দেহঘড়ি পর্ব-০১২
2023-04-02 19:31:17

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং টিসিএম ভেষজের উপকারিতা নিয়ে আলোচনা ‘ভেষজের গুণ’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

হাঁপানি উপশম করে টিসিএম

হাঁপানি দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহজনিত রোগগুলোর অন্যতম। এ রোগের প্রধান বৈশিষ্ট হলো ব্রঙ্কিয়াল টিউবের অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীলতা, শ্লেষ্মা উৎপাদন বৃদ্ধি, শ্বাসনালী সংকীর্ণ হওয়া এবং শ্বাসনালীর আকার পরিবর্তিত হওয়া। এর উপসর্গগুলোর মধ্যে থাকে কাশি, শ্বাসকষ্ট এবং বুক শক্ত হয়ে যাওয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান বলছে, বিশ্বব্যাপী আনুমানিক ৩০ কোটি মানুষ আক্রান্ত এ রোগে।

 ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে হাঁপানিকে বলা হয় ‘সিয়াও ছুয়ান’, যার অর্থ শ্বাসকষ্ট। এ চিকিৎসা ব্যবস্থায় ‘সিয়াও’ ও ‘ছুয়ান’কে আলাদা অসুস্থতা হিসাবে দেখা হয়, যার চিকিৎসাও আলাদা।  ‘সিয়াও’র বৈশিষ্ট শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বাঁশির মতো শব্দ করা, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হওয়া, শ্বাসকষ্ট এবং অনুভূমিক অবস্থানে বিশ্রাম নিতে না পারা। অন্যদিকে ‘ছুয়ান’র বৈশিষ্ট শ্বাসকষ্ট, শ্বাস নেওয়ার জন্য সারাক্ষণ মুখ খুলে রাখা, কাঁধ উত্থিত হওয়া, এবং অনুভূমিক অবস্থানে বিশ্রাম নিতে অসুবিধা। ‘সিয়াও’ রোগীদের সাধারণত ‘ছুয়ান’ও থাকে, তবে ‘ছুয়ান’ রোগীদের ‘সিয়াও’ হতে পারে বা নাও হতে পারে।

টিসিএমে মনে করা হয়, বেশ কতগুলো কারণ রয়েছে যা হাঁপানি জাগিয়ে তুলতে পারে। যেমন বাহ্যিক রোগজীবাণুর আক্রমণ, খাদ্যাভ্যাস, মানসিক সমস্যা, জন্মগত দুর্বলতা এবং দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা।

বাহ্যিক প্যাথোজেনিক কারণ, যেমন ঠান্ডা বা তাপ হাঁপানি জাগিয়ে তোলে। এটা ফুসফুসের মূল শক্তি বা ‘ছি’র উপর আধিপত্য বিস্তার করে এবং ত্বকে তা প্রকাশ পায়। ফুসফুস আক্রান্ত হওয়ার পর এর জলের পথ নিয়ন্ত্রণের কার্যকারিতা বিঘ্নিত হয়। ফলে ফুসফুসে পানি জমতে এবং কফ তৈরি হতে শুরু করে। বাহ্যিক প্যাথোজেনিক উপাদানের কারণে হাঁপানির আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে যখন তাপমাত্রা কম থাকে বা আবহাওয়ার দ্রুত পরিবর্তন হয়। বাহ্যিক প্যাথোজেনিক কারণগুলোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে ফলের পরাগ, সিগারেটের ধোঁয়া বা অন্য কোনো অ্যালার্জেন।

ডায়েটও হাঁপানি বাড়িতে দিতে পারে। কাঁচা ও ঠান্ডা খাবার প্লীহাকে ক্ষতিগ্রস্থ করতে পারে এবং তরল চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে কফের উৎপাদন বৃদ্ধিতে অবদান রাখতে পারে। ভারী, মিষ্টি ও চর্বিযুক্ত খাবার শরীরে কফ ও তাপ সৃষ্টি করে। মাছ, কাঁকড়া, শেলফিশ ও অন্যান্য সামুদ্রিক খাবারগুলোও হাঁপানির আক্রমণের সম্ভাবনা বাড়ায়।

