৮ বছর বয়সী লি চিয়া রং আগে কখনও ভাবতেই পারেনি যে, একদিন সে নিজের জন্মস্থানে বসেই টেনিস খেলা শিখতে পারবে। তার আইডল হচ্ছে বিশ্ববিখ্যাত চীনা নারী টেনিস খেলোয়াড় লি না। লি চিয়া রং এটাও কোনোদিন ভাবেনি যে, সে বিদেশি কোচের কাছে খেলা শেখার সুযোগ পাবে।
লি চিয়া রং বলল, কোচ জোসি রবিনসনের শুধু কণ্ঠ শুনলে বোঝার উপায় নেই যে, সে একজন বিদেশি। প্রতিদিন বিকালে বিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ হওয়ার পর, ছিংহাই প্রদেশের হাইতং শহরে থু জাতির স্বায়ত্তশাসিত জেলার টেনিস মাঠে, লি চিয়া রংয়ের মতো শিশুরা বিদেশি কোচ রবিনসনের কাছে টেনিসের পাঠ গ্রহণ করে।
পশ্চিম চীনে অবস্থিত ছিংহাই প্রদেশের হংচু জেলা হুয়াংথু মালভূমি ও ছিংহাই-তিব্বত মালভূমির সংযোগ-এলাকায় অবস্থিত। এটি হলো চীনের একমাত্র থু জাতির স্বায়ত্তশাসিত জেলা। স্থানীয় থু জাতির মানুষের ঐতিহ্যগত পোষাক সাত রঙের হয়; রামধনুর মতো। সেজন্য জেলাটি 'রামধনুর জেলা' নামে পরিচিত। জেলাটি লিউফান পাহাড় এলাকার অত্যন্ত দরিদ্র এলাকা।
"আমাদের কোচ অনেক কঠোর প্রকৃতির, কিন্তু রসিক। পিয়ানো বাজানোর চেয়েও আমি টেনিস বেশি পছন্দ করি।" লি চিয়া রং এভাবে বলল। সে কথা বলার সময় পুশ-আপ করছিলো। প্রায় এক ঘন্টা প্রশিক্ষণের পর লি চিয়া রংয়ের মুখের রঙ লাল হয়েছে, মাথায় ঘাম।
নীল চোখ, উঁচু নাক জোসির। তিনি ভালো চীনা ভাষা বলতে পারেন। ৩৭ বছর বয়সী জোসি যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন রাজ্য থেকে এসেছেন। ২০১৩ সালে তিনি মিলওয়াকি বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা বিভাগ থেকে স্নাতক হন। ১২ বছর বয়স থেকে তিনি টেনিস শেখা শুরু করেন। তিনি ছোটবেলা থেকে বেসবল, রাগবি, সাঁতার এবং অন্যান্য খেলা সম্পর্কে উত্সাহী ছিলেন। মায়ের দ্বারা প্রভাবিত জোসি ছোটবেলা থেকেই চীনে আসতে চাইতেন। ২০০৯ সালে তিনি প্রথম চীনে আসেন এবং হোহটে চীনা ভাষা শেখা শুরু করেন। পাশাপাশি, তিনি বেইজিংয়ে শিক্ষকতা করতেন।
তিনি বলেন, “২০১৩ সালের শরত্কালে আমি প্রথম ছিংহাই প্রদেশে আসি। এখানকার নীল আকাশ, সাদা মেঘ ও তুষার-পাহাড় আমি অনেক পছন্দ করি। এখানে যা আমাকে বেশি অবাক করেছে তা হচ্ছে, এখানে 'ফ্রেঞ্চ টেনিস ওপেন'-এর মতো লাল মাটির টেনিস গ্রাউন্ড আছে।”
পরে জোসি বেইজিংয়ে ফিরে টেনিস কোচ হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। তখন কাজ তেমন কঠিন ছিল না এবং বেতনও বেশি ছিল। কিন্তু তিনি আরও কঠিন কাজ করতে চাইতেন।
“আমি আরো বেশি চীনা শিশুকে শেখাতে চাই। কিন্তু বেইজিংয়ের মতো বড় শহরে ভাল কোচ বেশি। আমি এমন জায়গায় যেতে চাইলাম যেখানে কাজের সুযোগ বেশি।“ তিনি বললেন।
২০১৭ সালে জোসি হুচু জেলায় আসেন। তিনি স্থানীয় টেনিস গ্রাউন্ড ভাড়া করে তাঁর নতুন কাজ শুরু করেন। কিন্তু তখন তিনি হুচু জেলা সম্পর্কে বেশি জানতেন না।
বড় শহরের শিশুদের কাছে টেনিস সুপরিচিত। কিন্তু এখানকার শিশুরা টেনিস সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতো না। টেনিস অনেক শিশুর কাছে অদ্ভুত একটি খেলা। জোসি বলেন, “তখন আমি বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রচারপত্র বিলি করা শুরু করি। কিন্তু মাত্র দু'টি শিশু আমার কাছে টেনিস শিখতে আসে।” যদিও শুরুতে তাকে খানিকটা হতাশা ঘিরে ধরেছিল, কিন্তু তিনি হাল ছেড়ে দেননি। টেনিস ছাড়াও তিনি শিশুদেরকে ইংরেজি শেখান।
