অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রসঙ্গে
2023-04-10 14:34:50

অটিজম একটি রোগবিশেষ, যা মানুষের মস্তিষ্কের বিকাশের সাথে জড়িত। পরিসংখ্যান অনুসারে, বিশ্বের প্রতি ১০০টি শিশুর মধ্যে একজনের অটিজমে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণভাবে, শৈশবেই শিশুর মধ্যে অটিজমের বৈশিষ্ট্য সনাক্ত করা যায়। কিন্তু, অনেকসময় অনেক পরেও অটিজমের উপসর্গ শিশুর মধ্যে দেখা দিতে পারে। অটিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কর্মক্ষমতা ও চাহিদা সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের শিক্ষা ও যত্ন সম্পর্কে আলোচনা করবো।

 

৩৫ বছর বয়সের ম্যাডাম লিউ ওয়েনের হাতে একটি আপেল ধরা। তিনি ছেলে ইয়াং ইয়াংকে বারবার ‘আপেল’ শব্দটি উচ্চারণ করতে বলছেন। কিন্তু, ইয়াং ইয়াং তাঁর কথায় কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। ইয়াং ইয়াং অটিজমে আক্রান্ত।

 

ছোটবেলা থেকে ইয়াং ইয়াংয়ের সাথে অন্যান্য শিশুর পাথর্ক্য চোখে পরে। সে কোনো কথা বলে না, বাবা-মাকে ডাকে না, কেউ তাকে নাম ধরে ডাকলে সাড়া দেয় না। শৈশব থেকেই অটিজমের রোগী হিসেবে চিহ্নিত ইয়াং ইয়াং।

 

গত দোসরা এপ্রিল ছিল বিশ্ব অটিজম দিবস। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, বর্তমানে চীনে অটিজমে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এক কোটিরও বেশি এবং তাদের মধ্যে ২০ লাখ শিশু। প্রতিটি অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চার পিছনে আছে একটি পরিবার। পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে পিতামাতা অটিজমে আক্রান্ত শিশুর পেছনে অনেক সময় ব্যয় করেন, তাদের ভবিষ্যতের জীবনকে যথাসম্ভব সুখের করার আপ্রাণ চেষ্টা চালান।

 

ইয়াং ইয়াংয়ের জন্ম তাঁর পরিবারে আনন্দের বন্যা বইয়ে দিয়েছিল। সবাই অনেক খুশি হয়েছিলেন। ধীরে ধীরে ইয়াং ইয়াং বড় হতে থাকে। কিন্তু তার অবস্থা ও চলাফেলা অন্যান্য বাচ্চার সাথে মেলে না। পিতামাতা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। ডাক্তার দেখেশুনে, চেকআপ করার পর জানান, ইয়াং ইয়াং অটিজমে আক্রান্ত। মা লিউ ওয়েন এ কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারেননি।

পরে, ইয়াং ইয়াংয়ের ভালো যত্ন নেওয়ার জন্য লিউ ওয়েন চাকরি ছেড়ে দেন এবং প্রতিদিন ইয়াং ইয়াংকে নিয়ে ছোংছিং মহানগরের নার্সিং স্কুলে সংশ্লিষ্ট চিকিত্সা ও প্রশিক্ষণ ক্লাসে যেতে শুরু করেন। এ প্রশিক্ষণ ক্লাসে চিকিত্সক মুখে প্রতিটি শব্দ বলার সময় সংশ্লিষ্ট ভঙ্গি করেন। এভাবে অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের অনেকেই তাঁর কথা বুঝতে পারে। তবে, ইয়াং ইয়াংয়ের মতো অনেক বাচ্চা তাঁর বিভিন্ন ভঙ্গির বিপরীতে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না। প্রশিক্ষণ ক্লাসে যোগ দেওয়ার দুই মাস পরও ইয়াং ইয়াং কোনো কথা বলতে শেখেনি। এতে তার মা দুঃখে কান্নাকাটি করেন। তবে, তিনি ছেলেকে নিয়ে ক্লাসে যাওয়া বন্ধ করেননি। তিনি বলেন, “আমার ছেলে নিজের দুনিয়ায় থাকে। আমি তাকে বাইরের বিশ্বে টেনে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

