প্রিস্কুলের বাচ্চাদের ইন্টারনেটে আসক্তি ও প্রসঙ্গকথা
2023-04-24 15:34:09

বন্ধুরা, এখন ঈদের ছুটি কাটাচ্ছেন। অবশ্যই মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারের সামনে সময় তুলনামূলকভাবে বেশি কাটছে?  বড়দের জন্য আজকাল মোবাইলে ভিডিও দেখা নিয়মিত ব্যাপার। মোবাইল ফোনের ব্যাপক প্রসারের কারণে এখন অনেক বাচ্চাও মোবাইল ফোন বা কম্পিউটারে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।  কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে নিয়ন্ত্রণহীন মোবাইল ব্যবহার বাচ্চাদের এতে আসক্ত করে তুলতে পারে। এ ধরনের আসক্তি মানসিক ও শারীরিক অবস্থার জন্য ক্ষতিকর। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা প্রিস্কুলের বাচ্চাদের ইন্টারনেটে আসক্তি প্রতিরোধকব্যবস্থা নিয়ে কিছু আলোচনা করব।

 

ইন্টারনেট প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নে এখন সারা বিশ্বের বাচ্চারা অনেক কম বয়স থেকে মোবাইল ফোন বা আইপ্যাডসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে শুরু করে। তবে, জরিপ থেকে জানা গেছে, ৩ থেকে ৬ বছর বয়সী বাচ্চারা যদি অতিরিক্ত ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তবে তাদের দৃষ্টিশক্তি ও মস্তিষ্কের ওপর তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সম্প্রতি চীনের প্রিস্কুলের বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ও আইপ্যাড ব্যবহারের ওপর একটি জরিপ করা হয়। চীনের ৩১টি প্রদেশের ২৫ হাজারেরও বেশি পরিবার এ জরিপে অংশ নেয়। বিশেষজ্ঞরা এ জরিপ অনুসারে বাচ্চাদের বিজ্ঞানসম্মতভাবে মোবাইল ফোন ব্যবহার বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিয়েছেন।

 

এবারের জরিপ থেকে জানা গেছে, চীনে প্রিস্কুলের বাচ্চারা মোবাইলে গেমস খেলা শুরু করে ৩ বছর বয়স থেকেই। অনেক বাচ্চা মোবাইলের বিভিন্ন এপিপি ব্যবহারে বা ভিডিও দেখায় বেশ দক্ষ। সহজেই তারা একটি মোবাইলের বিভিন্ন ফাংশন সম্পর্কে জেনে ফেলে। বেইজিংয়ের বাসিন্দা ওয়াং লি’র মেয়ের মাত্র ৪ বছর বয়স। সে প্রতিদিন মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিও দেখে বা গেমস খেলে। প্রতিবার কমপক্ষে ২ ঘন্টা। যদি তার মা মোবাইল ফোন বন্ধ করেন বা তার হাত থেকে নিয়ে যান, তাহলে মেয়ে কান্নাকাটি শুরু করে। মা ওয়াং লি’র জন্য এটা উদ্বেগের ব্যাপার।

 

বস্তুত, জরিপে অংশগ্রহণকারী ৭০.৪ শতাংশ প্রিস্কুলের বাচ্চা মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। তাদের মধ্যে ৩ বছর মোবাইল ব্যবহার শুরু করে এমন বাচ্চার সংখ্যা ৩৪.৫ শতাংশ এবং ৪ বছর থেকে শুরু করে এমন বাচ্চার সংখ্যা ২১.১ শতাংশ। তাদের মধ্যে অনেকের নিজের বিশেষ মোবাইল ফোন বা আইপ্যাড রয়েছে। এর মধ্যে আইপ্যাডের সংখ্যা ১৮.৭ শতাংশ, স্মার্ট ঘড়ির সংখ্যা ১৮.২ শতাংশ, এবং মোবাইল ফোনের সংখ্যা ১৪.৪ শতাংশ।

 

