আকাশ ছুঁতে চাই ১১
2023-03-30 17:53:04

কী আছে এবারের পর্বে

১. গৃহবধূ থেকে ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা

২. বইকে পুনর্র্জীবন দেন যে নারী

৩. নারী প্রত্নতাত্ত্বিক দল

নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারীর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।

 

গৃহবধূ থেকে ব্র্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা

 

গ্রামের একজন গৃহবধূ থেকে একজন সংগ্রামী নারী হয়ে উঠলেন চীনের অন্যতম সেরা চিলি সস ব্র্যান্ডের নির্মাতা। তার নাম থাও হুয়াবি। তবে লাও কান মা ব্র্যান্ডের নামেই তার পরিচিতি। চলুন শোনা যাক কিভাবে এই ব্র্যান্ড সৃষ্টি করলেন সাহসী নারী থা হুয়াবি। শুনবেন আমার তৈরি একটি প্রতিবেদন।

থাও হুয়াবি এক অনুপ্রেরণার নাম। নিজের নামের চেয়েও তিনি বেশি পরিচিত তার ব্র্যান্ড চিলি সস লাও কান মা নামে।

                                               

১৯৪৭ সালে চীনের কুইচোও প্রদেশের মেইথান কাউন্টির এক গ্রামে দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম। বেড়ে ওঠাও চরম দারিদ্র্যের মধ্যে। লেখাপড়াও শিখতে পারেননি অভাবের কারণে।

২০ বছর বয়সে স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক দলের একজন হিসাব রক্ষকের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। অভাবের সংসার হলেও দাম্পত্য জীবনে সুখী ছিলেন থাও। জন্ম হয় দুই ছেলের। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন থাওর স্বামী। স্বামীর চিকিৎসার খরচ ও দুই শিশু সন্তানকে প্রতিপালনের জন্য গৃহবধূ থাওকে রোজগারে নামতে হয়। তিনি শহরের একটি কারখানায় শ্রমিকের কাজ নেন। স্বামীর মৃত্যু হলে তিনি সন্তানদের দেখাশোনার জন্য নিজের ছোট শহরে ফিরে আসেন। সেখানে রাস্তার ধারে বসে ভাত এবং তরকারি বিক্রি করে সংসার চালানো শুরু করেন।

১৯৮৯ সালে থাও কুইইয়াং শহরে ছোট্ট একটি রেস্টুরেন্ট খোলেন। এখানে নুডুলস বিক্রি করা শুরু করেন। সাধারণ নুডুলসকে সুস্বাদু করার জন্য তিনি তার নিজস্ব রেসিপিতে তৈরি স্পাইসি হট সস এবং সয়াবিন যোগ করতেন। দরিদ্র ছাত্রছাত্রী ও ট্রাক চালকদের মধ্যে তার তৈরি খাবার খুব জনপ্রিয়তা পায়। কারণ সেটা স্বাদে ভালো, দামে কম। আর দরিদ্র শিক্ষার্থীদের তিনি একটু বেশি করে খাবার দিতেন, কখনও কখনও পয়সাও নিতেন না। তারা তাকে লাও কান মা বা বয়স্ক মা নামে ডাকা শুরু করে।

থাও খেয়াল করেন অনেকে তার দোকানে আসে শুধু সস কেনার জন্য। ১৯৯৬ সালে তিনি লাও কান মা নামে সস তৈরির একটি কারখানা খোলেন। তার বিশেষ রেসিপিতে তৈরি চিলি সস লাও কান মা দারুণ জনপ্রিয়তা পায়।

গত ২৭ বছরে লাও কান মা চীনের অন্যতম বৃহৎ ‍চিলি সস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ১৩০ টি দেশ ও অঞ্চলে এই সস রপ্তানি হয়। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান ও সাউথ আফ্রিকায় এই ব্র্যান্ড খুব জনপ্রিয়। লাও কান মার বার্ষিক বিক্রি কয়েক বিলিয়ন ইউয়ান।

