সাইলেন্ট বেকারি দোকানের মালিক জার্মান নাগরিক মার্কুস হফমুলার
2023-04-06 16:21:11

মার্কুস হফমুলার একজন জার্মান নাগরিক। তিনি জার্মানির লিপজিগ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাইনোলজিতে পিএইচডি করেছেন। বিশ বছর আগে যখন তিনি প্রথমবার চীনে আসেন, তখন তিনি এখানকার সবকিছুর প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। বিশ বছর পর তিনি হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরের একটি বেকারির মালিক হন এবং শ্রবণ-প্রতিবন্ধীদের জন্য আশার আলো জ্বালান।

 

আজকের অনুষ্ঠানে আমরা তাঁর এই ‘নীরব বেকারিতে’ প্রবেশ করবো।

 

চীনের হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরের খাইফু জেলার সিয়াংছুন গলিতে প্রবেশ করলে রুটির সুগন্ধ নাকে ভেসে আসে। এই পুরনো গলিতে লুকিয়ে আছে ‘সাইলেন্ট বেকারি বা নিস্তব্ধ বেকারি’ বলে  পরিচিত এই দোকানটি। দোকানের নাম হলো  ‘বা হ্য পশ্চিমা স্টাইলের স্ন্যাকস’। এর মালিক মার্কুসের চীনা নাম হলো হ্য মো খাই। তিনি এই দোকানের নামের উৎপত্তি ব্যাখ্যা করেন।

 

 ‘এই দোকানটি প্রধানত বধির লোকদের নিয়োগ করে এবং তাদের কর্মসংস্থানের ও প্রশিক্ষণের সুযোগ প্রদান করে। দোকানটিতে এখন মোট ১২ জন কর্মচারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে সাতজন শ্রবণ প্রতিবন্ধী, যাদের পাঁচজন বেইকার, একজন ফ্রন্ট ডেস্ক কর্মী এবং একজন শিক্ষানবিশ।’

 

২০২২ সালে হ্য মো খাই আনুষ্ঠানিকভাবে ‘বা হ্য পশ্চিমা স্টাইলের স্ন্যাকস’ দোকানের মালিক হন। সেই সময় নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইন ছুয়ান শহরে প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষকতার ইতি টানেন।

 

জার্মানি থেকে চীন পর্যন্ত, নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইনছুয়ান থেকে হুনান প্রদেশের ছাংশা শহর পর্যন্ত,  শিক্ষক থেকে বেকারি ম্যানেজার পর্যন্ত, প্রতিটি পরিবর্তন ছিল চ্যালেঞ্জপূর্ণ। তবে, হ্য মোখাই বলেন, তিনি চ্যালেঞ্জ পছন্দ করেন। তার দৃষ্টিতে, চীনের সাথে অবিচ্ছিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণ হলো ভিন্ন জীবন অনুসরণ করার সাহস।

 

২০০৩ সালে চীন এবং জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রকল্পের কল্যাণে হ্য মো খাই বিনিময় ছাত্র হিসেবে এক বছরের অধ্যয়ন জীবন শুরু করতে চীনের থিয়েনচিন শহরে এসেছিলেন।

 

 তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন,

 ‘আমি যখন প্রথম চীনে আসি, তখন আমার খুব স্পষ্ট মনে আছে যে আমি কথা বলতে জানতাম না।’

 

যাইহোক, শুরুতে ভাষার বাধা তাকে নিরুৎসাহিত করেনি, বিপরীতে, এটি চীনা ভাষা শেখার জন্য তার সংকল্পকে জাগিয়ে তুলেছে। অবসর সময়ে তিনি চীনা লোকদের সাথে যতটা সম্ভব সময় ব্যয় করেন এবং অনুশীলনের মাধ্যমে আরও চীনা ভাষা শুনতে এবং কথা বলতে নিজেকে উত্সাহিত করেন।

 

চীনা জনগণের উত্সাহ এবং চীনা সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ও বৈচিত্র্যের কারণে তিনি ধীরে ধীরে এই জায়গাটির প্রেমে পড়েছিলেন।

 

তিনি বলেন,

 ‘চাইনিজদের সাথে যোগাযোগ করা খুব সহজ। সেই বছরের অভিজ্ঞতায় আমার মনে হয়েছে যে এই দেশে বসবাসের জন্য খুব উপযুক্ত।’