আরেকজন মা তাঁর ৫ বছর বয়সী ছেলে কিভাবে মোবাইল ফোনে গেমস খেলতে শুরু করে, সে গল্প শেয়ার করেন। একবার বিছানায় মোবাইল ফোনে তার প্রিয় শিশুতোষ গানের ভিডিও প্রচার হচ্ছিল। তখন ছেলে ছোট বয়সের কারণে হাঁটতে পারে না। সে ক্রলিং করে ভিডিও দেখতে আসে। যখন চেয়ারে বসে খাবার খায়, তখন দাদা-দাদী তার জন্য কার্টুন ভিডিও ছেড়ে দেন। এতে ছেলে দ্রুত খাবার খায়। এমন পরিবেশে ধীরে ধীরে মোবাইল ফোন ব্যবহারে আসক্ত হয়ে বাচ্চাটি।

 

প্রিস্কুলের বাচ্চারা মোবাইল ফোন দিয়ে অনেক কাজ করতে পারে। তাদের মধ্যে ৬৮.৫ শতাংশ মোবাইল ফোন দিয়ে কার্টুন চলচ্চিত্র দেখে এবং ৪১.১ শতাংশ বাচ্চা তা দিয়ে ভিডিও দেখে। তা ছাড়া, মোবাইল ফোন দিয়ে ছবি তোলা আর ভিডিও শুটিং করাও তাদের প্রিয় ব্যাপার। অনলাইন ক্লাসের জন্য প্রায় ২০ শতাংশ বাচ্চা মোবাইল ফোন বা আইপ্যাড ব্যবহার করে।

 

রাজধানী বেইজিংয়ের একটি পার্কে সংবাদদাতার সাক্ষাত্কার নেওয়ার সময় একটি ছেলে মোবাইল ফোন দিয়ে ছোট ভিডিও দেখছিল। ২০ মিনিট ধরে সে টানা ভিডিও দেখেছে। তার বাবা বলেন, ছেলের বয়স ৫ বছর। এখন কিন্ডারগার্ডেনে পড়াশোনা করে। তবে, সাধারণ জীবনে মোবাইল ফোন ধরার সুযোগ পেলে মনোযোগ দিয়ে দেখে। তাকে না করার উপায় নেই।

 

জরিপে অনেক পিতামাতা জানিয়েছেন যে, যদিও অনেক বাচ্চা ছোটবেলা থেকে মোবাইল ফোন বা আইপ্যাড ব্যবহার শুরু করে, তবে অধিকাংশ পরিবারের বাচ্চার এ খেলার সময় নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রায় ৫৯.৩ শতাংশ বাচ্চার দৈনিক মোবাইল ব্যবহারের সময় গড়ে ৩০ মিনিট। শিশুদের মধ্যে মোবাইলে গেমস খেলার সময় ৩০ থেকে ৬০ মিনিট পায় ৩০.৭ শতাংশ এবং এক ঘন্টার চেয়ে বেশি সময় পায় ৯.৯ শতাংশ শিশু।

 

তবে অনেক বাবা-মাও বলেন, বাচ্চাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারের সময় নিয়ন্ত্রণে অনেক পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ, তাদের হাত থেকে মোবাইল ফোন নিয়ে নেওয়া অনেক কঠিন ব্যাপার। ফলে, অনেক বাবা-মা তাদের মোবাইল ফোন বাচ্চাকে দেওয়ার আগে যেমন কার্টুন ফিল্ম বা ভিডিও দেখার নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দেন। সময় শেষ হলে তারা ফোন নিয়ে নেন।

 

বিশেষজ্ঞকরা বাচ্চাদের মোবাইল ফোনের আসক্তির কারণ সম্পর্কে বলেন, অনেক পিতামাতা বাচ্চাদের যথেষ্ট সময় দেন না; তাদের সাথে খেলেন না। ইন্টারনেট প্রযুক্তির দ্রুত উন্নয়নের কারণে, বাচ্চাদের বড় হওয়ার পরিবেশেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, চীনে নেটিজনদের সংখ্যা ১০৬.৭ কোটিতে দাঁড়িয়েছে। তাদের মধ্যে প্রায় সবাই মোবাইল ফোন দিয়ে ইন্টারনেট সার্ফিং করেন। অনলাইন পেইমেন্ট ও ব্যবসার কারণে স্মার্ট মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। এ সম্পর্কে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের নারী ও শিশু কমিটির বুদ্ধিজীবি জং ছুন শান বলেন, অতীতে বয়স্ক লোকেরা রেডিওর মাধ্যমে বাচ্চাদের গল্প শোনাতেন; টেলিভিশনে কার্টুন ফিল্ম দেখাতেন। আজকাল সবাই মোবাইল ফোন ও আইপ্যাড ব্যবহার করেন। বই, পত্রিকা বা টেলিভিশনের তুলনায় মোবাইল ফোনের ভিডিও বা অন্যান্য অনুষ্ঠান আরও বেশি আকর্ষণীয়। সংগীত, কার্টুন ফিল্ম বা প্রশিক্ষণ ক্লাস—যে কোনো সময় ইন্টারনেট থেকে খুঁজে নেওয়া যায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে। তাই সমাজে স্মার্টফোনের প্রভাব অনস্বীকার্য।

 

পিতামাতাদের অনেকেই ব্যস্ত কর্মজীবন বা নিজের মোবাইল ফোনের আসক্তির কারণে বাচ্চাদের পর্যাপ্ত কোয়ালিটি সময় দেন না বা দিতে পারেন না। জরিপ থেকে জানা গেছে, ১২.৬ শতাংশ বাবা-মা সবসময় বাচ্চার হাতে মোবাইল ফোন দিয়ে রাখেন। ৬৮.৭৫ শতাংশ পিতামাতা মাঝে মাঝে বাচ্চাকে মোবাইল ফোন দেন এবং মাত্র ১৮.৬৬ শতাংশ পিতামাতা কখনও মোবাইল ফোন বাচ্চার হাতে দেন না। তা ছাড়া, ৩০ শতাংশ পিতামাতা রাতে ঘুমানোর আগে বাচ্চাদেরকে মোবাইলে গল্প শোনান, নিজেরা সরাসরি বই থেকে গল্প শোনান না। পিতামাতার কাছে থেকে কোয়ালিটি সময় না পেয়ে এবং সহজে মোবাইল ফোন হাতে পেয়ে, বাচ্চারা মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ে, যা তাদের মানসিক ও শারীরিক স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর।

 

এ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ জং ছুন শান বলেন, আন্তর্জাতিক সমাজে একটি মতামত বেশ প্রচলিত, আর তা হল: বাচ্চাদের সাথে পিতামাতার সংযুক্তি বা পারস্পরিক যোগাযোগ অতি গুরুত্বপূর্ণ। পিতামাতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাচ্চাদের মনে নিরাপত্তার বোধ সৃষ্টি করে; তাদের মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে; এবং অন্যদের সাথে সহাবস্থানের দক্ষতা বাড়ায়। মোবাইল ফোন পিতামাতার সাহচর্যের বিকল্প হতে পারে না।

 

যদি বাচ্চা ৩ বছর থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে শুরু করে এবং বাবা-মা তা নিয়ন্ত্রণ না করেন, তাহলে একসময় দেখা যাবে বাচ্চা শুধু মোবাইল ফোনই চাইবে, পিতামাতার সাহচর্য চাইবে না। এটা বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার পথে বড় বাধা।

 

এবার জরিপ থেকে জানা গেছে, প্রিস্কুলের বাচ্চারা অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার করায় অনেক পিতামাতা উদ্বিগ্ন। বাচ্চাদের দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া পিতামতার দুশ্চিন্তার একটি মূল কারণ। একজন মা সংবাদদাতাকে বলেন, তাঁর বাচ্চার মাত্র সাড়ে চার বছর। প্রতিদিন বাইরে কমপক্ষে ২ ঘন্টা খেলা করে। তবে এখন তার চোখের অবস্থা দুর্বল। এর মূল কারণ, পরিবারে দাদা-দাদী সবসময় বাচ্চাকে মোবাইল ফোন দিয়ে রাখে। ভিডিও বা কার্টুন ফিল্ম দেখার সময় নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এমন পরিস্থিতি এখন সহজে দেখা যায়। ২০২০ সালে চীনের বিভিন্ন এলাকায় ৬ বছর বয়সী বাচ্চাদের মায়োপিয়ায় আক্রান্তের হার ছিল ৯ শতাংশেরও বেশি।

