বিজ্ঞানবিশ্ব:পর্ব ১৩
2023-04-10 14:57:04

চীনের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সাপ্তাহিক আয়োজন: বিজ্ঞানবিশ্ব

১৩তম পর্বে যা থাকছে:

* চাঁদে বিশাল পানির উৎস আবিষ্কার করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা

* বিদ্যুৎ উৎপাদনে সলিড হাইড্রোজেনের ব্যবহার

* গবেষকদের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করলো চীন

 

চাঁদে বিশাল পানির উৎস আবিষ্কার করেছেন চীনা বিজ্ঞানীরা

 

চাঁদে এক বিশাল পানির উৎস খুঁজে পেয়েছে চীনা বিজ্ঞানীরা। ধারণা করা হচ্ছে চাঁদে কাঁচের পুতির মতো দেখতে হাইড্রক্সিল রূপে জমাট বেঁধে আছে পানি। মহাকাশ মিশনে কোথাও পানির অস্তিত্ব পাওয়াকে অনেক বড় ঘটনা হিসেবে দেখা হয়। এই আবিষ্কারের মাধ্যমে চাঁদ থেকে পানি আহরণের নতুন সম্ভাবনার দ্বারও উন্মোচিত হলো।

গত সপ্তাহে নেচার জিয়োসায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে আসে এ তথ্য। সেখানে বলা হয়, চীনের চান্দ্র্য অনুসন্ধান অভিযানে অংশ নেওয়া মহাকাশযান ছাং’ই-ফাইভ চাঁদ থেকে যে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে এনেছে তাতে পানির অস্তিত্ব লক্ষ্য করা গেছে।

কাঁচের গোলাকার ছোট টুকরার মতো দেখতে হাইড্রক্সিল আকারে পানি পাওয়া গেছে নমুনায়। একটি অক্সিজেন পরমাণু ও একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর সংমিশ্রনে তৈরি হয় একটি হাইড্রক্সিল অণু। হাইড্রক্সিল আয়ন পানিতে পাওয়া সবচেয়ে সাধারণ আয়নগুলির মধ্যে একটি। গবেষকরা ধারণা করছেন চাঁদের বুকে এই হাইড্রক্সিলের উৎপত্তি ঘটেছে উল্কাপিন্ডের আঘাতের ফলে।

যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানীরা ভেবে এসেছেন চাঁদে কোনো পানির অস্তিত্ব নেই। তবে বিগত বছরগুলোতে চাঁদের মাটি যে পানি ধরে রাখতে পারে তার প্রমাণ পেয়েছে বিজ্ঞানীরা। কাঁচের পুতিগুলোতে খুব কম পরিমানে পানি থাকলেও গবেষকরা হিসেব করে বের করেছেন ২৭০ বিলিয়ন মেট্রিক টন পর্যন্ত পানি সঞ্চয় করার সক্ষমতা আছে চাঁদের মাটির।

চায়নিজ একাডেমি অব সায়েন্সেসের ইনস্টিটিউট অব জিয়োলজি এন্ড জিয়ো-ফিজিক্সের এক গবেষক হু সেন এই গবেষক দলের অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী। তিনি বলেন, তিনি তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না যখন সর্বপ্রথম টের পেলেন চাঁদের বুকে পানি আছে।

তিনি বলেন, “চাঁদের জন্য সম্ভাব্য ২৭০ বিলিয়ন মেট্রিক টন পানি ধারণ ক্ষমতা যথেষ্ট। যদিও এটি পৃথিবীর মহাসাগরের পানির পরিমাণের তুলনায় কিছুই নয়”।

এই গবেষকের মতে, গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলগুলো কেবল বায়ুমণ্ডল ছাড়া একটি গ্রহে বা উপগ্রহে জলের উৎস, সঞ্চয়স্থান ও পরিবহন সম্পর্কেই ধারণা দেয় না-বরং পৃথিবী ছাড়াও অন্য কোনো গ্রহকে মানব বাসস্থান হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনায় কাজে আসতে পারে। যদিও চন্দ্র পৃষ্ঠের নির্দিষ্ট পানির উৎস এখনো একটি রহস্য।

গবেষকরা বলছেন ভবিষ্যতের চন্দ্র অভিযানে সহায়তা করার জন্য হাইড্রোক্সিলের উপস্থিতি এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। তবে ঠিক কীভাবে এই হাইড্রক্সিলকে মহাকাশেই তরল জলে রূপান্তরিত করা সম্ভব হবে তা নিয়ে দরকার আরো বিস্তর গবেষণা।

 

|| প্রতিবেদন: আব্দুল্লাহ আল মামুন

|| সম্পাদনা: সাজিদ রাজু

 

বিদ্যুৎ উৎপাদনে সলিড হাইড্রোজেনের ব্যবহার

 