তার এই সাফল্যের রহস্য বিষয়ে থাও হুয়াবি বলেন, ‘আমি সবসময় গুণগত মানকে প্রাধান্য দেই। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি ভালো কিছু তৈরি করে আমার ক্রেতাদের দিতে। কোম্পানির মুনাফার চেয়ে সুনাম আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

থাও হুয়াবি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একজন সক্রিয় সদস্য। প্রবীণ এই নারী এখনও দারুনভাবে কর্মক্ষম এবং একদিকে যেমন ব্যবসা সামলাচ্ছেন তেমনি সমাজসেবামূলক কাজও করে চলেছেন।

বইকে পুনর্জীবন দেন যে নারী

প্রাচীন গ্রন্থকে ভালোবেসে নতুনভাবে তাদের জীবন দান করেন এক নারী। চলুন শোনা যাক তার কথা।

সং চিং একজন বইপ্রেমী নারী। তবে বিশেষভাবে তিনি ভালোবাসেন প্রাচীন পাণ্ডুলিপি। ৩৪ বছর বয়সী সং চাকরি করেন বেইজিংয়ে ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব চায়নার প্রাচীন বইয়ের পুনর্জীবন বিভাগে।

চীনের জাতীয় লাইব্রেরিতে রয়েছে ৩ মিলিয়ন প্রাচীন গ্রন্থ। এর মধ্যে আছে প্রাচীন পান্ডুলিপি, গ্রন্থ, এবং বিভিন্ন নথি ও দলিল। ২০১১ সালের আগের এসব পুরনো নথিপত্রে চীনের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আছে।

প্রাচীন চীনের অনেক হাতে লেখা পান্ডুলিপি একেবারে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। সেগুলোকে সংরক্ষের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। এজন্য অনেক ধৈর্য, দক্ষতা ও মমতার প্রয়োজন।

শৈশব থেকেই প্রাচীন এতিহাসিক নিদর্শন ও গ্রন্থের প্রতি আকর্ষণ ছিল সংয়ের। তিনি স্বপ্ন দেখতেন বড় হয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো রক্ষা করবেন।

তিনি বলেন, আমার খুব অবাক লাগতো কিভাবে মাটির নিচ থেকে ধূসর হয়ে যাওয়া ভঙ্গুর সব মূল্যবান নিদর্শন উদ্ধার করা হয়।

ইতিহাসের প্রতি স্কুল জীবন থেকেই তার আগ্রহ ছিল প্রচুর। সং তার অবসর সময়ে ঘন্টার পর ঘন্টা মিউজিয়ামে থাকতেন এবং এ বিষয়ক বই পড়তেন।

২০১৫ সালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন করেন সং। তার বিষয় ছিল সাংস্কৃতিক নিদর্শন সুরক্ষা। এরপর তিনি প্রাচীন গ্রন্থ সুরক্ষার উপর বিশেভাবে শিক্ষাগ্রহণ করেন। সং ১০০টি সাংস্কৃতিক নিদর্শন রেসটোরেশনের কাজ করেছেন। যার মধ্যে আছে ছিং রাজবংশের সম্রাট ছিয়ানলোং এবং সম্রাজ্ঞী তোয়াকার সিশির লেখা।

সং এবং তার সহকর্মীরা চীনা ইতিহাসের অমূল্য নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করছেন। সং প্রাচীন বইকে নতুনভাবে গড়ে তোলেন। পাশাপাশি তিনি এ বিষয়ক প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তিনি এ বিষয়ে বক্তব্যও রাখেন। তিনি মনে করেন আগামিতে তরুণ প্রজন্ম এই পেশায় আসতে পারে। প্রাচীন গ্রন্থ ও নথিপত্র সংরক্ষণের মাধ্যমে চীনের সাংস্কৃতিক নিদর্শন ও এীতহ্য সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন সং চিং।

 