জন্মগত দুর্বলতা ও দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতাও হাঁপানির অন্যতম কারণ। হাঁপানিতে আক্রান্ত শিশুদের সাধারণত জন্মগতভাবে কিডনিতে ‘ছি’র ঘাটতি থাকে। অন্যদিকে, দীর্ঘস্থায়ী অসুস্থতা, যেমন দীর্ঘস্থায়ী কাশি এবং বারবার সর্দি বা ফ্লুতে আক্রান্ত রোগীদের ফুসফুসের ‘ছি’র ঘাটতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

ঠাণ্ডার কারণে যখন হাঁপানি হয়, তখন এমন টিসিএম ভেষজ ফর্মুলেশন বেছে নেওয়া হয়, যা ঠান্ডা দূর করে, শরীরের অভ্যন্তরকে উষ্ণ করে, কফ দূর করে এবং ব্রঙ্কিয়াল খিঁচুনি উপশম করে। এ ফর্মুলেশনের মধ্যে থাকে এফেড্রে নামের এক ধরনের পাতাহীন গুল্ম, দারুচিনি, সরিষার বীজ, আসারাম, শুকনো আদা, ম্যাগনোলিয়ার ছাল, এপ্রিকট বীজ, লেপিডিয়াম, পিনেলিয়া, স্কিজান্দ্রা, লুমব্রিকাস, সাদা পেওনি ও যষ্টিমধু।

এফেড্রে ও দারুচিনি কুঁচি ঠান্ডা দূর করে, শ্বাসকষ্ট কমায় এবং ফুসফুসের ‘ছি’ প্রবাহকে মসৃণ করে। এর পাশাপাশি এফেড্রে প্রস্রাব বাড়ায়, যার মধ্য দিয়ে ফুসফুসে জমা তরল দূর হয়। সরিষার বীজ, আসারাম ও শুকনো আদা ফুসফুসকে উষ্ণ করে, জমে যাওয়া তরল দ্রবীভূত করে এবং ফুসফুসকে তার স্বাভাবিক কাজ শুরু করতে সহায়তা করে। ম্যাগনোলিয়া ছাল ফুসফুসের ‘ছি’ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এপ্রিকট বীজ, লেপিডিয়াম ও পিনেলিয়া কফ দূর করে, জমাট তরল গলায় এবং শ্বাসকষ্ট কমায়। স্কিজান্দ্রা ‘ছি’র লিকেজ প্রতিরোধের মাধ্যমে ফুসফুসকে রক্ষা করে। লুমব্রিকাস শ্বাসকষ্ট দূর করে এবং ব্রঙ্কি প্রসারিত করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে সাদা পেওনি ব্রঙ্কির পেশীর খিঁচুনি দূর করে, ভাজা যষ্টিমধু ‘ছি’র ঘাটতি পূরণ করে, কাশি বন্ধ করে, খিঁচুনি কমায় এবং ব্যথা উপশম করে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

সাউদার্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নানফাং হাসপাতাল

সাউদার্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নানফাং হাসপাতাল এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম অনুমোদিত হাসপাতাল। বিদেশীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার প্রাথমিক লক্ষ্য নিয়ে ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় একটি সামরিক হাসপাতাল হিসাবে। স্বাস্থ্যসেবা, চিকিৎসা শিক্ষা ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার দিক থেকে এটি চীনের শীর্ষ হাসপাতালগুলোর একটি। দেশটির সেরা হাসপাতালগুলোকে নিয়ে করা সর্বশেষ র‌্যাঙ্কিংয়ে এ চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের অবস্থান ১৬তম।

 নানফাং হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন ৯০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চল থেকে আগত ১ লাখ ১০ হাজারেরও বেশি রোগী। ২ হাজার ২২৫-শয্যার এ হাসপাতালে কাজ করেন ৬শ জনেরও বেশি জ্যেষ্ঠ পেশাদার ও প্রযুক্তি কর্মী, ১০২ জন ডক্টরাল উপদেষ্টা এবং ১৪৮ জন মাস্টার্স উপদেষ্টা।

