সম্প্রতি চীনের বিভিন্ন প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে হাতে ব্রেসলেট রাখার প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। তারা, এই ব্রেসলেট হাতের আঙুল দিয়ে নিয়মিত ঘোরায়। অনেকে বিশ্বাস করেন, এতে মানসিক চাপ কমে। সাধারণত চীনা পুরুষদের হাতে এমন ব্রেসলেট দেখা যায়। বিশেষ করে যারা একটু বয়স্ক, তারা ভালো কাঠ বা পাথরের ঘুটি দিয়ে তৈরি ব্রেসলেট হাতে রাখেন ও সবসময় সেটি ঘোরাতে থাকেন। কিন্তু চীনা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এমনটা একটু আশ্চর্যজনক।
চীনের হ্যনান টেলিভিশনের একটি ভিডিও অনুষ্ঠানে দেখা যায় যে, হাতে বহুবর্ণ পাথরের ঘুটি দিয়ে তৈরি ব্রেসলেট রাখা ও তা তসবিহর মতো ঘোরানো স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কেন ব্রেসলেট হাতে রাখা হয়? এ সম্পর্কে তারা বলল, ‘আমাদের আশেপাশের ছাত্রছাত্রীরা সবাই ব্রেসলেট হাতে রাখে। এখন এটা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।’
প্রাথমিক স্কুলের অনেক ছাত্রছাত্রী বলছে, ব্রেসলেট হাতে রাখা ও সেটা হাতের আঙুল দিয়ে ঘোরানো অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। অনেকে ক্লাস চলাকালেও ব্রেসলেট হাতে রাখে ও তা নিয়ে খেলতে থাকে। কেন এ কাজ হঠাত্ জনপ্রিয় হয়েছে? শিক্ষার্থীদের জবাব: ব্রেসলেট নিয়ে খেলার সময় এক ধরনের মৃদু শব্দ হয়, যা মানসিক চাপ কমিয়ে দেয়। এতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার চাপ অনেকটা কম অনুভব করে।
অনেক পিতামাতার দৃষ্টিতে বাচ্চাদের এহেন আচরণ আশ্চর্যজনক। কারণ, বয়স্ক বা প্রবীণরা ব্রেসলেট হাতে রাখেন—এমনটাই তাঁরা এতোদিন দেখে এসেছেন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ অভ্যাস গড়ে উঠছে দেখে, অনেকেই তাই অবাক।
প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের হাতে ব্রেসলেট নিয়ে খেলার বিষয়টি ইন্টারনেটেও ব্যাপক আলোচিত হয়েছে ও হচ্ছে। নেজিটনরা বলছেন, বাচ্চারা স্কুল থেকে বিভিন্ন শখ সম্পর্কে জানতে পারে। কোনো নির্দিষ্ট একটি শখ নিয়ে তারা খুব বেশিদিন ব্যস্তও থাকে না। এ থেকে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের কাছে কোন কাজটা বেশি পছন্দের, কোনটা নয়।
এ সম্পর্কে ভিন্ন মহলের লোক ভিন্ন মতামত প্রকাশ করছেন। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্রেসলেট হাতে রেখে ঘোরানো থেকে খানিকটা বিনোদন হয়তো পাওয়া যায়, কিন্তু এটা বাচ্চাদের জন্য খানিকটা ঝুঁকিপূর্ণ। যেমন, ব্রেসলেট খুলে পাথর বা কাঠের পুঁতি বের হয়ে যেতে পারে এবং শিশুরা মনের অজান্তে দু’একটা খেয়ে ফেলতে পারে, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর। তা ছাড়া, ব্রেসলেট নিয়ে খেলা ক্লাসে তাদের পড়াশোনায় মনোযোগও কমিয়ে দিতে পারে।
এক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ, পিতামাতা ও শিক্ষকদের উচিত বাচ্চাদের ব্রেসলেট খেলার ওপর নজর রাখা। তারা হাতে সঠিকভাবে ব্রেসলেট ধরছে কি না, সেটা খেয়াল রাখতে হবে; এভাবে দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব। অন্যদিকে, ব্রেসলেট নিয়ে খেলার সময় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, যাতে স্বাভাবিক জীবনযাপন ও পড়াশোনার জন্য পর্যাপ্ত সময় নিশ্চিত করা যায়।
চীনের শানতুং প্রদেশের রাজধানী চিনান শহরের একটি হাসপাতালের ডাক্তার লু লিয়াং বলেন, বাচ্চাদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করলে, এটা ঠিক না। বিশেষ করে, দীর্ঘকাল ধরে ব্রেসলেট হাতে রাখলে বাচ্চাদের আঙুলের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
মানসিক পরামর্শদাতা ও পারিবারিক শিক্ষার প্রশিক্ষক লিউ ইয়াং মনে করেন, ব্রেসলেট ধরে খেলার সাথে মোবাইল ফোনে আসক্তির মিল আছে। কোনো কোনো বাচ্চা কম্পিউটার গেমস খেলে বাস্তব দুনিয়ার চাপ থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু সেটা যখন সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখনই বিপদ। সংশ্লিষ্ট পিতামাতার উচিত বাচ্চাদের যে-কোনো অভ্যাসের ওপর কড়া নজর রাখা।