নারী প্রত্নতাত্ত্বিক দল

সকাল সন্ধ্যা মাটি খননের কাজে ব্যস্ত একদল প্রত্নতাত্ত্বিক নারী। দক্ষিণ পশ্চিম চীনের ছোংছিং মিউনিসিপাল্টিতে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খোজে এভাবেই দিন রাত কাজ করছেন তারা। এই সময়গুলোতে দলের সবার সময় কাটে একসাথে। খাওয়া ,ঘুম ও মাঠে কাজ করা নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে চলতে থাকে। সম্প্রতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কারের অনেকটা পথ এগিয়ে এসেছেন  তারা। আবহাওয়ার পরিবর্তন সহজ করে দিয়েছে তাদের কাজ। এই নারী প্রত্নতাত্ত্বিক দলের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত শুনবো  আফরিন মিমের প্রতিবেদনে।

প্রত্নতত্ত্ব ইনস্টিটিউটের নারী প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতা ইয়ান নি। একদল নারী প্রত্নতাত্ত্বিক সহকর্মীকে নিয়ে পরিচালনা করছেন ধ্বংসাবশেষ খুঁজে বের করার কাজ।

দক্ষিণ পশ্চিম চীনের ছোংছিং মিউনিসিপাল্টিতে প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের খোজেই সকাল থেকে সন্ধ্যা কাটছে এই দলের।

জানা যায়, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এই প্রত্নতাত্ত্বিক ইনিস্টিটিউট। ইতিমধ্যেই শেষ করেছেন মাঠ পর্যায়ের ১২টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন  খননের কাজ। বিগত ১২ টি সফল খনন কাজে পুরুষ প্রত্নতাত্ত্বিকরা কাজ করলেও এবার মাঠ পর্যায়ে ইয়ান নির পরিচালনায় চলছে নারীদের খনন কাজ। ইয়ান নি বলেন,

"আমি যখন প্রথম কাজ শুরু করি, তখন আমাদের ইনস্টিটিউটে কম নারী প্রত্নতাত্ত্বিক ছিলেন।  কিন্তু বর্তমানে প্রতি বছর নতুন নারী প্রত্নতাত্ত্বিক যোগ দিচ্ছেন৷ তাছাড়া চীন প্রত্নতাত্ত্বিক কাজে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তাই প্রতিনিয়তই দেখছি নারীরা আগ্রহী হয়ে উঠছেন এ কাজে। আমরা আশা করছি ভবিষ্যতে এ পেশায় আরও নারী যুক্ত হবেন”।    

খনন কাজ প্রত্নতাত্ত্বিক কাজের মূল অংশ। তবে এই মূল কাজের জন্য খুব বেশিদিন ব্যয় করতে হয় না তাদের। বছরের ৩৬৫ দিনের মধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মাঠে কাজ করার পর আরও ২০০ দিনের মত কাজ করতে হয়। তবে সেই কাজ আর মাঠ পর্যায়ের না। প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ে পড়ালেখার পাশপাশি প্রতিবেদনও লিখতে হয় তাদের। সব ধরনেরই কাজই এখন নারীরা করতে পারছেন বলে জানান ইয়ান নি।

তিনি বলেন, "আমরা নয়জন এখন স্বাধীনভাবে খনন পরিচালনার জন্য দলটিকে নেতৃত্ব দিতে পারি।  এদের মধ্যে কেউ কেউ শিক্ষানবিশদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছে"।

এইদলেরই আরেক সদস্য ৪৬ বছর বয়সী চু সুয়েলিয়ান। তিনি মূলত প্রত্নতাত্ত্বিক চিত্র কর্ম করে থাকেন । তিনি বলেন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কাজ সহজ হয় এই চিত্র কর্ম অনুসরণ করলে। 

এই দলেরই দুই সদস্য মা চিয়াওচিয়াও ও লি ফেং। প্রতিষ্ঠানের শুরু থেকেই এখানে কাজ শুরু করেন তারা। এদের মধ্যে মা নিয়োজিত আছেন উদ্ভিদ প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে ,আর প্রাণী প্রত্নতাত্ত্বিক হিসেবে নিয়োজিত আছেন লি ফেং।

 

সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।

অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাই চিয়েন।

সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া,  

নারী প্রত্নতাত্ত্বিক দল প্রতিবেদন: আফরিন মিম

অডিও এডিটিং: রফিক বিপুল