দেহঘড়ি পর্ব-০১৩
2023-04-09 14:48:16

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে স্বাস্থ্যবিষয়ক সুখবর, ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’ এবং চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’।

 

#সুখবর

টিসিএমের উন্নয়নে চীনের বড় পরিকল্পনা

ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমের পুনরুজ্জীবন ও উন্নয়নে একটি বৃহৎ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে চীন। এ পরিকল্পনায় টিসিএম স্বাস্থ্যসেবা প্রসারিত করা, চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণের সুযোগ বাড়ানো, এ ক্ষেত্রে উদ্ভাবন বেগবান করা এবং টিসিএমের সঙ্গে পশ্চিমা ওষুধের সমন্বয় এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে এ সম্পর্কে এক সার্কুলার প্রকাশ করে চীন সরকার।

টিসিএম সম্পর্কিত জাতীয় প্রশাসন ৩ মার্চ ওই সার্কুলারের ব্যাখ্যা দিয়ে এক বিবৃতি প্রকাশ করে, যাতে বলা হয়, "কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিসিএম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে … এবং এর বিকাশ একটি কৌশলগত পর্যায়ে প্রবেশ করেছে।… তবে কিছু জরুরী সমস্যা রয়ে গেছে, যেমন পদ্ধতিগত কর্মসূচির ঘাটতি এবং টিসিএমকেন্দ্রিক প্ল্যাটফর্ম।"

জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশনের সামাজিক উন্নয়ন ব্যুরোর উপ-পরিচালক সুন চিছাং জানান, টিসিএম-সংক্রান্ত প্রকল্প বাস্তবায়নে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ে বাস্তবায়িত ১৩তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার কাল থেকে প্রায় ৫ হাজার কোটি ইউয়ান (বা ৭২৮ কোটি মার্কিন ডলার) ব্যয় করেছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত ছিল ৬৭০টি কাউন্টি-স্তরের টিসিএম ক্লিনিকের অবকাঠামো ও সুযোগ-সুবিধা উন্নত করার প্রকল্প। এছাড়া ১৯টি টিসিএম বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য আরও ১২০ কোটি ইউয়ান বিনিয়োগ করা হয়েছে।

গত ২২ মার্চ কুয়াংতুং প্রদেশের শেনজেনে অনুষ্ঠিত এক ফোরামে তিনি বলেন, টিসিএম বা এই বিষয়ে স্নাতক বা উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা ২০১৫ সালে যেখানে ৩২ হাজার ছিল, সেখানে ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৬ হাজারে।

সুন চিছাং বলেন, "তবে আমরা উদ্ভাবন ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাসহ বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছি। নিবন্ধন ও অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে, এমন নতুন টিসিএম ওষুধের সংখ্যা বছরের পর বছর ধরে নিম্ন পর্যায়ে রয়ে গেছে। দেশীয় টিসিএম কোম্পানিগুলো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যে অর্থ সাধারণত বিনিয়োগ করে তা অপর্যাপ্ত এবং তারা টিসিএম পণ্যগুলোর প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগও দেয় না।"

তিনি বলেন, এর ফলে টিসিএম কোম্পানিগুলোর আয় কমে গেছে। তার হিসাব মতে, এ কোম্পানিগুলোর মোট আয় ২০১৫ সালে যেখানে ছিল ৭৮ হাজার কোটি ইউয়ান, সেখানে ২০১৯ সালে তা কমে দাঁড়ায় ৬৫ হাজার কোটি ইউয়ানে।

সুন আরও বলেন, অনেক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের পশ্চিমা ওষুধের সঙ্গে টিসিএমের সমন্বয়ের তাত্পর্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা নেই। অভিজ্ঞ টিসিএম অনুশীলনকারী, গবেষক ও তৃণমূল চিকিৎসকেরও অভাব রয়েছে চীনে।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

জন্ডিসের চিকিৎসায় টিসিএম

জন্ডিস হলো এমন একটি রোগ যেটা হলে ত্বক, চোখের সাদা অংশ ও শ্লেষ্মা-ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়। এর কারণ বিলিরুবিন নামের একটি হলুদ-কমলা পিত্ত পিগমেন্ট বা রঙ্গক বেড়ে যাওয়া। হেপাটাইটিস, পিত্তথলির পাথর ও টিউমারসহ নানা কারণে জন্ডিস হয়।

ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে মনে করা হয়, জন্ডিস দু ধরনের -- ইয়াং জন্ডিস, যেটি খুব তীব্র এবং ইয়িন জন্ডিস, যেটা দীর্ঘস্থায়ী হয়। প্রথম ধরনের বাহ্যিক কারণ হলো বাইরে থেকে শরীরে প্রবেশ করা বিষাক্ত তাপ-ক্লেদ, যেটা প্লীহা ও পাকস্থলী এলাকায় জমা হয় এবং পাচনতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে পাচনতন্ত্র খাদ্যকে ঠিকমতো হজম করতে এবং খাদ্যকে পুষ্টিতে রূপান্তরিত করতে পারে  না, যে কারণে ক্লেদ ও মিউকাস জমা হয়। এগুলো বাড়তে থাকার সঙ্গে সঙ্গে লিভার ও পিত্তথলির মূল শক্তি বা ‘ছি’ প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। এ প্রতিবন্ধকতার ফলে পিত্তরস প্রবাহিত হতে পারে না, যেকারণে এটি ফিরে আসে এবং উপচে পড়ে। এর পর এটি ত্বকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ত্বক হলুদ হয়ে যায়। পিত্তরস নিচের দিকে মূত্রাশয়ের দিকে গেলে প্রস্রাব হলুদ হয়ে যায়। আর উপরের দিকে গেলে চোখ হলুদ হয়ে যায়।

দ্বিতীয় ধরনের বাহ্যিক কারণ হলো অত্যধিক চর্বিযুক্ত খাবার ও অ্যালকোহল গ্রহণ। এগুলো প্লীহা ও পাকস্থলীর কার্যকারিতাকে দূর্বল করে দয়ে। ফলে সেখানে ক্লেদ জমা হয়। জমে থাকা ক্লেদ তাপ উৎপন্ন করে এবং তাপজনিত ক্লেদ হলে সেটা লিভার ও পিত্তথলি চ্যানেলগুলোতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সে জন্য পিত্তরস উপচে পড়ে।

জন্ডিসের অভ্যন্তরীণ কারণ ঘটে যখন একজন রোগীর প্লীহা ও পাকস্থলীতে ‘ছি’য়ের ঘাটতি দেখা দেয়। ‘ছি’য়ের ঘাটতির সঙ্গে সঙ্গে যেহেতু ‘ইয়াং’ বা তাপজনিত শক্তির ঘাটতিও ঘটে, তাই প্লীহা ও পাকস্থলী এলাকায় ঠান্ডা ও ক্লেদ জমা হয়, যা লিভার ও পিত্তথলির কাজকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে পিত্তরস উপচে পড়ে এবং জন্ডিস সৃষ্টি করে। তবে অভ্যন্তরীণ কারণে জন্ডিস হয় তুলনামূলক কম।

তাপজনিত ক্লেদের কারণে জন্ডিস হলে সেটাকে বলা হয় ‘ইয়াং জন্ডিস’। আর যদি সেটা ঠান্ডাজনিত ক্লেদের কারণে হয়, তবে তাকে ‘ইয়িন জন্ডিস’ বলা হয়। দু ধরনের জন্ডিসের চিকিৎসার মূল কৌশলটি এই ক্লেদ দ্রবীভূত করা। এটি এমন ভেষজ দিয়ে করা যায়, যেগুলো ক্লেদ দূর করে। আবার পেট ও প্লীহার ‘ছি’কে শক্তিশালী করার মাধ্যমেও এটা করা যায়।

ক্যাপিলারিস ফর্মুলা

যদি তাপ ক্লেদের চেয়ে বেশি হয়, তবে জন্ডিসের প্রভাবে শরীর হয়ে যায় উজ্জ্বল হলুদ। এছাড়া থাকে তৃষ্ণা, তাপের অনুভূতি, পেট ফাঁপা, শুকনো মুখ, তিক্ত স্বাদ, বমি বমি ভাব, অল্প হলুদ প্রস্রাব এবং কোষ্ঠকাঠিন্য। জিহ্বার ওপর একটি হলুদ চর্বিযুক্ত আবরণ জমা হয় এবং নাড়ি দ্রুত চলে।