তিনি মনে করেন, বাচ্চাদের ব্রেসলেট খেলার সাথে বড়দের খেলার কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। বাচ্চাদের কাছে এটি কেবল মানসিক চাপ কমানোর একটি পদ্ধতি। তারা ব্রেসলেটের দাম ও মানের ওপর খুব একটা মনোযোগ দেয় না। এ ব্যাপারে শিক্ষক ও পিতামাতা তাদের পরামর্শ দিতে পারেন। স্কুলের ক্লাসে সবার জন্য একটি নিয়ম করতে হবে যে, শিক্ষক যখন পড়াবেন তখন ব্রেসলেট ব্যাগে রাখতে হবে, হাতে রাখা চলবে না।
ফ্যাশনেবল ব্রেসলেট ছাড়া বর্তমানে চীনা প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে কার্টুনের স্টিকার, মোমের সীল এবং ছবি আঁকার নোটবুক বেশ জনপ্রিয়। বাচ্চারা কার্টুন স্টিকার ব্যবহার করে নিজের নোটবুক আর বইসহ বিভিন্ন স্টেশনারি সাজায়। এ কাজ চীনা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয়। একটি নোটবুক সাজানো শেষ করে তারা খুশি হয়।
মোমের সীল হল আরেকটি সৃজনশীল খেলা। জ্বলন্ত মোমবাতি থেকে সৃষ্ট গলিত মোম দিয়ে বিভিন্ন জিনিস তৈরি করা যায়। মোমবাতি গলার দৃশ্যটাও বাচ্চাদের কাছে আকর্ষণীয় একটি ব্যাপার।
ছবি আঁকার নোটবুক এখন চীনা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় একটি খেলা। সেটি জাপান থেকে সারা বিশ্বের বাচ্চাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক বাচ্চা তাদের নোটবুকে প্রতিদিনের স্মৃতি ও অনুভূতি নিয়ে ছবি আঁকে এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা রচনা করে। এমন নোটবুকের সাদা এলাকায় বিভিন্ন ধরনের সুন্দর স্টিকার লাগানো হয়। তবে, এমন নোটবুকের দাম সাধারণ নোটবুকের চেয়ে বেশি।
আগেই বলেছি, লেখাপড়ার সময় অনেক বাচ্চা মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। বস্তুত, এটি কেবল বাচ্চাদের সমস্যা নয়, বরং বড়দের জন্য আরও বড় সমস্যা। তাদের ওপর জীবনের চাপ অনেক বেশি। প্রত্যেকটি মানুষ কোনো-না-কোনোভাবে মানসিক চাপের সম্মুখীন হয়। তাই চাপ কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে হবে।
মানসিক চাপ কমানোর জন্য হালকা সংগীত শোনা যেতে পারে। হালকা ও ধীর লয়ের সংগীতের সুর মন শান্ত করে। একটি সুন্দর কনসার্ট শোনাও বেশ আরামদায়ক ব্যাপার। আর যে নিজেই গান গাইতে পারে, সে গুন গুন করে মানসিক চাপ কমাতে পারে।
জীবনে বিভিন্ন ধরনের ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয় আমাদেরকে। এসব ঝামেলা মোকাবিলায় আত্মবিশ্বাস থাকা জরুরি। যদি কেউ নিজেকে বিশ্বাস করতে না পারে, তাহলে মনের চাপ তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে। আর এ ধরনের চাপ দীর্ঘকাল থাকলে মানুষ মানসিক রোগে আক্রান্ত হবে।
ঘনিষ্ঠ বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনদের সাথে মনের দুঃখ শেয়ার করাও মানসিক চাপ কমানোর একটি ভালো উপায়। নিজের কষ্টের কথা প্রিয়জনকে বললে, আরামবোধ হয়। কথায় বলে, আনন্দ ভাগ করলে বাড়ে, আর দুঃখ ভাগ করলে কমে।
প্রতিদিনের কাজের ব্যস্ততা মানুষের জীবনের বাস্তবতা। কিন্তু প্রতিদিনের ব্যস্ততাশেষে বাড়িতে ফিরে স্বজনদের সাথে মিলিত হলে সারাদিনের ব্যস্ততার ক্লান্তি সাধারণত দূর হয়ে যায়। তবে, এর জন্য চাই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে মধুর সুসম্পর্ক।
ছুটিতে কোথাও বেড়াতে যাওয়া মানসিক চাপ কমানোর একটি ভালো উপায়। সুন্দর দৃশ্য ও পর্যাপ্ত অক্সিজেনসমৃদ্ধ একটি জায়গা মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করবে নিঃসন্দেহে। এ ধরনের পরিবেশ শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য কল্যাণকর।
সুস্বাদু খাবার খাওয়ার মাধ্যমেও মানসিক চাপ কমানো যায়। যদি কোনো কারণে মন খারাপ হয়, তখন ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সাথে নিয়ে সুস্বাদু বা নিজের পছন্দের খাবার খাওয়া যেতে পারে। এতে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। তবে, অতিরিক্ত খাওয়া যে স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ—তা মনে রাখতে হবে।
(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)