‘প্রবৃদ্ধি পুনরুজ্জীবিত করা’ শিরোনামে এশিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য এপ্রিল, ২০২৩-এর অর্থনৈতিক আপডেটে বিশ্বব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে যে উন্নত দেশগুলোর অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির অনুমিত মন্দা চীনের অর্থনীতিতে পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্মণ দ্বারা অনেকাংশে পূরণ করা যেতে পারে।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান এবং বিশ্বের বহুজাতিক করপোরেশনগুলোর প্রধানরা একের পর এক চীন সফর করছেন। এর মধ্য দিয়ে এটি প্রতিফলিত হয় যে আন্তর্জাতিক মহল বিশ্বব্যাংকের এ পূর্বাভাসকে সত্য বলে মানছেন। তারা এটাও মানছেন যে, চীন এবং এর বাজার এখন আর একটি বিকল্প মাত্র নয়, বরং একটি প্রয়োজন।
গত ৫ এপ্রিল চীন সফরে আসেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। তার সঙ্গে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লেইন এবং বড় একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদল ছিল। তাদের এ সফরে অন্যান্য ইস্যুর পাশাপ্যাশি স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক ইস্যুটি সবিশেষ গুরুত্ব পায়।
প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে ফরাসি প্রেসিডেন্টের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক সব বৈঠকে অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রসঙ্গটি জোরালোভাবে এসেছে এবং উভয়পক্ষ এ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করতে সম্মত হয়েছে। ফ্রান্সকে চীনা বাজারে প্রবেশে আরও বেশি সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট সি। এতে করে ফ্রান্স তথা ইইউ’র সঙ্গেই চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরালো হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ম্যাক্রোঁর চীন সফরের মধ্যেই বেইজিংয়ে চীন-ফরাসি উদ্যোক্তা কমিটির পঞ্চম সভা অনুষ্ঠিত হয়। চীন ও ফ্রান্সের শতাধিক ব্যবসায়িক প্রতিনিধি এতে যোগ দেন। তাঁরা বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে সহযোগিতার বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তাঁরা চীন-ফরাসি আর্থ-বাণিজ্যিক সহযোগিতা আরও গভীর করার বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন।
অংশগ্রহণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিবর্গ বলেন, তারা চীন-ফরাসি উদ্যোক্তা কমিটির সংলাপের প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে চীনের উচ্চ-মানের উন্নয়নের নতুন সুযোগ কাজে লাগাবেন, যৌথভাবে চীন-ফরাসি এবং চীন-ইউরোপীয় শিল্প ও সরবরাহ চেইনের স্থিতিশীলতা ও মসৃণতা বজায় রাখবেন এবং পারমাণবিক শক্তি, বিমান চালনা, ফার্মাসিউটিক্যালস, ফিনান্স, উদ্ভাবন, ব্যবহার, নতুন শক্তি, রেল ট্রানজিট এবং পারস্পরিক উপকারী সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো আরও গভীর করার চেষ্টা করবেন।
দুই প্রেসিডেন্ট অধিবেশনের সমাপনী অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন।
ভাষণে সি চিন পিং বলেন, দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ও পারস্পরিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বড় প্রকল্পে সহযোগিতা গভীর হয়েছে এবং সবুজ জ্বালানি ও প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনসহ আরও নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা সম্প্রসারিত হয়েছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ৫ বছরে চীন-ফরাসি বাণিজ্যের পরিমাণ ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে।
সি চিন পিং বলেন, সবার উচিত উন্মুক্তকরণ ও সহনশীলতা বজায় রেখে দ্বিপাক্ষিক কল্যাণের সহযোগিতা গভীর করা। চীন অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারণের পাশাপাশি উচ্চ মানের উন্মুক্তকরণ বেগবান করবে এবং নীতি, বিধি, প্রশাসন ও মানদণ্ডসহ নানা ব্যবস্থাগত উন্মুক্তকরণ সম্প্রসারণ করবে।
প্রেসিডেন্ট সি আরও বলেন, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে চীনা বৈশিষ্ট্যময় আধুনিকায়ন সৃষ্ট নতুন সুযোগ শেয়ার করতে চায় বেইজিং। ফরাসি প্রতিষ্ঠানগুলোকে চীন আন্তর্জাতিক আমদানি মেলা, চীন আন্তর্জাতিক পরিষেবা বাণিজ্য মেলা এবং চীন আন্তর্জাতিক ভোগ্যপণ্য মেলাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে চীনা বাজারে প্রবেশে আরও বেশি সমর্থন দেবে চীন।
এর আগে ফরাসি প্রসাধনী জায়ান্ট ল'রিয়ালের প্রধান নির্বাহী নিকোলাস হিয়েরোনিমাস গত মাসে চীন সফর করেন। তিনি ফরাসি দৈনিক লা ফিগারোকে বলেছেন, চীনে ভোগব্যয় ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে, এতে ভালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তিনি চীনে খুব শক্তিশালী একটি বাজারের প্রত্যাশা নিয়ে ফিরে যান।
জার্মান ইকোনমিক ইনস্টিটিউট রিপোর্ট অনুসারে, ইউরোপের আরেকটি প্রধান অর্থনীতি জার্মানির কর্পোরেশনগুলো ২০২২ সালে চীনে রেকর্ড ১১.৫ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করেছে। জার্মান নির্বাহীদের জন্য, চীনের বাজারে বিক্রি বাড়ার সম্ভাবনা খুবই আকর্ষণীয়।
ইতালি ও গ্রিস পর্যটন-বাণিজ্যে ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল চীনা পর্যটকদের ওপর। ২০১৯ সালে, মোট আন্তর্জাতিক আগমনের নিরিখে চীন ছিল ইতালির জন্য ১১তম বাজার। আর গ্রিসের পর্যটন শিল্প তার মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশের জন্য চীনা পর্যটক ও স্থানীয় পর্যটন স্টেকহোল্ডারদের পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল।
২০২২ সালে, চীন-ইইউ বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা স্থিতিস্থাপক এবং গতিশীল ছিল। চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পণ্যের মোট দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মূল্য ছিল ৫ হাজার ৬৬৪ বিলিয়ন ইউয়ান বা ৮২১ বিলিয়ন ডলারের বেশি। যা আগের বছরের চেয়ে ৫.৬ শতাংশ বেড়েছে।
আশা করা যায় সাম্প্রতিক উদ্যোগে ফ্রান্সসহ গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেই চীনের অর্থনৈতিক সহযোগিতা আরও গতি পাবে এবং তা ইইউসহ গোটা বিশ্বের অর্থনেতিক পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখবে।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।