মার্চ ২৯: অনেক মার্কিন পরিবারের কাছে ২৭ মার্চ একটি ভয়াবহ দুঃখের দিন। এদিন সকালে টেনেসি রাজ্যের ন্যাশভিল শহরের একটি প্রাথমিক স্কুলে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। হামলায় মাত্র ৯ বছর বয়সী তিনটি শিশু এবং তিনজন বয়স্ক মানুষ প্রাণ হারায়। যা ২০২২ সালের মে মাসে টেক্সাস রাজ্যে প্রাথমিক স্কুলে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুতর স্কুলে হামলার ঘটনা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এ বিষয়ে বলেন, এমন দুর্ঘটনা যে কোনো পরিবারের জন্য সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন।
কেন এমন ঘটনা বার বার ঘটে, আমাদের শিশুরা কেন প্রাণ হারায়। ন্যাশভিল শহরে এদিন আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনৈক নারী এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেন। এমন দুঃস্বপ্ন বার বার ঘটেছে, নিশ্চয় কোথাও সমস্যা আছে। মঙ্গলবার চীন সরকারের প্রকাশিত ‘২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন রিপোর্ট’ বিশ্বের কাছে এ ধরনের ঘটনার পিছনের বাস্তবতা প্রকাশ করেছে।
এই ১৮ হাজার অক্ষরের রিপোর্টে বিভিন্ন উদাহরণ এবং বাস্তব সূচকের মাধ্যমে গেল এক বছরে মার্কিন নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা বঞ্চিত হওয়ার বাস্তব অবস্থা তুলে ধরেছে। এতে বলা হয়, বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের স্কুলগুলোতে সবচেয়ে বেশি গুলির ঘটনা ঘটে। ২০২২ সালে এমন ৩০২টি ঘটনা ঘটেছে। যা ১৯৭০ সালের পর সবচেয়ে বেশি। এখন গুলির আঘাত যুক্তরাষ্ট্রে শিশু মৃত্যুর শীর্ষ কারণ।
বর্তমানে দেশটির নাগরিকদের নিরাপত্তা নেই। এ অবস্থায় মার্কিন নির্বাচন ধনী মানুষদের খেলায় পরিণত হয়েছে, বর্ণবৈষম্য আরো বাড়ছে। ধনী ও দারিদ্রের ব্যবধান বেড়েই চলেছে। মার্কিন স্টাইলের মানবাধিকার সম্বন্ধে নিজ দেশের জনগণের আস্থা ভেঙ্গে পড়ছে।
এনবিসি’র ২০২২ সালের ৯ নভেম্বর প্রকাশিত গণজরিপের ফল অনুযায়ী, ৭২ শতাংশ ডেমোক্র্যাটিক পার্টির ভোটার, ৬৮ শতাংশ রিপাবলিকান পার্টির ভোটার এবং ৭০ শতাংশ নিরপেক্ষ ভোটার মনে করেন, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েছে।
কেন লোকজন যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়েছে? এর দু’টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আছে: একটি হল অর্থ, আরেকটি হল রাজনৈতিক পার্টির দ্বন্দ্ব। যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিকে অপহরণ করছে অর্থ। ‘অর্থের সঙ্গে প্রতিশোধের’ সম্পর্ক রয়েছে। রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়, ২০২১ সালের পহেলা জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, যুক্তরাষ্ট্রে কোটিপতিদের রাজনৈতিক অবদান ফেডারেল রাজনৈতিক প্রকল্পে মোট অবদানের ১৫ শতাংশ। ফরচুন ম্যাগাজিন উল্লেখ করেছে যে, অল্প সংখ্যক অতি ধনী শ্রেণীর মানুষ তাদের অর্থনৈতিক মর্যাদা দিয়ে সরকারি নীতি ব্যবহার করতে পারে, যাতে এসব নীতি তাদের সেবা করে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে জনগণের শক্তির অভাব দেখা যায়। এ অবস্থায় কে জনগণকে গুরুত্ব দেয়- তা নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
আবার রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্বের দিকে দেখুন। রাজনীতির মেরুকরণ ইতোমধ্যে মার্কিন রাজনীতির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছর দুই রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্ব ও বৈরিতা অনেক অবনতি হয়েছে। এর ফলে সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, দেশের রাজনীতি ভালোভাবে কাজ করতে পারছে না। গভট্র্যাক (govtrack) ওয়েবসাইটের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, মার্কিন কংগ্রেসে আইন প্রণয়নকারীর সংখ্যা ৪২৪৭ থেকে মাত্র ২০৮১টিতে নেমে এসেছে। যখন রাজনৈতিক স্বার্থ ও গ্রুপের স্বার্থ শীর্ষে থাকে, তখন জনস্বার্থ নিশ্চয় অগ্রাধিকার পাবে না।
নিজ দেশের মানবাধিকার অবস্থা খারাপ ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তবে সরকার তা উপেক্ষা করছে এবং মানবাধিকারকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। ২০ মার্চ হল ইরাক যুদ্ধের ২০তম বার্ষিকী। মার্কিন রাজনৈতিক মহল এ বিষয়ে আত্মসমালোচনা করেনি, বরং অব্যাহতভাবে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের নামে হাঙ্গামা ও যুদ্ধ সৃষ্টি করছে, একতরফা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যাচ্ছে। যা বিশ্বশান্তি ও উন্নয়ন ধ্বংস করছে।
বাস্তবতা বার বার প্রমাণ করেছে যে, অজুহাত যত সুন্দরই হোক না কেন, মার্কিন সরকার দেশের অভ্যন্তরে বিশেষ শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করছে এবং বিদেশে আধিপত্যবাদ প্রয়োগ করছে। এভাবে বাস্তবতা গোপন করা যাবে না। মার্কিন স্টাইলের মানবাধিকার মার্কিন নাগরিকদের সবচেয়ে ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন এবং সারা বিশ্বের দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।
(শুয়েই/তৌহিদ/আকাশ)