চীন-আফ্রিকা মৈত্রীর অসাধারণ ছয় দশক
2023-04-19 13:30:23

১৯৬৩ সালের ৬ এপ্রিল একটি চীনা চিকিৎসা দল বেইজিং থেকে ১০ দিনের মধ্যে মস্কো, বেলগ্রেড ও রাবাত হয়ে অবশেষে উত্তর আফ্রিকার আলজেরিয়ার সাইদা শহরে পৌঁছায়। এটি চীন সরকারের পক্ষ থেকে আফ্রিকায় পাঠানো প্রথম চিকিৎসা দল।

 

সাইদা ছোট একটি শহর এবং সাহারা মরুভূমির সীমান্তে অবস্থিত। এটি মরুভূমির দরজা নামে পরিচিত। আলজেরিয়ায় পাঠানো ২৭তম চীনা চিকিৎসা দলের প্রধান লেই লি রং জানিয়েছেন, যখন বালির ঝড় আসে, তখন সব জানালা ও দরজা বন্ধ রাখলেও বাসায় ধুলো আসে। তীব্র রোদ ও খরার কারণে স্থানীয় সবজির চাষও সীমাবদ্ধ।

 

সাইদার মতো কঠোর পরিবেশ আফ্রিকায় চীনা চিকিৎসা দলের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার। তবে, চীনা চিকিৎসা কর্মীরা কখনো পিছপা হননি। আফ্রিকায় যাবার প্রথম মিনিট থেকেই তারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করার জন্য প্রস্তুত থাকেন।

 

ষাট বছর বয়সী থু তা ছুন হুই পেই প্রদেশের চিন চৌ শহরের ক্যান্সার হাসপাতালের এক অর্থোপেডিক ডাক্তার। ২০০২ সাল থেকে তিনি ৬ বারের মতো আফ্রিকায় গিয়েছেন। আলজেরিয়ায় তিনি মোট ১২ বছরের মতো কাজ করেছেন। সবচেয়ে ব্যস্ত সময়ে তিনি সকাল ৮ থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত কাজ করেন এবং প্রতিমাসে ১০ বারের মতো রাতে জরুরী কক্ষে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেছেন, কাজ শেষে পানি খাওয়া ছাড়া আরও কিছুই করতে পারতেন না।

 

২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে আলজেরিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল কোভিড-১৯ মহামারি। একবার অস্ত্রোপচারের রোগী ও স্থানীয় কর্মীসহ ৫জন কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। একজন নার্সও তখন অস্ত্রোপচারে অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এমন অবস্থায় থু তা ছুন একা অস্ত্রোপচার শেষ করেছেন।

 

তিউনিসিয়ার সিডি-বউজিদ-এর স্থানীয় এক হাসপাতালে পেং সি হুয়া একমাত্র রিসিপশনিস্ট। তিনি একা তিনজনের কাজ করেন এবং সপ্তাহে তিনি ৭২ ঘণ্টার মতো কাজ করেন। সবচেয়ে ব্যস্ত দিনের সকালে তিনি ৩৭টি অস্ত্রোপচারের ফোন পেয়েছেন।

 

চীনের হ্য নান প্রদেশের ডাক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় আফ্রিকায় ছিলেন উ মিন সিয়ান। ২০০১ সাল থেকে তিনি যথাক্রমে ইরিত্রিয়া, জাম্বিয়া, ইথিওপিয়ায় গিয়েছেন। তিনি দশবারের মতো ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। তবে, তিনি বলেছেন, চিকিৎসকের জন্য কোন দেশের সীমান্ত থাকে না, যেখানে আমি প্রাণ উদ্ধার করতে পারি, সেখানেই আমি যাই। ওষুধ ও চিকিৎসকের অভাবে কাজ করা আমার জন্য তাৎপর্যপূর্ণ।

 

ডাক্তার উ ই লুন তিনবারের মতো সুদানে গেছেন। পাশাপাশি, তার পরিবারে তার চাচা, বোন, শ্যালকও আফ্রিকায় চিকিৎসা সেবা প্রদান করেছেন। তারা ২১ বছরে মোট ১১ বার এক জনের পর এক জন আফ্রিকায় কাজ করেছেন। উ ই লুন বলেছেন, আফ্রিকায় যাওয়া যেমন আমাদের পরিবারের ঐতিহ্য, তেমনি আমাদের দায়িত্ব।

 

১৯৮০ সালে শেন আলি জন্মগ্রহণ করেন। তখন তার দাদা আলজেরিয়ার এক হাসপাতালে কাজ করতেন। চীন ও আলজেরিয়ার মৈত্রীর স্মরণে তাকে আলি নাম দেন তার দাদা। পাশাপাশি, তার দাদা  আলির দুই ভাইকে নাম দিয়েছেন সিয়াও লি ও ইউ লি। ২০১৫ সালে শেন আলি তার দাদার মতো ২৪তম চীনা চিকিৎসা সহায়তা দলের সদস্য হিসেবে আলজেরিয়া গিয়েছেন।

 