এই প্রথমবারের মতো চীনে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হলো সলিড হাইড্রোজেন। দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশ এবং চীনের ইউননান প্রদেশে নির্মাণ করা হয়েছে এমনই দুটি হাইড্রোজেন চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতের পরিবেশবান্ধব জ্বালানীখাতের একটি বড় অংশ দখলে নেবে হাইড্রোজেন থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ।

দীর্ঘ দিনের চেষ্টা ও সাধনার পর এবার প্রধান সঞ্চালন লাইনে যোগ হয়েছে হাইড্রোজেন জ্বালানী ব্যবহার করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ। হাইড্রোজেন গ্যাস নয়, বায়ুচাপে কঠিন বা সলিড আকার ধারণ করা হাইড্রোজেন ব্যবহার করা হয় বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে।

সম্প্রতি চায়না সাউদার্ন পাওয়ার গ্রিডের পরিচালনায় দুটি হাইড্রোজেন জ্বালানী থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রকে প্রধান গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। সলিড হাইড্রোজেন জ্বালানী ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ঘটনা চীনে এটাই প্রথম।

দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি দক্ষিণ চীনের কুয়াংতোং প্রদেশের কুয়াংচ শহরে। এখানে অবস্থিত চায়না সাউদার্ন পাওয়ার গ্রিডের জ্যেষ্ঠ গবেষক ছেং সিন জানান, এখানে সমস্ত কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ৭টি সলিড হাইড্রোজেন সংরক্ষণের সুযোগও আছে।

তিনি বলেন, “আমাদের এখানে যে কঠিন হাইড্রোজেন সংরক্ষণাগারটি আছে তার সক্ষমতা ২০০ বর্গ মিটার। পুরু ঘনত্বের হাইড্রোজেন এখানে সংরক্ষণ করা যায়। আমরা যদি সাধারণ মানের থ্রি-এমপিএ হাইড্রোজেন ট্যাংকও ব্যবহার করি তারপরও এর ধারণ ক্ষমতা ২০গুণ পর্যন্ত বাড়ানো যাবে।“

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সলিড হাইড্রোজেন ব্যবহার করা যেমন সহজ তেমনি সাশ্রয়ী। পাশাপাশি এটি কম পরিমাণে ব্যবহার করে পাওয়া যায় বেশি বিদ্যুৎ। হাইড্রোজেন রিসার্চ সেন্টারের ব্যবস্থাপক লেই চিনিয়ং বলেন, সলিড হাইড্রোজেন এক ধরনের রাসায়নিক এবং সূর্যের আলো, বাতাস বা অন্য যে কোন ধরনের নতুন জ্বালানীর মতোই একটি বিদ্যুতের উৎস।

তিনি বলেন, “হাইড্রোজেন ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন, এর সংরক্ষণ ও পুনরায় জ্বালানী সরবরাহ করার মতো কাজ করার সক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে এই স্টেশনটি পরিবেশবান্ধব জ্বালানী ও পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেনের একটি রূপান্তরের পর্যায়ে আছে। এর মাধ্যমে নির্ভরশীলতার যে সংকট ও বিভিন্ন সময়ে বিদ্যুৎ ঘাটতির যে সংকট তৈরি হয় তা সমাধান করা যাবে।“

সলিড হাইড্রোজেন ব্যবহার করে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সংরক্ষণ করা যবে এবং প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যাবে বলে জানান বিজ্ঞানীরা। চাইনিজ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের শিক্ষক ওয়াং চেংশান বলেন, নতুন ধরনের এই জ্বালানী উৎস আরও জোরালোভাবে ব্যবহারের উপযোগিতা পরীক্ষা করে দেখছেন তারা।

তিনি বলেন, “ভবিষ্যতে জ্বালানী খাতের একটি বড় অংশ দখল করে নেবে এই হাইড্রাজেন থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ। বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব হাইড্রোজেন ব্যবহারের হার বাড়বে। ইলেক্ট্রো-হাইড্রোজেন কাপলিং প্রযুক্তি হতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের স্বাক্ষী।“

সলিড হাইড্রোজেন চালিত দ্বিতীয় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি স্থাপন করা হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের ইউননান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং শহরে। এই কেন্দ্র থেকে এরই মধ্যে এই কেন্দ্রে ১৬৫ কিলোগ্রাম সলিড হাইড্রোজেন ব্যবহার করা হয়েছে। এখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় ২৩শ’ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।

 

|| প্রতিবেদন: সাজিদ রাজু

 

গবেষকদের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করলো চীন

সারা বিশ্বের গবেষকদের জন্য নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে চায়না এ্যডভ্যান্সড রিসার্চ রিঅ্যাকটর। এটোমিক এনার্জি বা আণবিক শক্তির জগতে গবেষণা আরও এগিয়ে নিতে বিদেশী গবেষকদের প্রতি আহবান জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা।