 

ইয়াং ইয়াংয়ের প্রশিক্ষণের বিস্তারিত সময়সূচিও তিনি তৈরি করেন। প্রতিদিন যখন ঘরের কাজ করেন, তখন ইয়াং ইয়াংকে কিছু কাজ দেন। যেমন, তাকে শাকসবজি কাটতে শেখান এবং কাজ করার সময় তার সাথে কথা বলেই যান। প্রতিদিন ইয়াং ইয়াংকে নিয়ে বাইরে বেড়ানোর সময় অন্যদেরকে ‘হ্যালো’ বলা শেখাতে আপ্রাণ চেষ্টা করেন।

 

যখন ইয়াং ইয়াংয়ের বয়স ২ বছর ১০ মাস, তখন সে প্রথমবারের মতো ‘মা’ শব্দটি উচ্চারণ করে। শুনে তার মা লিউ ওয়েনের চোখে পানি আসে। গত বছরের ডিসেম্বরে ইয়াং ইয়াং কিন্ডারগার্টেনে ভর্তি হয়। এখন সে দু’একটা লম্বা বাক্য বলতে পারে। এ সুখবর ইয়াং ইয়াংয়ের নার্সিং ও প্রশিক্ষণ চিকিত্সকদের সাথে শেয়ার করেন ম্যাডাম লিউ ওয়েন।

 

ইয়াং ইয়াংয়ের চিকিত্সক ডাক্তার লি চেং এ খবর জেনে অনেক আনন্দিত হন। তিনি বলেন, অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের দীর্ঘকাল ধরে পুনর্বাসন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে হয় এবং তার বাবা-মায়ের দীর্ঘকালীন ও কার্যকর সঙ্গ প্রয়োজন হয়। এটি সংশ্লিষ্ট বাবা-মায়ের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

 

অনেক অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চার বাবা-মা মানসিক দিক দিয়ে  কঠিন সময় কাটান। তাদেরকে বাস্তবতা স্বীকার করতে হয় এবং সঠিকভাবে এ সমস্যা মোকাবিলার চেষ্টা করতে হয়। ৩৯ বছর বয়সী অটিজমের চিকিত্সক লি চেং অটিজমের চিকিত্সা ও অটিজমে আক্রান্তদের ভাষা নিয়ে গবেষণা করেন।

 

ডাক্তার লি’র দৃষ্টিতে, অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের বাবা-মাকে নিজেদের যত্নও নিতে হবে। তাদের সাথে বাচ্চাদের চিকিত্সা ও প্রশিক্ষণ নিয়ে কথাবার্তার সময় বাবা-মায়ের মানসিক অবস্থাও বিবেচনা করতে হবে। যদি কথা বেশ কঠোর হয়, তাহলে বাবা-মা সহজে তা গ্রহণ করতে পারবেন না, মনে আঘাত পাবেন। মানসিকভাবে তাদের শক্তিশালী রাখা অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের চিকিত্সার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

 

ডাক্তার লি’র স্মার্টফোনের কন্টাক্ট লিস্টে কয়েক শ অটিজমে আক্রান্ত শিশুর বাবা-মা রয়েছেন। তাদের মধ্যে অনেকে নিজের বাচ্চার অটিজমে আক্রান্ত হবার বাস্তবতা মেনে নিতে চান না।  কোনো কোনো পরিবারের দাদা-দাদী তাদের নাতি বা নাতনীর অটিজমে আক্রান্তের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জানেন না। এ সম্পর্কে ডাক্তার লি বলেন, বস্তুত অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের বাবা-মাকে এ রোগের ব্যাপারে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতে হবে। কারণ, অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের জন্য সবচেয়ে বড় অবলম্বন তাদের পিতামাতা।

 

তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, “আমার পরিচিত একটি ছেলের নাম পেইপেই। তখন তার বয়স ২ বছর। অটিজম সনাক্ত হওয়ার পর তার বাবা-মা তা বিশ্বাস করতে চান না। তারা ছেলেকে নিয়ে টানা ৩ বছর ধরে চীনের বিভিন্ন হাসপাতালে গেছেন, চিকিত্সা করিয়েছেন। কিন্তু ৩ বছরেও ছেলের অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। তখন তারা আবার আমার কাছে ফিরে আসেন। তখন পেইপেই-এর বয়স ৫ বছর। তার চিকিত্সার জন্য মূল্যবান ৩টি বছর নষ্ট হয়েছে, যা দুঃখজনক।”

