দেহঘড়ি পর্ব-০১৫
2023-04-23 16:37:39

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে টিসিএম

ফার্টিলিটি হলো প্রজনন ক্ষমতা। অনেকে প্রজনন সমস্যা বা বন্ধ্যাত্বে ভোগেন। এ সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে উপযুক্ত ভেষজ কী, তা ঠিক করা অনেক সময় কঠিন হতে পারে। মানুষ প্রায়শই ব্যয়বহুল বিকল্প গ্রহণ করে, যা সমস্যা সমাধানে সহায়ক হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। চীনা ভেষজ ব্যবস্থা বিদ্যমান সবচেয়ে কার্যকর ভেষজ ব্যবস্থাগুলোর একটি। চীনা ভেষজগুলো কদাচিৎ একক ভেষজ হিসাবে গ্রহণ করা হয়, বরং রোগীর পুরো শরীরের স্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে একটি সুষম ফর্মুলেশন প্রস্তুত করা হয়। এক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চীনা ভেষজ যথাযথভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হলে, চার মাসের মধ্যে প্রজনন সক্ষমতা দ্বিগুণ বাড়ে। তবে কোনও একটি নির্দিষ্ট ভেষজ নেই, যা সবার জন্য কাজ করবে। সঠিক ভেষজ নির্বাচনে টিসিএম চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। তারা রোগীর শারীরিক অবস্থা ও লক্ষণ ভেদে আলাদা আলাদা ভেষজ নির্বাচন করে দেন। আজ আমরা আলোচনা করবো এমন কতগুলো ভেষজ নিয়ে, যেগুলো সাধারণত প্রজনন ক্ষমতা বাড়াতে ব্যবহার করা হয়।

ভার্টেক্স বা চেইস্ট বেরি

মাসিক ঋতুচক্রে ভারসাম্য আনা এবং ঋতুপূর্ববর্তী সিনড্রোম বা পিএমএস নিয়ন্ত্রণে একটি জনপ্রিয় ভেষজ ভার্টেক্স বা চেইস্ট বেরি। এটি মস্তিষ্কের পিটুইটারি গ্রন্থিতে কাজ করার মাধ্যমে লুটিনাইজিং হরমোন বাড়ায় এবং ডিম্বস্ফোটন ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে। এ ভেষজ ডিম্বস্ফোটন ও প্রোজেস্টেরন উৎপাদনে সহায়তা করে। এছাড়া এটি উচ্চ প্রোল্যাক্টিন হ্রাস করে এবং তার মধ্য দিয়ে হরমোনের ভারসাম্য আনে এবং ডিম্বাশয়ের কার্যকারিতা উন্নত করে।

মাকা বা পেরুর জিনসেং

প্রজনন ও যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী ঔষধি হিসেবে হাজার হাজার বছর ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে মাকা, যেটিকে পেরুর জিনসেংও বলা হয়। এটি পাওয়া যায় আন্দিজ পার্বত্য অঞ্চলে। মাকা দেখতে অনেকটা শালগমের মতো। এটি একটি অ্যাডাপ্টোজেন হিসাবে কাজ করে এবং এর মধ্য দিয়ে মানসিক চাপ মোকাবেলায় সহায়তা করে। এটি পুরুষ ও মহিলা উভয়ের শরীরে অ্যান্ড্রোজেনকেও প্রভাবিত করে।

দারুচিনি

দারুচিনির মতো সাধারণ জিনিসও কিছু পুরুষ ও নারীর প্রজননক্ষমতা উন্নত করতে পারে। টিসিএমে মনে করা হয়, শরীরে অভ্যন্তরীণ উষ্ণতা এবং মূল শক্তি বা ‘ইয়াং’ বাড়ানোর জন্য দারুচিনি ভীষণ কার্যকরী। উচ্চ প্রজননক্ষমতার জন্য ভারসাম্যপূর্ণ ‘ইয়াং’ শক্তি থাকা দরকার। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ মিলেছে, পুরুষদের শুক্রাণু উৎপাদন ও এর মানের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে দারুচিনি। গবেষণায় আরও প্রমাণিত হয়েছে, দারুচিনি রক্তে শর্করার মধ্যে ভারসাম্য আনে এবং ইনসুলিন প্রতিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। এর মধ্য দিয়ে দারুচিনি পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে আক্রান্ত নারীদের সমস্যা সমাধানে সহায়তা করে।

ট্রিবুলাস টেরেসট্রিস বা বিন্দি

চীনা ওষুধে ব্যবহৃত হয় ট্রিবুলাস টেরেসট্রিস, যেটা বিন্দি নামেও পরিচিত। নারী ও পুরুষ উভয়ের প্রজননক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক এ ভেষজ। যেসব নারী অনিয়মিত ডিম্বস্ফোটনের সমস্যায় ভুগছেন, বিশেষ করে যারা পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোমে আক্রান্ত, তাদের ঋতুচক্র স্বাভাবিক করার এবং ডিম্বস্ফোটন নিয়মিত করার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে বিন্দি। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, উচ্চ মাত্রার অ্যান্টি-স্পার্ম অ্যান্টিবডি রয়েছে এমন দম্পতিদের দুজনেই যখন এ ভেষজ ব্যবহার করেছেন, তখন গর্ভধারণের হার বৃদ্ধি পেয়েছে।


 

