চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-১৩: ৪০তম ওয়েইফাং আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসব
2023-04-22 20:11:41


'ঘুড়ির রাজধানী' হিসেবে পরিচিত পূর্ব চীনের শানতং প্রদেশ। এই প্রদেশের  ওয়েইফাং শহরের আকাশে চলছে রংবেরঙের ঘুড়ির খেলা। 

এর মধ্য দিয়ে এই বছর বিস্তীর্ণ ওয়েইফাং বিনহাই আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উড়ানোর ক্ষেত্রটিতে মাসব্যাপী আবারও বিভিন্ন আকৃতির ঘুড়ি উড়ানো শুরু হলো।  



আয়োজকরা জানান, উৎসব চলাকালীন অনলাইন ঘুড়ি ওড়ানো প্রতিযোগিতা এবং অবষৈয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শনীসহ ঘুড়ি-থিমভিত্তিক কার্যকলাপগুলোর একটি সিরিজ অনুষ্ঠিত হবে।

এই আয়োজনে ৬০টি দেশ ও অঞ্চলের ৬ শো’ জনেরও বেশি ঘুড়ি উৎসাহী অংশ নিয়েছেন। বিভিন্ন আকৃতির এসব রঙ বেরঙের ঘুড়ি তারা বেশ উপভোগ করছেন।  

ওয়েইফাং শহর ঘুড়ির জন্মস্থান, ঘুড়ি তৈরির দীর্ঘ ইতিহাস এবং চমৎকার কারুকার্যের জন্য বিখ্যাত। বিশ্বের ৭০ শতাংশের বেশি ঘুড়ি এই শহরেই তৈরি করা হয় বলে জানা যায়।

 

 ১৯৮৪ সাল থেকে ওয়েফাং আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবের জন্য এ শহর সুখ্যাত। ১৫ এপ্রিল শুরু হওয়া এই উৎসব আগামী মে মাসের ২১ তারিখ পর্যন্ত চলার কথা রয়েছে।

ইউননানে ৮ম চীন নৃত্য উৎসব

পর্দা নামলো ৮ম চীন নৃত্য উৎসবের। দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউননান প্রদেশের খুনমিং সিটিতে ১৫ এপ্রিল শেষ হয় ৫ দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য এ নৃত্য উৎসব।

 

খুনমিংয়ের প্রাদেশিক জাদুঘরে "রং" নামে- যার অর্থ "একত্রীকরণ"- নৃত্য মঞ্চস্থ হয়, যেখানে নৃত্যশিল্পীরা শারীরিক ভাষার মাধ্যমে পরিবেশ, স্থাপত্য, প্রকৃতি বা শহুরে স্থান সম্পর্কে তাদের উপলব্ধি চিত্রিত করেন।

জাদুঘরের ঐতিহাসিক পটভূমি এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে মাথায় রেখে চায়না ড্যান্সার্স অ্যাসোসিয়েশনের (সিডিএ) তরুণ কোরিওগ্রাফাররা কোরিওগ্রাফি করে। শোটিতে ভিজ্যুয়াল স্থাপনা এবং নাটকের পরিবেশনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়- যাতে দর্শকরা ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতি এবং নৃত্যরস উপভোগ করতে পারেন।

 

চায়না ড্যান্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ফেং শুয়াংপাই বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে- ‘আমি বিশ্বাস করি যে পরিবেশের দ্বারা উদ্ভূত অভ্যন্তরীণ আবেগগুলো রয়েছে একটি পরিবেশগত নৃত্যের মূলে। শিল্পীরা আবিষ্কৃত সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তির সামনে নাচ করেন। দর্শকরা যখন এটি দেখেন, তখন এটি মঞ্চের স্থান ছাড়িয়ে যায় এবং এটি একটি নতুন দৃশ্যপট তৈরি হয়’। 

চমৎকার নৃত্য পরিবেশন এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক পরিবেশনা ছাড়াও, সদ্য সমাপ্ত নৃত্য উৎসবটি ইউনান আর্টস ইউনিভার্সিটিতে বেশ কিছু বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীকে নৃত্য সৃষ্টি ও শিক্ষাদানের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে।

এ ছাড়া, ১৯৯২ সালে মঞ্চায়িত ও ওয়েনহুয়া পুরস্কার জয়ী পূর্ণদৈর্ঘ্যের নৃত্যনাট্য, "আশিমা", প্রদর্শিত হয় এবারের উৎসবে।

চায়না ড্যান্স এসোসিয়েশনের লিডিং পার্টি গ্রুপের প্রধান লৌ পিন তুলে ধরলেন নৃত্য উৎসবের তাৎপর্য। ‘ইউনান চীনা জাতিগত লোকনৃত্যে সমৃদ্ধ। ইউনানের শৈল্পিক অন্বেষা একটি নির্দিষ্ট যুগে চীনা নৃত্য সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই নৃত্য উৎসব চীনা নৃত্যের সমসাময়িক মূল্যকে প্রতিফলিত করে এবং চীনা নৃত্যের সমসাময়িক সৃজনশীল শৈলী প্রদর্শন করে’।

পাঁচ দিনব্যাপী নৃত্য উৎসবটি শুরু হয় গত ১১ এপ্রিল।

 

চিরায়ত চীনা সাহিত্য

চাং চিউলিং: নতুন ধারার থাং কবিতার খ্যাতিমান কবি

চাং চিউলিং ছিলেন একাধারে কবি, রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিত। তিনি থাং রাজবংশের সময়কার একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি। ছয় রাজবংশের সময়কার কবিতার ধরন থেকে বেরিয়ে এসে থাং কবিতা নিজস্ব নতুন স্টাইল নেয় যে কবিদের মাধ্যমে তাদের অন্যতম হলেন চাং চিউলিং।