 

গত কয়েক বছর ধরে চীনে অটিজমে আক্রান্ত বাচ্চাদের চিকিত্সার ওপর অনেক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। চীনের বিভিন্ন প্রদেশ ও এলাকার আবাসিক কমিউনিটির হাসপাতালে ৬ বছর বয়সের নিচের বাচ্চাদের অটিজমের পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রয়েছে।

 

স্ক্রিনিং ফর্মে বাচ্চাদের মানসিক আচরণগত সমস্যা নিয়ে কিছু সর্তকতামূলক বাক্য লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, ৩ মাসের বাচ্চা উচ্চ শব্দে প্রতিক্রিয়া দেখায় কি না, ৬ মাসের বাচ্চা হাত দিয়ে জিনিস ধরতে পারে কি না, ৪ বছর বয়সের বাচ্চা কথা বলতে পাবে কি না, ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের উত্তর যদি হয় না-বোধক, তাহলে বুঝতে হবে শিশু অটিজমে আক্রান্ত।

 

৩৩ বছর বয়সের চৌ পো গান গাইতে বেশ পছন্দ করেন। তিনি মনে করেন, সংগীতের কারণে তিনি সাধারণ জীবনের আনন্দ উপভোগ করছেন। তাঁর আন্তরিক ও আত্মবিশ্বাসী চরিত্র দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি একজন অটিজমে আক্রান্ত রোগী। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “আমি নানার কাছে বেশ কৃতজ্ঞ। কারণ, যখন আমি অটিজমের রোগী হিসেবে সনাক্ত হই, তখন তিনি আমার যত্ন নিতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।’ ১৯৯৮ সালে ৮ বছর বয়সের ছেলে চৌ পো-কে অটিজমের রোগী হিসেবে সনাক্ত করা হয়। তখন তাঁর বাবা-মা চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। ফলে, নানা তাঁকে দেখাশোনার দায়িত্ব বহন করেন।

 

নানার সাথে পাহাড়ে আরোহন করা, বাজারে শাকসবজি কেনা, এবং রান্নাবান্না শেখে চৌ পো। নানা কখনো তাকে একজন রোগী হিসেবে দেখেননি। ধীরে ধীরে নানার যত্নে চৌ পো বড় হয়। নানার ৮০তম জন্মদিনে সে টানা দুটি গান গেয়ে শোনায়। তখন পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, এ বাচ্চা সংগীতের খাতে তার বিশেষ দক্ষতাও রয়েছে। তখন থেকে ছেলে চৌ পো গানের বিশেষ ক্লাসে যেতে শুরু করে। নানার সাথে নিয়মিত সে বিভিন্ন কনসার্ট শুনতেও যায়।

 

এ সম্পর্কে তাঁর সংগীতের শিক্ষক বলেন, ছেলে চৌ পো যখন গান গায়, তখন সাধারণ বাচ্চাদের থেকে তাকে আলাদা করা মুশকিল। সে সংগীত থেকে আনন্দ পায়। ২০২২ সালে চৌ পো একজন গায়ক হিসেবে সংগীতের মঞ্চে দাঁড়ায়। তাঁর অভিজ্ঞতা স্মরণ করে চৌ পো বলেন, “আমার নানার কারণে সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটাচ্ছি আমি। সংগীত শেখার কারণে আমার জীবন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে।”

 

গান গাওয়া ছাড়া, ছেলে চৌ পো পিয়ানো বাজানো, ক্যালিগ্রাফি লেখা, বাস্কেটবল খেলা, সাঁতার কাটা শিখেছে। বলা যায়, সাধারণ মানুষের সাথে তার বেশি পার্থক্য নেই। বর্তমানে তাঁর জন্য অটিজম একটি ভয়াবহ রোগ নয়। কারণ, তাঁর পরিবারের সদস্যরা কখনো তাঁকে ত্যাগ করেনি, বরং ভালোবাসার সাথে তাঁর যত্ন নিয়েছে।

 

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)