এক্ষেত্রে টিসিএম চিকিৎসকরা ক্যাপিলারিস ফর্মুলা দিয়ে তাপ কমান। ক্যাপিলারিস ফর্মুলার প্রধান ভেষজ হলো আর্টিমিসিয়া ক্যাপিলারিস, যাকে চীনা ভাষায় ‘ইয়িন ছান হাও’ বলা হয়। এটি তেতো স্বাদের এক ধরনের ভেষজ, যা ভারত, চীন ও কোরিয়ায় পাওয়া যায়। এটি লিভার, প্লীহা, পিত্তথলি ও পাকস্থলীর চ্যানেলে প্রবেশ করে এবং সেখানকার তাপ ও ক্লেদ দূর করে এবং পিত্তরস নিঃসরণ ও মূত্র বাড়ায়। এটি জ্বর ও ঠাণ্ডা লাগা, তিক্ত স্বাদ, বমি বমি ভাব এবং ক্ষুধামন্দা নিরাময়েও ব্যবহৃত হয়। এ কারণে এটি জন্ডিস, পিত্তথলির রোগ ও হেপাটাইটিসের এক নম্বর ভেষজ। জন্ডিসের চিকিৎসায় এটি সর্বোত্তম টিসিএম ভেষজ।

ক্যাপিলারিস ফর্মুলার অন্য দুটি ভেষজ – গার্ডেনিয়া বা গন্ধরাজ ফুল এবং রুবার্ব বা রেউচিনির পরিমাণ লক্ষণ ও উপসর্গ অনুসারে ঠিক করা হয়। ফর্মুলার মোট ডোজ হলো প্রতিদিন প্রায় ৩০ থেকে ৬০ গ্রাম অপরিশোধিত ভেষজ বা সাড়ে ৭ থেকে ১৫ গ্রাম কনডেন্সড পাউডার।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

বেইজিং থিয়ানথান হাসপাতাল নিউরোসার্জারি সেন্টার

বেইজিং থিয়ানথান হাসপাতালের নিউরোসার্জারি সেন্টার বা বিটিএইচএনসি স্নায়ু-সম্পর্কিত রোগের ক্ষেত্রে চীনের সবচেয়ে বিখ্যাত চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান। দেশটির নিউরোসার্জারির অগ্রদূত ডাক্তার ওয়াং চুংচাং ৩০ বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর গত শতাব্দির আশির দশকের গোড়ার দিকে বেইজিং থিয়ানথান হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন, যার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল একটি আধুনিক নিউরোসার্জারি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। তখন থেকেই বিটিএইচএনসি চীনের বৃহত্তম নিউরোসার্জিক্যাল কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। এটি দেশটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিউরোসার্জিক্যাল প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও।

এ কেন্দ্রে মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০০৫ সালের পর বছরে এ সংখ্যা ৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। বহির্বিভাগ থেকে বছরে এখান থেকে সেবা নেন ৭০ হাজারের বেশি রোগী। এ কেন্দ্রে চিকিৎসকদের মধ্যে আছেন ৪৫ জন পূর্ণকালীন জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, যারা নিউরোসার্জিক্যাল ক্লিনিকাল অনুশীলন এবং মৌলিক গবেষণার সঙ্গে যুক্ত।

এখনকার বিভাগ ও উপবিভাগগুলোর মধ্যে রয়েছে সেরিব্রাল ভাসকুলার বা স্নায়ুবিক নালী-সম্পর্কিত রোগ উপবিভাগ, সুপারটেনটোরিয়াল টিউমার উপবিভাগ, গ্লাইওমা চিকিত্সা উপবিভাগ, পিটুইটারি অ্যাডেনোমা চিকিত্সা উপবিভাগ, মৃগীরোগ উপবিভাগ, নিউরোএন্ডোস্কোপি উপবিভাগ, মস্তিষ্কের আঘাত উপবিভাগ, মেরুদন্ডের টিউমার উপবিভাগ, ইত্যাদি।

এ কেন্দ্রের সেরিব্রাল ভাসকুলার বা স্নায়ুবিক নালী-সম্পর্কিত রোগ উপবিভাগ চীনে এ রোগ-সম্পর্কিত বৃহত্তম অস্ত্রোপচার কেন্দ্র। অ্যানিউরিজম আক্রান্ত অর্থাৎ যাদের রক্তনালীর প্রাচীরবেলুন ফুলে গেছে এবং যাদের এভিএম বা মস্তিস্কের নালীতে জট লেগেছে বছরে এমন ৩শ’র বেশি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয় এখান থেকে। এখানে ভর্তি হতে পারা রোগীদের মৃত্যু হার দেড় শতাংশেরও কম।

এ কেন্দ্রের মস্তিষ্ক-আঘাত উপবিভাগে বছরে ৭শ থেকে ৯শ’ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। সাধারণত যারা মস্তিষ্কে গুরুতর আঘাত পান, তাদের এখানে ভর্তি করা হয়। এখানে ভর্তি হতে পারা রোগীদের মৃত্যুহার ব্যাপকভাবে কমে এসেছে।

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।