এ হাসপতালের অঙ্গ প্রতিস্থাপন বিভাগে ৩০জনের বেশি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও সার্জন রয়েছেন, যাদের মধ্যে ২ জন অধ্যাপক, ৬ জন সহযোগী অধ্যাপক ও সহযোগী প্রধান সার্জন এবং ৪ জন সার্জন৷ এ চিকিৎসক ও সার্জনদের বেশিরভাগই পিএইচডি ডিগ্রিধারী, যাদের মধ্যে তিনজন যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ প্রতিস্থাপন কেন্দ্র এবং সিনসিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ প্রতিস্থাপন কেন্দ্রে পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

২০০৪ সালে প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়, ২০০১ সালের শেষ নাগাদ হাসপাতালটি ২ হাজার ১২৩ জন রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করেছে। কিডনি প্রতিস্থাপনের সংখ্যার দিক থেকে এ হাসপাতালটি দেশের মধ্যে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে।

নানফাং হাসপাতালের হেপাটোবিলিয়ারি সার্জারি বিভাগ দক্ষিণ চীনের তিনটি লিভার প্রতিস্থাপন সেন্টারের মধ্যে একটি। এটি রাষ্ট্র-অনুমোদিত একটি ডক্টরেট ডিগ্রী প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটি ন্যাশনাল ন্যাচারাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন, কুয়াংতুং প্রদেশের ন্যাচারাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এবং কুয়াংতুং প্রদেশের প্রযুক্তি-সম্পর্কিত ১০টিরও বেশি প্রোগ্রাম পরিচালনা করেছে।

হাসপাতালটি তার কিডনি প্রতিস্থাপন কর্মসূচিতে অসংখ্য ডক্টরেট ও মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এই শিক্ষার্থীরা কিডনি প্রতিস্থাপনের কোনও জ্ঞান ছাড়াই শুরু করেছিলেন, কিন্তু তাদের ইন্টার্নশিপ শেষ করার পর তুলনামূলকভাবে দক্ষ কিডনি প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছেন।

 

#ভেষজের গুণ

জিনসেং

সার্বিক সুস্থতার জন্য অনুশীলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যা হলো চীনা ভেষজবিদ্যা। এই বিদ্যা এবং সারা বিশ্বের অন্যান্য চিকিৎসা ঐতিহ্য মানবদেহকে নিরাময় ও শক্তিশালী করতে উদ্ভিদের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছে এবং অবিরতভাবে লাগিয়ে যাচ্ছে। আজ আমরা আলোচনা করবো ভেষজবিদ্যার অন্যতম একটি ভেষজ জিনসেং নিয়ে।…

চীনা ভাষায় জিনসেং শেকড়কে বলা হয় রেন শেন। জিনসেং একটি পাতাযুক্ত উদ্ভিদ, যা প্রধানত এশিয়ায় জন্মে। ঐতিহ্যবাহী চীনা ওষুধে এর শেকড়কে একটি শক্তিশালী প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধক হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এছাড়া এই ভেষজটি শক্তি প্রদায়ী, প্রদাহ উপশমকারী এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বা শরীরের বিষাক্ত পদার্থ বিনাশকারী।

পশ্চিমা চিকিৎসা ব্যবস্থাও জিনসেংয়ের স্বাস্থ্যগত উপকারিতার ব্যাপারে একমত। গবেষণায় দেখা গেছে, জিনসেং ত্বকে কোলাজেনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে এবং বলিরেখা ও বিবর্ণতা বা গাঢ় দাগের মতো বার্ধক্যের দৃশ্যমান প্রভাবগুলি হ্রাস করে। সেকারণে জিনসেংকে ‘সৌন্দর্য খাদ্য’ হিসাবে অভিহিত করা হয়।

বিশ্ব বিখ্যাত ডাব্লুটিএইচএন-এর ডেইলি গ্লো ফর্মুলায় জিনসেং শেকড় এবং তার সঙ্গে মুক্তার গুঁড়ো ও রোজ হিপস ফলের মতো উপাদান ব্যবহার করা হয় ত্বকের যত্নে।

এসব বৈশিষ্টের পাশাপাশি জিনসেং শরীরে অ্যালকোহল প্রক্রিয়া করার ক্ষমতা বাড়ায়।

 

 

‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।