এপ্রিল ১৩: একদা ইউরোপীয় কাউন্সিলের প্রাক্তন সভাপতি ডোনাল্ড টাস্ক প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো বন্ধু থাকলে, কার শত্রু দরকার?’ তাঁর সেই প্রশ্ন আবারও আলোচনায় এনেছে সর্বশেষ ফাঁস হওয়া মার্কিন ‘গোপন নথি’।
মার্চ মাসের শুরু থেকে বা তারও আগে খুবই গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত মার্কিন সামরিক গোয়েন্দা নথি একের পর এক ইন্টারনেটে ফাঁস হয়েছে। এসব নথি রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে মার্কিন সরকারের গভীর সম্পৃক্ততা এবং ইউক্রেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ওপর নিবিড় নজরদারির কথা ফাঁস করে দিয়েছে। এক মাসেরও বেশি সময় প্রচারের পর এ ঘটনা পেন্টাগনের ‘লিক গেট’ হিসেবে সারা বিশ্বের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে, যা ২০১৩ সালে উইকিলিকসের গোপন তথ্য ফাঁসের পর সবচেয়ে গুরুতর ঘটনা।
স্থানীয় সময় গত ১১ এপ্রিল মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন প্রথমবারের মতো ‘লিক গেট’ নিয়ে মন্তব্য করে বলেন, তিনি গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসের এক মাস পর জানতে পেরেছেন। মার্কিন কর্তৃপক্ষ এসব তথ্য প্রকাশকারীদের খুঁজে বের করার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর কথা বলেছে। তাদের এ আচরণ পরোক্ষভাবে এসব গোয়েন্দা তথ্যের সত্যতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ওপর গোয়েন্দা তথ্যের প্রাণঘাতী প্রভাব স্বীকারের সমান।
কয়েক দশক ধরে মিত্রদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বিচার পর্যবেক্ষণ হলো ওপেন সিক্রেট। তবে, সর্বশেষ গোপন তথ্য লিক হওয়ার ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের মনে আঘাত হেনেছে। যেমন, প্রকাশিত নথিপত্রে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সংঘর্ষের খুঁটিনাটি বিষয় আছে, ইউক্রেনের বাহিনীর বসন্তকালের আক্রমণ চালানোর পরিকল্পনা, ইউক্রেনকে পশ্চিমা দেশগুলোর সাহায্য, অস্ত্র হস্তান্তর ইত্যাদি বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত। তা ছাড়া, নথিতে দেখানো হয়, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কি’র ওপর সার্বিক নজরদারি করে। শুধু তাই নয়, ইসরাইলের বিচার বিভাগীয় সংস্কার এবং ইউক্রেনকে ধ্বংসের অস্ত্র দেওয়া বা না দেওয়া সংক্রান্ত দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তাদের গোপন আলোচনা যুক্তরাষ্ট্রের পর্যবেক্ষণের অধীনে ছিল।
এসব তথ্য থেকে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সংঘর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের গভীর সম্পৃক্তা এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার ইচ্ছা বোঝা যায়। যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রসহ কোনো একটি দেশকেও বিশ্বাস করে না। মিত্র দেশগুলোর নেতা বা যুদ্ধের পরিবর্তন, যাই হোক, তারাই যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বাস্তবায়নের হাতিয়ার।
যুক্তরাষ্ট্র কেন নজরদারিতে এত আচ্ছন্ন? ইতিহাস থেকে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যবাদী চিন্তাধারায় মিত্রদের কোনো বাস্তব ধারণা ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স অ্যাজেন্সির (সিআইএ) সাবেক বিশ্লেষক রায়মোন্ড ম্যাকগোওয়ান যেমন বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তথা মিত্ররা আসলে তার দালাল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধ বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে যুক্তরাষ্ট্র অন্যদের ওপর নজরদারি শুরু করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদেরকে নিরাপত্তা এবং আর্থিক সাহায্য প্রদান করার দাবি করেছিলো। তবে সময় পার হওয়ার সাথে সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবাজ প্রকৃতি এবং আধিপত্যের আচরণ মিত্রদের স্বার্থের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠে।
মিত্রদের মধ্যে যারা খুব বাধ্য নয়, তাদের সম্মুখীন হয়ে নিরঙ্কুশ নিরাপত্তার স্বার্থপরতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র মিত্রদের প্রতি নিয়ন্ত্রণের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই নজরদারি আস্তে আস্তে এক ধরনের প্রয়োজনীয় পদ্ধতি হয়ে উঠেছে।
তা ছাড়া, নজরদারিও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক হাত দিয়ে আকাশ ঢেকে সারা বিশ্বে মুনাফা অর্জনের একটি মাধ্যম। ইউএস সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির প্রাক্তন পরিচালক জেমস উলসি স্বীকার করেছেন, প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে ইউরোপীয় এয়ারবাস গ্রুপ থেকে সৌদি আরবের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্ডার জিততে বোয়িংকে সাহায্য করেছে সিআইএ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের সঙ্গে জঘন্য আচরণ করেছে, সেগুলোর মধ্যে কেবল পর্যবেক্ষণ? বাস্তবতা প্রমাণ করেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তববাদ এবং সব কিছুকে ছাপিয়ে যাওয়া ‘আত্মকেন্দ্রিকতার’ মুখে বন্ধুত্বের নৌকাটি যে কোনো সময় উল্টে যেতে পারে। দেশটির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র হওয়া আরও মারাত্মক।’
লিলি/এনাম