চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য-১০
2023-04-01 18:27:03

শরৎ ও শীতকালীন সাংহাই ফ্যাশন সপ্তাহ ২০২৩ জমে উঠেছে। সাংহাইয়ের সিনথিয়ানতি জেলায় উদ্বোধনী ক্যাটওয়াক শো দিয়ে শুরু হয় এবারের ফ্যাশন সপ্তাহ। ব্রিটিশ ব্র্যান্ড হ্যাজিসের সর্বশেষ রয়্যাল ক্লাব সংগ্রহ পরিধান করে রানওয়েতে কুকুরসহ ক্যাটওয়াক করেন মডেলরা।

যেহেতু হ্যাজিসের লোগো একটি কুকুর, তাই মঞ্চে সরাসরি কুকুরের উপস্থিতিতে দর্শককে কিছুটা অবাক করে দেয়।

একজন দর্শক যেমন বলছিলেন, "আমি আশা করিনি যে সেখানে সত্যিকারের কুকুরছানা থাকবে। আমি ভেবেছিলাম কুকুরের উপাদানটি শুধুমাত্র লোগোতে বা অন্য আকারে দেখানো হবে। কুকুরের উপাদানটি অনেকবার উপস্থিত হয়েছে, যা অপ্রত্যাশিত ছিল। ব্র্যান্ডটি কুকুরকে খুব ভালোভাবে প্রদর্শন করেছে।

 

ফ্যাশন-সম্পর্কিত কোর্সের শিক্ষার্থীরাও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানটি দেখে অনুপ্রাণিত হন। ফ্যাশন ডিজিইনিংয়ে শিক্ষার্থী চৌ সিয়াংশেং শো সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন।

‘শোতে পোষা প্রাণী ছিল। ফ্যাশন সপ্তাহে এটি আমার প্রথমবার। এটা সত্যিই চমৎকার। ফ্যাশন ডিজাইন অধ্যয়নরত একজন ছাত্র হিসাবে, আমিও শো থেকে অনেক কিছু শিখেছি’।

ফ্যাশন শিল্পে টেকসই উন্নয়নের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে, বিশেষজ্ঞ এবং নেতৃস্থানীয় উদ্যোগের প্রতিনিধিরা এ ধরনের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে সমবেত হন এ অনুষ্ঠানে। 

আয়োজকরা জানান, এই মৌসুমে, ইভেন্টটি সোশ্যাল মিডিয়াতে দিনে নয় ঘন্টার মতো দেখানো হচ্ছে। এতে ফ্যাশনে আগ্রহী ব্যক্তিদের যেখানেই থাকুক না কেন শো’তে প্রদর্শিত সবশেষ প্রবণতাগুলো পর্যবেক্ষণ করতে সুবিধা হয়। 

এ বছর সাংহাই ফ্যাশন সপ্তাহের ২০তম বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। চলমান এই ইভেন্ট চলবে আগামী এপ্রিলের ৫ তারিখ পর্যন্ত। 

এদিকে, বেজিংয়েও শরৎ ও শীতকালীন চীন ফ্যাশন সপ্তাহ ২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে। "এক্সট্রিম ইনোভেশন ট্রাভেল" এই সিজনের ইভেন্টের থিম। এবারের ফ্যাশন সপ্তাহে দেশ-বিদেশের ডিজাইনারদের অংশ গ্রহণে ১’শ টিরও বেশি  ফ্যাশন ইভেন্ট অনুষ্ঠিত হয়।

চীনের একমাত্র জাতীয় পর্যায়ের ফ্যাশন সপ্তাহ হিসেবে, এই ইভেন্টটি ২৬ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।

আয়োজকরা জানান, চীনের ফ্যাশন শিল্পের বিকাশের সাক্ষী এই ইভেন্টটি ডিজাইনার এবং ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হয়ে উঠেছে।