 

ইন্টারনেট বাচ্চাদের আসক্তি আরেকটি চিন্তার বিষয়। ৬২ শতাংশ পিতামাতা এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা মনে করেন, বাচ্চারা সময় পেলেই মোবাইল ফোন ধরতে চায়। যদি বাবামা কখনও খেয়াল না-তরেন, তখন তাদের মোবাইল ফোন বাচ্চাদের হাতে চলে যায়। কিছু কিছু বাচ্চা টয়লেটে গেলেও মোবাইল ফোনে গেমস খেলে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাচ্চারা সহজে মোবাইল ফোনে আসক্ত হয়, যদি পিতামাতা বাচ্চাদের খেলার সময় নিয়ন্ত্রণ না করেন। যখন তারা এ আসক্তি থেকে বাচ্চাকে সরিয়ে নিতে চান, তখন বাচ্চার সাথে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়।

 

ইন্টারনেটে খারাপ ভিডিও বা তথ্যের সাথে বাচ্চাদের পরিচয় ঘটাও পিতামাতার জন্য উদ্বেগের কারণ। জরিপে অংশগ্রহণকারী প্রায় ৪২ শতাংশ পিতামাতা বাচ্চাদের ইন্টারনেট থেকে খারাপ ভিডিও বা তথ্যের সাথে পরিচিত হবার আশঙ্কা নিয়ে উদ্বিগ্ন।

 

তা ছাড়া, বাচ্চাদের মনোযোগও এতে হ্রাস পাবে। মোবাইল ফোনের ভিডিও বা কার্টুনের রঙ ভিন্ন, কম সময়ের মধ্যে ক্যাপশন পরিবর্তন হয়, যা বাচ্চাদের জন্য আকর্ষণীয় ব্যাপার। তবে, দীর্ঘকাল ধরে এভাবে চলতে থাকলে, বাচ্চাদের মস্তিষ্কের বিকাশে তা বাধার সৃষ্টি করে। মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে যায়।

 

তবে ইন্টানেট এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই যুগকে অস্বীকার করা যাবে না। প্রাচীনকালের মতো জীবন কাটানো সম্ভব নয় আধুনিক যুগের বাচ্চাদের। তাই এসব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সরঞ্জাম ব্যবহার করার মাধ্যমে আমাদের জীবন কীভাবে আরও সুন্দর করা যায়, তা দেখতে হবে। ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, সময় নিয়ন্ত্রণ এক্ষেত্রে জরুরি বিষয়। নিজের আত্মনিয়ন্ত্রণও জরুরি।

 

পরিবারের সদস্যদের উচিত বাচ্চাকে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দিলে সময় নিয়ন্ত্রণ করা। এভাবে বাচ্চাদের জন্য একটি অভ্যাস গঠন করা যেতে পারে। বাবা-মার উচিত নিজেদের মোবাইল ফোন ব্যবহারও নিয়ন্ত্রণ করা। এভাবে বাচ্চাদের জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যায়।

 

পিতামাতাকে বাচ্চাদের সঙ্গে কোয়ালিটি সময় কাটাতো হবে। বাচ্চাদের সঙ্গে নিয়মিত খোলাধুলায় অংশ নিতে হবে। বাচ্চাদের সুন্দর সুন্দর জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়া, তাদেকের প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া হতে পারে চমত্কার ব্যাপার। এভাবে মোবাইল ফোনের আসক্তি থেকে বাচ্চাদের দূর রাখা সম্ভব।

 

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রিস্কুলের বাচ্চাদের জন্য দৈনিক মোবাইল ফোনে গেমস খেলার সময় ১৫ থেকে ৩০ মিনিটের মধ্যে সীমিত রাখা উচিত। প্রতিবার ৫ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি গেমস খেলতে দেওয়া উচিত নয়। পিতামাতার উচিত বাচ্চাদের সাথে এব্যাপারে খোলামেলা আলোচনা করা। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে, নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার তাদের জন্য ক্ষতিকর।

(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)