 

বিনিময় ছাত্র হিসেবে অধ্যয়ন জীবন শেষ হওয়ার পর তিনি তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে জার্মানিতে ফিরে যান। ২০১০ সালে কাজের প্রয়োজনে তিনি আবার চীনে আসেন এবং তার বর্তমান স্ত্রী তথা একজন থিয়েনচিনবাসী মেয়ের সাথে দেখা করেন। বিয়ের পর তিনি এবং তার স্ত্রী জার্মানিতে আট বছর বসবাস করেন এবং দুটি সুন্দর কন্যার জন্ম দেন।

 

 ‘বিয়ের পর চীনে ফিরে যাওয়ার চিন্তা আমাদের মনে সব সময়ই ছিল। কারণ আমার স্ত্রী, তার পরিবার চীনে থাকেন। আমি বাচ্চাদের চীনা ভাষা শিক্ষাদানের এক সম্পূর্ণ পরিবেশ চাই।’

 

২০১৯ সালে যখন হ্য মো খাই মূলত তার পরিবারকে থিয়েনচিনে বসতি স্থাপনের জন্য নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, তখন তিনি জানতে পেরেছিলেন যে নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইনছুয়ান শহরে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিদেশী ভাষার শিক্ষক নিয়োগ করছে।

 

হ্য মো খাই বলেন,

 

‘এ খবর শুনে খুব উত্তেজিত হয়েছিলাম এবং আমার মনের ভিতরে একটি কণ্ঠ বলেছিল, ‘তুমি এটিই করতে যাচ্ছো’।

 

ইনছুয়ান শহরে দু’বছরব্যাপী শিক্ষাদানের জীবন শেষ করার পর তিনি ‘বা হ্য পশ্চিমা স্টাইলের স্ন্যাকস’ হস্তান্তরের খবর জানেন।

 

‘আমি ইন্টারনেটে এই বেকারি সম্পর্কে জেনেছি এবং অবিলম্বে এর সাবেক পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করেছি।’

 

এই বেকারি’র সাবেক পরিচালক একজন জার্মান। তার চীনা নাম হলো উ চেং রোং। ২০০২ সালে তিনি এবং তার স্ত্রী শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য একটি ছাত্র সহায়তা কর্মসূচির কারণে হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হুনান প্রদেশের ছাংশা শহরে গিয়েছিলেন। পরবর্তীতে আরও শ্রবণ-প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সাহায্য করার জন্য এই দম্পতি ২০১১ সালে এই বেকারিটি কিনেছিলেন এবং শ্রবণ-প্রতিবন্ধী শিক্ষানবিশদের কাছে জার্মান রুটি-বেকিং দক্ষতা হস্তান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তারা আশা করেন, শ্রবণ-প্রতিবন্ধীরা রুটি-বেকিংয়ের দক্ষতার মাধ্যমে একটি স্থিতিশীল চাকরি ও জীবন পাবে। এভাবেই জন্ম নেই  ‘সাইলেন্ট বেকারি’।

 

২০২২ সালে উ চেং রোং এবং তার স্ত্রী তাদের হোমসিকনেসের কারণে জার্মানিতে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন, তাই তারা বেকারিটি স্থানান্তরের খবর ঘোষণা করেছিলেন।

 

পরিবারের প্রভাবে হ্য মো খাই শৈশব থেকেই বেকিং এর প্রতি প্রবল আগ্রহ পোষণ করেন। তিনি বলেছিলেন যে যখন থিয়েনচিনে অধ্যয়নরত ছিলেন, তখন তিনি কয়েকজন শ্রবণ-প্রতিবন্ধী বন্ধুর সাথে পরিচিত হয়েছিলেন। তিনি শ্রবণ-প্রতিবন্ধীদের সাহায্য করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা করতে চান। ২০২২ সালের মার্চ মাসে হ্য মো খাই পরিবার নিয়ে ছাংশা শহরে চলে যান।

 

কিন্তু একটি বেকারি ভালোভাবে চালানোর জন্য আগ্রহ এবং উদ্দীপনাই যথেষ্ট নয়। যখন তিনি প্রথম বেকারি পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন তিনি আর্থিক কাজ, গ্রাহক পরিষেবা, কাঁচামাল সংগ্রহ এবং কর্মচারী ব্যবস্থাপনা নিয়ে একটু চিন্তিত ছিলেন। তার জন্য সবচেয়ে ঝামেলার বিষয় হল শ্রবণ-প্রতিবন্ধী কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগের সমস্যা। তিনি শূন্য থেকে ইশারা ভাষা শিখতে শুরু করেন।