একসময় জেলার অনেকেই জেনে যায় যে, এখানে একজন বিদেশি টেনিস কোচ এসেছেন। ২০১৮ সালের বসন্তকালে জোসির প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু তিনি এতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। কারণ, অনেক শিক্ষার্থীর আসল লক্ষ্য ছিল তাঁর কাছ থেকে ইংরেজি শেখা। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “টেনিস শেখার পাশাপাশি ইংরেজি শেখার সুযোগ অনেক শিক্ষার্থীকে আকর্ষণ করে। কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল শুধু টেনিস শেখানো। আমি শুধুমাত্র তাদেরকে টেনিস শেখাতে চাইতাম। পরে আমি ইংরেজি শেখানো ছেড়ে দিই। সেজন্য অনেক শিক্ষার্থী টেনিস শেখাও ছেড়ে দেয়!”
বর্তমানে তিনি শিক্ষার্থীদের বয়স ও উচ্চতা অনুসারে বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন। তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় শিশু'র বয়স ১৩ বছর, সবচেয়ে ছোটটির মাত্র ৪ বছর। তিনি সপ্তাহান্তে শিশুদেরকে নিয়ে সিআন, লানচৌ ও ছেংতুসহ বিভিন্ন স্থানে অপেশাদার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন।
প্রতিবছরের শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে জোসি টেনিস ক্যাম্প আয়োজন করেন। ছংছিং, বেইজিং, হুনান ও কুয়াংতুং প্রদেশের শিশুরা হুচু জেলায় এসে টেনিস ক্যাম্পে অংশ নেয়। টেনিস খেলা ছাড়াও জোসি শিশুদেরকে নিয়ে পাহাড় ওঠেন। শিশুদেরকে নিয়ে স্থানীয় রীতিনীতি অনুভব করেন তিনি।
দেশের শিক্ষানীতির উন্নয়নের ফলে এখন চীনের অনেক পিতামাতা লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়ার গুরুত্ব বুঝতে পারছেন। বিভিন্ন খেলাধুলায় দক্ষ হলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ বাড়ে। খেলাধুলা শিশুদের স্বাস্থ্যবানও করে। তাঁদের ভবিষ্যত আরও উজ্জ্বল হয়।
বর্তমানে জোসির কোচদলে থু, তিব্বত ও কোরীয় জাতির কোচ রয়েছেন। তিনি মনে করেন, বিভিন্ন সংস্কৃতি খুবই মজার। তিনি বলেন, “আমাদের অনেক কোচের বাড়িতে জমি আছে। ব্যস্ত সময়ে তাঁদেরকে বাড়িতে গিয়ে কৃষিকাজ করতে হয়।“ তিনি আরো বেশী স্থানীয় কোচকে প্রশিক্ষণ দিতে চান। তিনি আশা করেন, টেনিস ছিংহাইয়ের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে।
জোসি বলেন, আজকাল ছিংহাই প্রদেশে অনেক আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা আয়োজিত হচ্ছে। অধিক থেকে অধিকরত মানুষ ক্রীড়ার মাধ্যমে ছিংহাইকে জানছেন। বর্তমানে হুচু জেলায় স্টেডিয়ামের সংখ্যা অনেক বেশি। স্থানীয় বাসিন্দারা খেলাধুলা পছন্দ করে। স্বাস্থ্যকর জীবনের ধারণা অনেক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এখানে।
তিনি বলেন, “টেনিসের মাধ্যমে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া যায়। শিশুরা খেলাধুলার মাধ্যমে মানসিক চাপ কাটিয়ে উঠতে পারে। আমি আশা করি, শিশুরা টেনিস খেলার মাধ্যমে একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তুলবে। একসময় তারা অনেক দূর-দূরান্তে ভ্রমণ করবে। আমি চীনা শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাবো।“ (ছাই/আলিম)