিন আমি দেখতে পাই, একের পর এক কুরিয়ার দৌড়াচ্ছে। তারা তাদের পা দিয়ে মাটিতে হাতুড়ি দেয়, এবং এই পৃথিবীতে নিজেকে ইস্পাত বানায়।"
একবার ওয়াং জিবিং একটি মন্দির নির্মাণকারী শ্রমিকদের খাবার সরবরাহ করার অর্ডার পান। মধ্যাহ্নভোজের বিরতির সময় মন্দিরটি শান্তিপূর্ণ এবং গম্ভীর। তিনি মাথা তুলে দেবতার মূর্তির দিকে তাকালেন, কিছুক্ষণ বিরতি নেওয়ার কথা ভাবলেন, কিন্তু একজন গ্রাহকের কল তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো। আর "নতুন মন্দির" কবিতাটি রচিত হলো:
"আমি নিশ্চিত নই, আমি এ মন্দিরে পা রাখা প্রথম খাবার সরবরাহকারী কর্মী কি না। দাশিয়োং হলের দেবতারা উপর থেকে শুধু আমার দিকে তাকাচ্ছেন। এটি একটি দুর্দান্ত সুযোগ। যদি আমি প্রার্থনা করি, অবশ্যই তাড়াতাড়ি সাড়া পাবো। একটি নম্বর লাইনে অপেক্ষা করুক। কিন্তু আমি হাঁটু গেড়ে প্রার্থনা করব না। আমার কাছে এখনও অনেক অর্ডার আছে, যা সময়মতো ডেলিভারি করা দরকার। এই মুহূর্তে, আমি যেন বোধিসত্ত্ব, অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর প্রার্থনা মেটাতে হবে।"
কুরিয়ার পরিসেবা একটি কঠিন কাজ, কিন্তু ওয়াং জিবিংয়ের কাছে এ কাজটি খুব মূল্যবান, কারণ তার দৃষ্টিভঙ্গি উন্মুক্ত হয়েছে। এ জন্য সমস্ত জীবের জন্য তার গভীর সহানুভূতি। তিনি যখন আরও জায়গায় যান এবং দেখেন যে ধনী লোক হলেও তাদের জীবন কল্পনার মতো চটকদার নয়। কিছু লোক কৃপণ, চরিত্রের কারণে নয়, বরং দারিদ্র্যের কারণে ... তার কবিতা এ জন্য আরও সহনশীল ও করুণাময়।
ভোরের শিশিরে, সারি সারি পরিষ্কারক দেখা যাচ্ছে, এবং রোল কলের সময় তাদের নাম বললে তারা সবাই স্পষ্ট এবং জোরে উত্তর দেয়। চীনে অনেক নারীর নামকরণ করা হয় ফুলের নামে। তাই রোল কলের সময় যেন "শত ফুলের বাগান" দেখা দিচ্ছে:
"চাং পিচ ফুল, চাও পিয়ার ফুল, ওয়াং কুই ফুল। ধূসর চুলের এসব পরিষ্কারক কর্মীদলে প্রত্যেকের যেন একটি ফুলের নাম আছে। ভোরবেলা, শিশিরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে একজন রোল কল করছে। প্রতিবার সে নাম ডাকলে উত্তরে যেন একটি ফুল ফোটে। নাম ডাকা হলো একের পর এক, কিছুক্ষণের মধ্যেই, পুরো শরতজুড়ে ফুলের একটি বাগান হয়ে গেল।"
কবিতা লেখেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে ওয়াং জিবিংয়ের উত্তর হল "লিখতে হয় বলে"। "তাড়োহুড়োর মানুষ" কবিতা সংকলনের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন: "সাহিত্য আমাকে বাঁচিয়েছে।" মাত্র কয়েকটি শব্দে, তিনি তার জীবনের বেশিরভাগ সময় ধরে তার হৃদয়ে জমে থাকা সমস্ত পরিশ্রম ও একাকীত্বের কথা প্রকাশ করেছেন। প্রতিটি মুহূর্তে যখন তিনি "বেঁচে থাকার" সংগ্রাম করছিলেন, তখন তিনি গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন যে, মানুষ ও পশুর মধ্যে পার্থক্য হল "আমাদের সুখ ও স্বাধীনতা অর্জনের প্রবল ইচ্ছা আছে।" যখন দমন করার জন্য বাহ্যিক শক্তি থাকে, তখন এই ধরনের আবেগ পরবর্তন করে। এটি যত শক্তিশালী হয়, ততই এটি "ইস্পাত আগুনে বানানোর" অনুভূতিকে উদ্দীপিত করে। আর কবিতা এ অনুভূতি প্রকাশ করার পথ।
আমরা যখন রাস্তায় থাকি, আপনি এবং আমি অনেক আগে থেকেই দূরত্বের কথা ভাবতে অভ্যস্ত। তবে মাঝে মাঝে, আমরাও থামতে পারি এবং ওয়াং জিবিংয়ের মতো চাঁদের দিকে তাকাতে পারি। (ইয়াং/আলিম/ছাই)