তাইওয়ানের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের ৪০০টি স্থল-ভিত্তিক হারপুন ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রির ঘোষণায় তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। মঙ্গলবার বেইজিংয়ে নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেছেন, এ পদক্ষেপ এক-চীন নীতি এবং তিনটি চীন-মার্কিন যৌথ ঘোষণার গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করে এবং তাইওয়ান প্রণালী জুড়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।
যুক্তরাষ্ট্রের কিছু লোক ‘তাইওয়ান কার্ড’ খেলে চীনকে আটকাতে চায় উল্লেখ করে ওয়াং বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’, এটি ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছাড়া আর কিছু নয়।
তাইওয়ান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে নতুন করে এ উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চীন-নীতির প্রশ্নটি আবার সামনে এসেছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য (এমইপি) ইইউ সদস্য দেশগুলোকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন-চীন নীতি গ্রহণ এবং বেইজিংয়ের সাথে সংঘর্ষের পরিবর্তে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন।
ইউরোপীয় পার্লামেন্ট মঙ্গলবার স্ট্রাসবার্গে ‘ইইউ-চীন সম্পর্কের জন্য একটি সুসংগত কৌশলের প্রয়োজনীয়তা’ বিষয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন করে। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী পেদ্রো সানচেজ, ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এবং ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ফনসহ কিছু ইউরোপীয় নেতার সাম্প্রতিক চীন সফরের পর ইইউ পার্লামেন্ট এ অধিবেশন করলো।
৯ এপ্রিল চীনে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফর থেকে ফেরার পথে বিমানে একটি সাক্ষাৎকারে সময়, ম্যাক্রোঁ ইউরোপকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর নির্ভরতা কমাতে এবং দুই পরাশক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বে টেনে নেওয়া এড়াতে আহ্বান জানান।
ম্যাক্রোঁ তাইওয়ান সঙ্কট উস্কে দেওয়ার বিষয়ে ইউরোপের প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ইউরোপীয়দের এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে যে তাইওয়ান নিয়ে চীনের সঙ্গে বিরোধে জড়ানো কার স্বার্থে। স্পষ্টতই ম্যাক্রোঁ তাইওয়ান প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের অনুগামী হতে রাজি নন। তিনি বলেন কারো মিত্র হওয়ার মানে এই নয় যে অনুগত দাস হতে হবে।
ম্যাক্রো জোর দিয়ে বলেন যে ইউরোপ ইউক্রেন সঙ্কটের সমাধান করতে পারে না তাদের তাইওয়ানের বিষয়ে চীনকে সতর্ক করার অধিকার নেই।
প্রকৃতপক্ষে ফরাসী প্রেসিডেন্টের এ বক্তব্যই আর জোরালোভাবে উচ্চারিত হয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের কণ্ঠে।
অধিবেশনে বিতর্কে অংশ নিয়ে স্লোভাক এমইপি মিলান উরিক বলেন, ‘চীন সফরের পর, ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ ঘোষণা করেছিলেন যে, ইউরোপের আরও কৌশলগত স্বনির্ভরতা প্রয়োজন এবং এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ধামাধরা উচিত নয়। আমি অনেক বিষয়ে ম্যাক্রোঁর সাথে একমত নই, কিন্তু এবার আমি মনে করি তিনি সঠিক ছিলেন, কারণ বর্তমান ইউরোপীয় নীতির কোন মানে হয় না এবং এটি ইউরোপকে ধ্বংস করছে।
উরিক আরও বলেন, যখন ইইউ’র চীন নীতির কথা আসে, তখন ‘আপনারা কেউ কেউ আমাদের চীনের সাথে সংঘর্ষে ঠেলে দিচ্ছেন কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে তার বিশ্ব আধিপত্যের জন্য হুমকি হিসাবে দেখে’।
উন্নয়নশীল এশিয়ার দ্বারা প্রস্তাবিত সুযোগগুলো গ্রহণের পরিবর্তে ইউরোপ প্রত্যেকের মধ্যে একটি হুমকি বা শত্রু খুঁজছে উল্লেখ করে উরিক বলেন, শিগগির সমগ্র বিশ্বের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে এবং সমগ্র বিশ্ব বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, এরফলে আমরেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। এই দ্বন্দ্বমূলক নীতির অবসান ঘটানোর জন্য এখনই উপযুক্ত সময়।
বিতর্কে অংশ নিয়ে স্পেনের এমইপি মানু পিনেদা বলেন, ‘কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে চীনের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ইইউ এবং এর জনগণের জন্য কল্যাণকর। আসুন আমরা তাদের ফাঁদে না পড়ি যারা তাদের বিশ্ব আধিপত্যের ক্ষেত্রে হুমকি বোধ করছে। আসুন তাদের নোংরা কাজ না করি। আসুন স্বাধীনভাবে আমরা ইউরোপের স্বার্থ রক্ষা করি।
ইউরোপীয় রক্ষণশীল এবং সংস্কারবাদী গ্রুপের চেক সদস্য এমইপি জান জাহরাদিল বলেন, ‘কেউ পছন্দ করুন বা না করুন, চীন একটি বৈশ্বিক শক্তি হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। তাই ইইউকে চীনের সঙ্গে সংঘর্ষের পরিবর্তে সহাবস্থানের পথে যেতে হবে এবং তাইওয়ান প্রসঙ্গে উত্তেজনা না বাড়িয়ে কমাতে হবে।
আয়ারল্যান্ডের এমইপি মিক ওয়ালেস বিতর্ক অংশ নিয়ে বলেন, ‘বিশ্বে চীনের অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে একটি প্রচারাভিযান রয়েছে। তাই যুক্তরাষ্ট্র চীনের তথাকথিত অভ্যন্তরীণ দমন-পীড়ন নিয়ে সমালোচনামুখর হচ্ছে আর আর কোনো কোনো ইইউ প্রতিনিধি তোতাপাখির মতো যুক্তরাষ্ট্রের বুলি আওড়াচ্ছেন। অথছ চীনের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সমস্যা নেই এবং তা বছর বছর বেড়েই চলেছে।
ওয়ালেস বলেন যে, প্রকৃত বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র চীন ও ইউরোপে মুনাফা করতে চায়। আর ইইউ ও চীনের মাঝে একটা বিরোদ জিইয়ে রাখতে পারলে এতে যুক্তরাষ্ট্রেরই স্বার্থ হাসিল হয়।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।