২. চায়না ফুড ফেস্টিভ্যাল ২০২৩: চাঙ্গা হচ্ছে ক্যাটারিং খাত

কোভিড মহামারি কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে চীনের অর্থনীতি। অন্য খাতগুলোর মতোই দেশটির ক্যাটারিং খাতকে চাঙ্গা করতে নেওয়া হয়েছে বছরব্যাপী কর্মসূচি। চায়না ফুড ফেস্টিভ্যাল ২০২৩ নামের এ উৎসব চলছে চীনের বিভিন্ন স্থানে। উৎসবের আমেজে চীনের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্রময় খাবারের স্বাদ নিচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও বাইরে থাকা আসা পর্যটকরা।

দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের সিচুয়ান প্রদেশের ছংতু শহরে ক্যাটারিং সেক্টরকে চাঙ্গা করতে ২৩ মার্চ শুরু হয়েছে চায়না ফুড ফেস্টিভ্যাল ২০২৩।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, মানবসম্পদ ও সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় এবং সংস্কৃতি ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যৌথ পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত উৎসবটি দেশব্যাপী ভোগপ্রবণতা বাড়ানোর মাসব্যাপী উদ্যোগের অংশ।

 

ছংতু শহরের কেন্দ্রস্থলে, একটি খোলা বাজার- যেখানে স্থানীয় খাবার সিচুয়ান বোল চিকেনের টাটকা স্বাদ নিতে গ্রাহকদের ভিড় লেগেই থাকে। 

একজন পর্যটক বলছিলেন তার ভালোলাগার কথা।

‘এটা খুব সুন্দর। আমরা স্থানীয় নই, তবে, স্থানীয় উপাদেয় খাবারের স্বাদ নেওয়ার সুযোগ পেয়ে ভালো লাগছে’।

উত্তর-পশ্চিম চীনের কানসু প্রদেশের লানচৌ শহরে, বসন্তের চমৎকার আবহাওয়ায় আবার জমে উঠেছে একটি খোলা রাতের বাজার। স্থানীয়  বাসিন্দা এবং পর্যটকদের কাছে খুবই জনপ্রিয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে এটি।

লানচৌর দাচং মার্কেটের একজন স্টল মালিক লি ওয়েনচিয়ে জানান, দু’চার পয়সা লাভের মুখ দেখছেন তারা।

‘খুব ভালো ব্যবসা হচ্ছে, বিশেষ করে সপ্তাহান্তে এবং ছুটির দিনে। সাধারণত আমি সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় ব্যবসা শুরু করি এবং মধ্যরাত পর্যন্ত ব্যস্ত থাকি’।

উত্তর-পশ্চিম চীনের বিভিন্ন সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পেতে এখানে আসেন চীনের অন্য প্রদেশের মানুষরাও।

চেচিয়াং থেকে আসা পর্যটক হুয়াং ফাংফাং প্রশংসা করেন এখানকর সুস্বাদু খাবার আর পরিপাটি পরিবশের।

‘আমি চেচিয়াং প্রদেশের ওয়েনচৌ শহর থেকে এসেছি। এখানকার রাতের বাজারের স্টলগুলো পরিপাটি ও পরিচ্ছন্ন। স্টলের মালিকদের পোশাক ঠিকঠাক এবং খাবারও ভালো’।

পূর্ব চীনের চিয়াংসু প্রদেশে ৫ এপ্রিল ছিংমিং ফেস্টিভ্যাল বা সমাধি পরিষ্কার দিবস উপলক্ষ্যে মিষ্টি সবুজ চালের বল- ছিংতুয়ান খাওয়া পুনর্মিলনের এবং বসন্তের আন্তরিক অনুভূতি প্রাকশের প্রথা।

এ বছর, কিছু রেস্তোরাঁ তরুণ ভোক্তাদের কাছে ঐতিহ্যবাহী এ খাবারকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে ছিংতুয়ানে কাঁকড়ার মাংস যোগ করেছে।