অ্যারো-ইঞ্জিন ব্লেডের গবেষণা, উচ্চ-গতির রেল চাকার পরীক্ষা এবং এমনকি বহু আগের হান রাজবংশের প্রাচীন শিল্পকর্ম নিয়ে কাজ করছেন চীনের উন্নত গবেষণা চুল্লির বিজ্ঞানীরা।

এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির অবস্থান চীনের এটোমিক এনার্জি ইন্সটিটিউটের প্রজেক্ট এরিয়ার ভেতরে। পারমাণবিক বিজ্ঞান এবং নিউট্রনের গবেষণা উন্নয়নে ভালো অগ্রগতি নিয়ে এসেছে এই প্রতিষ্ঠান। 

চীনের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ও অগ্রগতি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার করপোরেশনের প্রধান বিশেষজ্ঞ ছেং তংফেং।

তিনি বলেন, “এই চুল্লির উদ্দেশ্য হলো দেশের বিভিন্ন পর্যায়ে পারমাণবিক গবেষণায় সর্বোচ্চ সহযোগিতা করা। এর পাশাপাশি মহাকাশ, বিমান চালনা এবং পরিবহন শিল্পে চলমান প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করে সহজ সমাধান এনে দেওয়া”।

এই চুল্লিটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য নিউট্রনও তৈরি করে। নিউট্রনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করার জন্য চীনা পৌরাণিক চরিত্র মাঙ্কি কিংয়ের উদাহরণ টেনেছেন চায়না ইনস্টিটিউট অব অ্যাটমিক এনার্জির রিসার্চ ফেলো হাও লিচি।

তিনি বলেন, "নিউট্রনগুলো অনেকটা চীনের পৌরাণিক চরিত্র মাঙ্কি কিংয়ের মতো। তার বিচক্ষণ চোখের মতো কোন কঠিন পদার্থের ভেতর ঢুকে যাওয়ার প্রবল শক্তি রয়েছে নিউট্রনের। এগুলো ধাতব পদার্থের মধ্য দিয়ে যেতে পারে এবং সব ধরণের পুরু পদার্থের অভ্যন্তরীণ ত্রুটিগুলি শনাক্ত করতে পারে। সাধারণত অন্যান্য বিকিরণ রশ্মির পক্ষে এ ধরনের জটিল কাজ করা সম্ভব নয়।”

চায়না ইনস্টিটিউট অব অ্যাটমিক এনার্জির পার্টি কমিটির সেক্রেটারি সুয়ে সিয়াওকং বলেন, গেল বছর চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার কর্পোরেশন বর্তমানের চাহিদা মেটাতে পুরনো চুল্লির সংস্কার করেছেন।

তিনি বলেন, “এ বছর আমাদের লক্ষ্য হলো চুল্লিটি ১০০ দিনের বেশি সময় ধরে চালু রাখা। আগামীবছর এ সময়সীমা ২০০ থেকে ২৫০ দিনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি আমরা। এই গবেষণাকে এগিয়ে নিতে যেকোন ভাল প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতা নেয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। একইসঙ্গে যেকোন বিদেশী গবেষক আমাদের এখানে এসে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যক্রম পরিদর্শন করতে পারবেন।”

অ্যাটমিক এনার্জি, মহাকাশ গবেষণা, পেট্রোলিয়ামসহ আধুনিক শিল্পের নানান খাতে কাজ করার জন্য এরইমধ্যে ৪০টিরও বেশি প্রস্তাব পেয়েছে এই প্রতিষ্ঠান।

২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ৫০টির মতো প্রতিষ্ঠানে সীমিত পরিসরে গবেষণা কাজ চালিয়ে আসছে চায়না এ্যডভ্যান্সড রিসার্চ রিঅ্যাকটর। সব মিলিয়ে এ ধরনের জটিল ধরনের কাজ সফলতার সঙ্গে এগিয়ে নেয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছে চীনের এই গবেষণা প্রতিষ্ঠান।

 

|| প্রতিবেদন: হাবিবুর রহমান অভি

|| সম্পাদনা: সাজিদ রাজু

 

অনুষ্ঠান কেমন লাগছে আপনাদের তা আমাদের জানাতে পারেন facebook.com/CMGbangla পেজে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক ভিডিও প্রতিবেদন দেখতে ভিজিট করতে পারেন আমাদের ইউটিউব চ্যানেল CMG Bangla।

 

পরিকল্পনা, প্রযোজনা ও অডিও সম্পাদনা- আব্দুল্লাহ আল মামুন

 

স্ক্রিপ্ট সম্পাদনা: সাজিদ রাজু

 

সার্বিক তত্ত্বাবধান- ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী