বিভিন্ন সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের ৮০টি দেশে আনুমানিক সাড়ে সাতশ’টি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব ঘাঁটি নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে ৮ লাখ ৪৫ হাজারের বেশি ভবন ও বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রকে সেসব দেশের প্রায় তিন কোটি একর জমি অধিগ্রহণ করতে হয়েছে। এসব ঘাঁটির প্রয়োজনীয়তা কি? নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, সন্ত্রাসবাদ দমন, মানবাধিকার রক্ষা ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য- সামরিক ও কূটনৈতিক চাপ দিতে এসব মার্কিন ঘাঁটি প্রয়োজনীয় চাপ তৈরি করে। দেখা যায় যেকোনো অজুহাতে যেকোনো দেশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মার্কিন হস্তক্ষেপের পেছনে এসব ঘাঁটির ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। বিদ্রোহ বা অভ্যুথান ঘটানোর জন্য অথবা বিভিন্ন দেশে অনুগত শাসক শ্রেণী তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এসব ঘাঁটিকে কাজে লাগায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী নতুন বিশ্বে সামরিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, নিজ মতাদর্শ অন্যের ওপর চাপানোর প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং মার্কিন অর্থনীতির উন্নয়ন যুক্তরাষ্ট্রের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে আরও চাঙ্গা করে তোলে। সেই ধারাবাহিকতায় অন্য কোন দেশ বা সাম্রাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের মত এত সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করেনি। যদিও একসময় ব্রিটিশ ও ফরাসি সাম্রাজ্য বিশ্বব্যাপী অনেক ঘাঁটি স্থাপন করেছিল।
পলিটিক্যাল অ্যান্থ্রোপোলজি অফ আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক ডেভিড তার একটি বইয়ে পৃথিবী জুড়ে স্থাপিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলোর একটি হিসাব ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন। সে বইয়ের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীর অন্তত আশিটি দেশে আমেরিকার সেনা ঘাঁটি রয়েছে প্রায় ৭৫০ টি। যদিও প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি বলে ধারণা করেন বিশ্লেষকরা। কারণ মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগ সঠিক তথ্য কখনোই প্রকাশ করে নি। এ ছাড়া মার্কিন সেনা উপস্থিতি রয়েছে বিশ্বের ১৫৯ টি দেশে। মোতায়ন রয়েছে প্রায় ১ লাখ ৭৩ হাজার সেনা । এসব সামরিক ঘাঁটি ও হাজার হাজার সেনা পরিচালনায় যুক্তরাষ্ট্র যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে তা বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মোট ব্যয়ের চেয়েও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি ঘাঁটি রয়েছে প্রধান মিত্র দেশ জাপানে। দেশটিতে মার্কিন সামরিক ঘাঁটির সংখ্যা ১২০টি। এরপরে রয়েছে ইউরোপের দেশ জার্মানিতে। সেখানে মোট ১১৯টি মার্কিন ঘাঁটি রয়েছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার ৭০ বছর পরও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের এখনো অনেক ঘাঁটি রয়েছে। এর মধ্যে ইতালিতে ৪৪টি। স্পেনেও রয়েছে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েন রয়েছে তুরস্কেও। দেশটির ইনজিরলিক বিমান ঘাঁটিসহ বেশ কিছু জায়গায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা অবস্থান করছে বলে জানা যায়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘাঁটি রয়েছে কুয়েত ও সৌদি আরবে। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটিটির অবস্থান কাতারে। সে ঘাঁটির আধুনিকায়নে ২০১৮ সালে ১৮০ কোটি ডলারে একটি প্রকল্প ঘোষণা করে কাতার সরকার৷ বর্তমানে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের ১৩ হাজার সেনা নিযুক্ত রয়েছে। ওই ঘাঁটিতে সার্বক্ষণিক ১১ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থানের পাশাপাশি অসংখ্য ড্রোন ও প্রায় ১০০ টি যুদ্ধবিমান রাখা হয়। এছাড়া আঞ্চলিক মানচিত্রের দিকে তাকালে ইরানের দুই পাশে মার্কিন বাহিনীর অন্তত ১৯ টি ঘাঁটি একদম সহজেই চোখে পড়ে। এ ছাড়া ইরাক থেকে তুরস্ক, মধ্যপ্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি। আছে হাজার হাজার সেনা। ইরানের হুমকির পর এই ঘাঁটিগুলোতে ‘হাই অ্যালার্ট’ জারির পাশাপাশি বাড়তি সেনা পাঠানোর ঘোষণা দেয় পেন্টাগন।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, স্থল, বিমান ও নৌ ঘাঁটিগুলোর মাধ্যমে সারা বিশ্বে আমেরিকা ব্যাপক সামরিক তৎপরতা চালিয়ে থাকে। এভাবে দেশটি তার একক প্রভাবও নিশ্চিত করে থাকে। এসব ঘাঁটির মাধ্যমে মূলত সারা বিশ্বে আমেরিকা তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেইসঙ্গে চায় দেশে দেশে অনুগত শাসকগোষ্ঠী তৈরি করতে ও তাদের সমর্থন দিতে।