 

 ‘আগে আমি কখনওই ইশারা ভাষা সম্পর্কে জানতাম না। শুরুতে ইশারা দিয়ে প্রকাশের ক্ষেত্রে আমি অনেক ভুল করেছি।’

 

হ্য খাই মো ঠাট্টাচ্ছলে বলেন, নিজেই একজন শিক্ষানবিশ স্টোর ম্যানেজার। তিনি শ্রবণ-প্রতিবন্ধী কর্মীদের বেকিং প্রযুক্তি শিক্ষাদানের সঙ্গে সঙ্গে কর্মীরা তাকে ইশারা ভাষাও শিখিয়েছেন।

 

তিনি বলেন,

 ‘তারা আমাকে ধৈর্য সহকারে শেখাতে পেরেছে, কীভাবে একটি শব্দকে উপস্থাপন করতে হয়। আমি যদি কোনো কিছু বুঝতে না পারি, তাহলে তারা এটি একটি হোয়াইটবোর্ডে লিখেন বা মোবাইল ফোনে টাইপ করে।’

 

বর্তমানে হ্য মো খাই এবং সহকর্মীদের যৌথ প্রচেষ্টায় বেকারির ব্যবসা দিন দিন ভালো চলছে। নিজের সহকর্মীদের প্রসঙ্গে হ্য মো খাই বলেন,

 

 ‘আমি মনে করি, তারা অনেক পেশাদার। হয়তো তারা শুনতে পারেন না,তবে তারা খুব মনোযোগ দিয়ে একটি কাজে মনোনিবেশ করতে পারে। তাদের সঙ্গে কাজ করতে এবং সহযোগিতা করতে আমি পছন্দ করি।’

 

বেকারি দোকানে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকার পাশাপাশি হ্য মো খাই তার অবসর সময়কে সাধারণ জীবনে ধীরগতির অভিজ্ঞতার জন্যও ব্যবহার করেন। সাপ্তাহিক ছুটিতে তিনি তার সন্তানদের নিয়ে সিয়াংচিয়াং নদীর ধারে বেড়াতে যান এবং মাঝে মাঝে শহরের সাংস্কৃতিক পরিবেশ অনুভব করতে ছাংশা শহরের রাস্তায় এবং গলিতে ঘুরে বেড়ান।

 

তিনি বলেন, তিনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি জীবন পর্যবেক্ষণ করতে পছন্দ করেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি চীনের অনেক জায়গায় ভ্রমণ করেছেন এবং চীনের দ্রুত উন্নয়নের সাক্ষী হয়েছেন।

 

চীনের বৈদেশিক উন্মুক্তকরণের মান দিন দিন বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে বিদেশের সঙ্গে চীনের বিনিময়ও দিন দিন ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। চীনের সুবিধাজনক পরিবহন এবং আধুনিক রসদ বেকারি পরিচালনার জন্য তাকে আরও সুবিধাজনক শর্ত সরবরাহ করেছে বলে তিনি মনে করেন।

 

তিনি বলেন,

 ‘চীনে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নগরায়ন, আধুনিকায়ন, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে। মানুষও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।’

 

বর্তমানে হ্য মো খাই চীনের জীবন এবং সাংস্কৃতিক পরিবেশের ছন্দে সম্পূর্ণরূপে মিশি গেছেন। এখানে তার একটি পছন্দের পেশা এবং একটি বাসা আছে।

 

ভবিষ্যতে তিনি আশা করেন, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী এখানে আরও ভাল জীবন পেতে পারেন এবং তাদের সন্তানরা চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে আরও বেশি শিখতে পারবে। নিজের বেকারি দোকান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়োগ অব্যাহত রাখবেন এবং যতটা সম্ভব তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ দেবেন।

তিনি বলেন,

 ‘আমি তাদের কাছ থেকে অনেক দুর্দান্ত জিনিস দেখতে পাচ্ছি এবং আমি আশা করি, আমার কর্মীরা তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি দায়িত্ব পালন করবে এবং সমাজের জন্য আরও বেশী অবদান রাখবে।’