#চিকিৎসার_খোঁজ

চেংচৌ বিশ্ববিদ্যালয়-অধিভুক্ত প্রথম হাসপাতাল

চেংচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রথম হাসপাতাল হলো ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন একটি সরকারি হাসপাতাল। সাত হাজারেরও বেশি শয্যার এ হাসপাতালের বার্ষিক আয় সাড়ে ৭শ কোটি ইউয়ান। হাসপাতালটি নিজেকে ‘বিশ্বের বৃহত্তম হাসপাতাল’ বলে মনে করে। এ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানটি ১৯২৮ সালে মধ্য চীনের হেনান প্রদেশের তৎকালীন রাজধানী খাইফেংয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৫৮ সালে এটি বর্তমান রাজধানী চেংচৌতে স্থানান্তরিত হয়। ২০১৭ সালে এর ক্লিনিক্যাল মেডিসিন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রথম-শ্রেণীর বিভাগগুলোর জাতীয় তালিকায় স্থান পায়।

চেংচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রথম হাসপাতাল বর্তমানে চীনের বৃহত্তম প্রথম গ্রেডের হাসপাতাল, যেখানে রয়েছে চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণা, রোগ প্রতিরোধ সেবা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবার যাবতীয় ব্যবস্থা। এটি চিকিৎসা সেবার সক্ষমতা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগের দক্ষতার ক্ষেত্রে চীনের উচ্চ মানের প্রতিনিধিত্ব করে। বিভিন্ন সময় এটি যেসব খেতাব অর্জন করেছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘জাতীয় সভ্য ইউনিট’, ‘চীনের ১শ সেরা হাসপাতালের একটি’, ‘জাতীয় পর্যায়ের অসামান্য অবদান রাখা স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠান’ এবং ‘উচ্চমানের নার্সিং সেবার জন্য শীর্ষ জাতীয় হাসপাতাল’। ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিংয়ে এটি চীনের ১৯তম শীর্ষ হাসপাতাল।

বর্তমানে চেংচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত প্রথম হাসপাতালের চারটি শাখা রয়েছে। সেগুলো হলো হেয়ি শাখা, চাংতুং স্বতন্ত্র শাখা, হুইচি (উত্তর) শাখা এবং বিমানবন্দর অঞ্চল (দক্ষিণ) শাখা।

হেনান প্রদেশের জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের শিক্ষাদানের জন্য হাসপাতালটি ওই অঞ্চলের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান। এর শিক্ষা-অবকাঠামো তিনটি স্কুল ও কলেজ নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো কলেজ অব ক্লিনিক্যাল মেডিসিন, স্কুল অব মেডিকেল এক্সামিনেশন এবং স্কুল অব স্টোমাটোলজি। ডিগ্রী পর্যায়ের শিক্ষার জন্য এটি চেংচৌ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ক্লিনিকাল মেডিসিন, মেডিকেল পরীক্ষা, রোগ প্রতিরোধমূলক ওষুধ, স্টোমাটোলজি এবং মেডিকেল ইমেজিংয শেখায়। এখানকার শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন প্রায় ১শ’ ডক্টরেট ডিগ্রিধারী এবং ৫৪৪ জন মাস্টার্স ডিগ্রিধারী। সব মিলিয়ে, হাসপাতালটি বছরে ৫ শতাধিক স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী, ২ শতাধিক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী এবং হেনান এবং অন্যান্য প্রদেশের  প্রায় ২ হাজার প্রশিক্ষণার্থীকে শিক্ষা দেয়।

এ হাসপাতালের গবেষণা সুবিধা এবং অন্যান্য অবস্থার উন্নতি হচ্ছে  প্রতিনিয়ত। এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ৫টি একাডেমিশিয়ান ওয়ার্কস্টেশন, ৩টি পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা কেন্দ্র, ১টি জাতীয় পর্যায়ের প্রকৌশল পরীক্ষাগার, ১টি জাতীয়ভাবে পরিচালিত প্রকৌশল পরীক্ষাগার, জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের ১টি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগার, জাতীয় ক্লিনিক্যাল মেডিসিন গবেষণা কেন্দ্রের ১০টি উপকেন্দ্র এবং প্রাদেশিক পর্যায়ের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগার, ৪টি ক্লিনিক্যাল মেডিসিন গবেষণা কেন্দ্র, ১০টি প্রযুক্তি গবেষণা কেন্দ্র, ৩১টি প্রকৌশল গবেষণাগার ও গবেষণা কেন্দ্র ইত্যাদি।

 

#ভেষজের গুণ

হানিসাকল ফুল

সার্বিক সুস্থতার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যা হলো চীনা ভেষজবিদ্যা। এই বিদ্যা এবং সারা বিশ্বের অন্যান্য চিকিৎসাবিদ্যা মানবদেহকে নিরাময় ও শক্তিশালী করতে উদ্ভিদের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে এবং অবিরতভাবে লাগিয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা আলোচনা করবো ভেষজবিদ্যার অন্যতম একটি ভেষজ হানিসাকল ফুল নিয়ে।

হানিসাকল একটি দৃষ্টিনন্দন ফুলের উদ্ভিদ। পূর্ব এশিয়া জুড়ে ব্যাপকভাবে জন্মায় এই ফুলগাছ। এ ফুলে রয়েছে একটি আনন্দদায়ক উষ্ণ, মিষ্টি ঘ্রাণ, যা কখনও কখনও অ্যারোমাথেরাপি চিকিত্সায় ব্যবহার করা হয়। তবে ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থায় এর সবচেয়ে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রদাহবিরোধী, ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরালবিরোধী প্রভাবসহ রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ক্ষমতা।

জ্বর, গলা ব্যথা ও ত্বকের ফুসকুড়ির মতো কিছু রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে শরীরকে সাহায্য করে হানিসাকল ফুল। চীনা ভাষায় এ ফুলকে বলা হয় চিন ইয়িন হুয়া। এই অনন্য চীনা ভেষজটি পুরো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করে, যার ফলে একজন রোগী ভালভাবে ও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে এবং নিয়মিত রুটিনে ফিরে যেতে পারেন।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।