চায়না ফুড ফেস্টিভ্যাল ২০২৩ সারা বছর ধরেই চলবে, এবং ক্যাটারিং শিল্পকে চাঙ্গা করতে ৭০টির মতো ইভেন্টের আয়োজন করবে।

 

৩. চিরায়ত চীনা সাহিত্য

কবি লি শ্যন: কৃষক-জীবনের ভাষ্যকার

থাং রাজবংশের একজন বিখ্যাত কবি লি শ্যন। তাকে ডিউক ওয়েনসু অব চাও বা চাওয়ের জমিদার ওয়েনসু নামেও ডাকা হয়। কুংছুই নামেও পরিচিত ছিলেন লি শ্যন।

লি শ্যনের জন্ম ৭৭২ খ্রিস্টাব্দে উসি শহরে। তবে তার জন্মসাল নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তিনি অভিজাত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তার প্রপিতামহ চ্যান্সেলর ছিলেন। তার পিতামহ এবং পিতা দুজনেই জেলা প্রশাসক ছিলেন।

মাত্র পাঁচ বছর বয়সে বাবাকে হারান লি শ্যন। বাবার মৃত্যুর পর তাকে প্রতিপালন করেন মা লেডি লু। মা তাকে কনফুসিয়াসের রচনাবলী শিক্ষা দেন। লি শ্যন দেখতে ছিলেন ছোটখাটো। কিন্তু তিনি বেশ চটপটে বালক ছিলেন। কবিতা লিখতেন, গানের কণ্ঠও ছিল চমৎকার। এলাকায় কবি হিসেবে তার খ্যাতিও ছড়িয়ে পড়ে।

লি শ্যন সরকারি চাকরির জন্য চিনশি পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হন। রাজকীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নিযুক্ত হন লি শ্যন। কিন্তু সেই চাকরি তার পছন্দ না হওয়ায় বাড়ি ফিরে যান।

এখানকার স্থানীয় যুদ্ধবাজ নেতা লি ছি’র সঙ্গে তার বিরোধ বাঁধে। কিছুদিন জেলখানাতেও থাকতে হয়। তবে লি ছির মৃত্যুর পর তিনি মুক্তি পান।  তিনি বেশ কয়েকজন সম্রাটের অধীনে বিভিন্ন পদে চাকরি করেন।

৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন লি শ্যন। সারা চাকরি জীবন তাকে অনেক টানাপোড়েন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, উত্থান পতনের ভিতর দিয়ে এগুতে হয়। অনেক বৈরিতা ও রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রেরও শিকার হন এই কবি। তবে তার কবিতার জনপ্রিয়তা কখনও কমেনি। তার কবিতায় চীনের কৃষক ও সাধারণ মানুষের দুঃখ প্রতিফলিত হয়েছে। লি শ্যনের একটি বিখ্যাত কবিতা ‘কৃষকরা’। শ্রোতাদের জন্য শোনাচ্ছি কবিতাটি। কবিতাটি দুই ভাগে বিভক্ত।

বসন্তে বপন করা প্রতিটি বীজ

শরতে আনবে সোনালি ফসল ।

উর্বর জমিতে কি ফল

যখন ক্ষুধায় মরাই কৃষকের নিয়তি।

তীব্র দুপুরে তারা আগাছা নিড়ায়

মাটিতে ঘাম ঝরে পড়ে

কেউ কি জানে কতটা শ্রমের বিনিময়ে

তৈরি হয় এক বাটি ভাত?

চীনের পরিশ্রমী দরিদ্র কৃষক জীবনের এমন বাস্তব বর্ণনা থাং যুগের খুব কম কবির লেখাতেই মেলে। আর এখানেই কবি লি শ্যন তার অনন্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে অমর হয়ে আছেন।

----------------------------------------------------------------------

প্রতিবেদন ও কণ্ঠ: রওজায়ে জাবিদা ঐশী, মাহমুদ হাশিম, শান্তা মারিয়া

কবিতা অনুবাদ: শান্তা মারিয়া

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম।

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।