চাং চিউলিংয়ের জন্ম ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট কাওচোংয়ের রাজত্বকালে। বর্তমান কুয়াংতং প্রদেশের শাওকুয়ানে তার জন্ম। সে সময় জায়গাটি ছিল থাং রাজত্বের প্রত্যন্ত অঞ্চল। চিন রাজবংশের সময় থেকেই তার পরিবার অভিজাত এবং এই এলাকার উচ্চপদস্থ শাসকদের মধ্যে ছিল। শৈশব থেকেই চাং ছিলেন বুদ্ধিমান। তিনি কবিতা লিখতেন। ৬৮৫ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১২ বছর তখন চাং কুয়াংচৌর কুয়াং প্রিফেকচারের শাসক ওয়াং ফাংছিংকে একটি চিঠি লেখেন। ওয়াং ফাংছিং চিঠি পড়ে মুগ্ধ হন এবং মন্তব্য করেন যে এই ছেলে ভবিষ্যতে অনেক দূর যাবে।

পরবর্তিকালে চাং সরকারি চাকরির পরীক্ষা চিনশি পাশ করেন প্রথম স্থান নিয়ে। ৭১২ সালে তার কর্মজীবন শুরু হয়। তিনি রাজকীয় প্রতিষ্ঠান হোংওয়েন প্যাভিলিয়নের একজন কেরানি ছিলেন। সেসময় যুবরাজ লি লংলি নিজের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে একটি পরীক্ষা নেন। সেই পরীক্ষাতেও চাং প্রথম হন। এর ফলে তিনি আইনসভার একজন পরামর্শক হন।

৭১২ সালে লি লংলি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন এবং সুয়ানচোং নাম ধারণ করেন। এই পর্যন্ত সম্রাট রাজধানী চাংআনের বাইরে স্বর্গ-মর্ত্যের উদ্দেশে কোন বলি দেননি। চাং এই সময় সম্রাটকে পরামর্শ দেন স্বর্গের উদ্দেশ্যে বলিদানের। সম্রাট তার পরামর্শ মেনে নেন।

চাং নিজে ছিলেন অত্যন্ত সৎ মানুষ। সম্রাট তার সততা এবং যোগ্য পদে যোগ্য ব্যক্তিকে চিনে নেয়ার দক্ষতাকে মূল্যায়ন করতেন। চাংয়ের কবিতার বৈশিষ্ট্য ছিল সহজ ভাষায় গভরি অনুভূতিকে ব্যক্ত করা।

চাং একসময় সম্রাটের একজন চ্যান্সেলরও হন। তিনি যোগ্যতার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করতেন এবং সম্রাটকে বিচক্ষণতার সঙ্গে পরামর্শ দিতেন। তবে একসময় সম্রাট বিলাসিতা ও চাটুকারিতার মোহে পড়ে চাংয়ের পরামর্শকে অগ্রাহ্য করতে থাকেন।  একজন সেনাপতি বিষয়ে চাং সতর্কবাণী দেন যে ভবিষ্যতে এ ব্যক্তি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে। সম্রাট এ সতর্কবার্তায় কান দেননি।

একসময় চাংয়ের উপর রুষ্ট হয়ে তার পদাবনতিও ঘটান সম্রাট। পদাবনতি ঘটালেও সম্রাট তার সততার কদর করতেন। এমনকি অন্য কোন ব্যক্তির সততার প্রশংসা হলে সম্রাট বলতেন তাদের সঙ্গে কি আর চাংয়ের তুলনা হয়? চাংয়ের মতো সততা কারও থাকা সম্ভব নয়।

৭৪০ সালে নিজের জন্মস্থান শাও প্রিফেকচারে মা বাবার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যান চাং। সেখানেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর অনুতপ্ত সম্রাট তার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

একসময় চাংয়ের সতর্কবার্তা ফলে যায় এবং সেই সেনাপতি বিদ্রোহ করে যা রাজ্যে বিপর্যয় নিয়ে আসে।

চাং তার কবিতায় জীবনের গভীর অনুভূতি খুব সহজ সরল ভাষায় তুলে ধরেছেন। তার একটি কবিতা শোনাচ্ছি। কবিতার শিরোনাম, ‘চাঁদের দিকে তাকিয়ে দূরবর্তি একজনের ভাবনা’

সাগরের উপর উজ্জ্বল হয়ে উঠছে জোছনা

আমরা বহু দূর থেকে দেখছি চাঁদকে

প্রেমিকের অভিযোগ রাত কেন দীর্ঘ এত

মোমবাতি নিভে গেছে, আলো হয়েছে আরও উজ্জ্বল ।

আমার পোশাক শিশিরে সিক্ত

আমি তোমাকে চাঁদের আলো পৌঁছে দিতে পারছি না

শুধু তোমার স্বপ্ন আমার দুচোখ ঘিরে রাখে।

মানবমনের আবেগ ও অনুভূতিকে কবিতায় তুলে ধরার জন্য কবি চাং চিউলিং এর কবিতা সংগ্রহ চীনের চিরায়ত সাহিত্যের একটি মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।

----------------------------------------------------------------------

প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: রওজায়ে জাবিদা ঐশী, , মাহমুদ হাশিম, শান্তা মারিয়া

কবিতা অনুবাদ: শান্তা মারিয়া

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ, রফিক বিপুল

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।