পঞ্চান্ন বছর বয়সী চুই হাই লিন ২০০৮ ও ২০১২ সালে দু’বারের মতো নামিবিয়ায় গেছেন। ২০১৮ সালে তিনি ১২তম চীনা চিকিৎসা দলের প্রধান হিসেবে আবার নামিবিয়ায় যান। এবার তার স্ত্রীও নার্স হিসেবে তার সঙ্গে গেছেন। চু হাই লিন বলেছেন, আফ্রিকার প্রতি আমার ভালবাসা রয়েছে আর যদি সুযোগ হয়, তাহলে আমি আবার যেতে চাই।

 

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং জানিয়েছেন, গেল ৬০ বছরে চীন আফ্রিকা, এশিয়া, আমেরিকা, ইউরোপ ও ওশেনিয়ার ৭৬টি দেশ ও অঞ্চলে মোট ৩০ হাজার চিকিৎসা কর্মী পাঠিয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ৫৭টি দেশের ১১৫টি হাসপাতালে কাজ করছেন চীনা চিকিৎসা কর্মীরা এবং তাদের অধিকাংশই দুর্গম এবং কঠোর এলাকায় আছেন।

 

২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে গাম্বিয়ায় চীনা চিকিৎসা সহায়তা দলের সদস্য হিসেবে লি ইয়াং ৮২ বছর বয়সী একজন রোগীর জন্য পেসমেকার ইমপ্লান্টেশন সার্জারি করেছেন। এটাও গাম্বিয়ার ইতিহাসে প্রথম পেসমেকার ইমপ্লান্টেশন সার্জারি। গেল ৬০ বছরে চীনা চিকিৎসা দল আফ্রিকায় এরকম অনেক ‘প্রথম’ সৃষ্টি করেছে এবং স্থানীয়দের কাছে ‘চীনা ডাক্তার’ শব্দটি বিশ্বাস ও নির্ভরযোগ্যতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

 

গেল জানুয়ারি মাসে তানজানিয়ার একটি হাসপাতালের আইসিইউ কক্ষে রোগী এলসা সোয়াহিলি ভাষায় চীনা ডাক্তারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এটা ১৫ দিনে তার প্রথম কথা। দ্বিতীয় সন্তান জন্ম দেয়ার পর হঠাত্ করে এলসা চেতনা হারিয়েছেন। তানজানিয়ায় চীনা চিকিৎসা দলের ডাক্তার ওয়াং হেং এলসাকে চিকিৎসা দিয়েছেন। এলসার স্বামী চীনা ডাক্তারকে দেবদূত বলে ডাকেন।

 

আলজেরিয়ার একটি হাসপাতালে কিছু দিন আগে একজন নারী রোগী ২৭ বছর আগের একটি ছবি নিয়ে চীনা ডাক্তারের কাছে আসেন। তিনি জানিয়েছেন, ২৭ বছর আগে তৎকালীন চীনা চিকিৎসা সহায়তা দলের ডাক্তার তাকে চিকিৎসা দিয়েছেন

চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের উপাত্ত অনুযায়ী, গেল ৬০ বছরে বিদেশে চীনা ডাক্তারগণ মোট ২৯ কোটি জনকে চিকিৎসা দিয়েছেন, বিশেষ করে আফ্রিকায় চীনা ডাক্তারদের আন্তরিকতা ও পেশাদারিত্ব স্থানীয়দের সম্মান ও ভালবাসা অর্জন করেছে। ইথিওপিয়ার ছোট একটি গ্রামে একটি কবরস্থান আছে। সেটি সব সময় পরিষ্কার করা হয়। গত শতাব্দীর ৭০’র দশকে চীনা চিকিৎসা সহায়তা দলের প্রধান মেই কেং নিয়ান মহামারি এলাকায় যখন পরিদর্শন করেন, তখন দুর্ঘটনাজনিত কারণে সেখানে মারা যান। জিউডি ডাক্তার মেইর রোগী ও ভাল বন্ধু। মেই মারা যাবার পর জিউডি নিজের বাড়িতে তাকে দাফন করেন। তাকে তিনি রক্ষণাবেক্ষণ করেন। জিউডি মারা যাবার পর তার মেয়ে বাবার বদলে কবরস্থান রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বলেছেন, আমি ডাক্তার মেইর গল্প আরও বেশি মানুষদেরকে জানাব।

 

গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আমার দেশের জন্য চীনা ডাক্তারদের অবদান ও ভালবাসা আমরা দেখেছি এবং তাদেরকে অশেষ ধন্যবাদ জানাই।

 

নাম্বিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট বলেছেন, চীনা চিকিৎসা দল থেকে নাম্বিয়ার মানুষ অনেক উপকৃত হয়। চীনারা  পেশাদার, পরিশ্রমী ও নিবেদিত। তারা দু’দেশের মৈত্রীর সাক্ষী।

 

গত ষাট বছরে চীনা ডাক্তারগণ বেনিন, মধ্য আফ্রিকা, নিরক্ষীয় গিনিসহ নানা দেশের জাতীয় পদক অর্জন করেছেন। প্রতিটি পদক চীন-আফ্রিকা দৃঢ় মৈত্রীর প্রতীক। আফ্রিকায় চীনা ডাক্তারগণ যেমন প্রাণ উদ্ধার করার দেবদূত, তেমনি মৈত্রীর দূতও বটে। এখনও তারা আফ্রিকায় ভালবাসার কাহিনী রচনা করে চলছেন। (শিশির/এনাম)