চীনা নাবিক চেই মো’র গল্প
2023-03-22 09:24:35


২০২১ সালের ৩০ জুন চাই মো ও আরও দু’জন নাবিক শাংহাই থেকে রওনা হন। তার ঠিক এক মাস পর তারা বেরিং প্রণালী অতিক্রম করে সুমেরুবৃত্তে প্রবেশ করেন। সুমেরুবৃত্তকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এ রুটকে মৃত্যুর রুট বলে ডাকা হয়। অনেক নাবিক এখানে প্রাণ হারিয়েছেন। এ রুটের সংশ্লিষ্ট সমুদ্রও রহস্যময় মৃত্যুকূপ হিসেবে পরিচিত।

 

যখন বরফে পাল তোলে তিনজন পালাক্রমে ডিউটি দেন, তখন অন্তত একজনকে জেগে থাকতে হয়। পঞ্চাশ কিলোমিটার ভাসমান বরফ রুটে যেতে তাদের ১১ ঘণ্টার মতো সময়  লাগত।

 

প্রতিবার যাত্রার জন্য দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি সেরে নেন চেই মো। বিপজ্জনক হলেও সমুদ্র যাত্রার প্রতি তার ভালবাসা কখনও পরিবর্তন হয়নি। ইচ্ছে করে একটা নৌকা কিনেন তিনি এবং তার যাত্রা ওই মুহূর্ত থেকে শুরু হয়।

 

১৯৬৮ সালে শান তুং প্রদেশের থাই আন শহরের একটি খনি শ্রমিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন চেই মো। তার বাবা তাকে মো নাম দিয়েছেন, চীনা ভাষায় তার অর্থ কালি। পরে তিনি শানতুং একাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটসে ভর্তি হন এবং একজন চিত্রকর হন। ২০০০ সালে তিনি নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে একটি চিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করেন এবং সেখানে ডেভিড নামে একজন নরওয়েজিয়ান নাবিকের সঙ্গে পরিচিত হন। সত্তর বছর বয়সী ডেভিড ওই সময়ে পালতোলে দেড় বার পৃথিবী ঘুরেছেন। ডেভিড তাকে জানিয়েছেন, একটি নৌকা দিয়ে বিশ্বের ৭০ শতাংশ জায়গায় যাওয়া যায় এবং কোন ভিসা লাগবে না।

 

পরিবর্তী দিন চেই মো নৌকা কিনতে গেলেন।  তার চিত্র বিক্রি করে টাকা নিয়ে ৩ লাখ ইউয়ান মূল্যের পুরাতন পালতোলা একটি নৌকা কিনেন তিনি। বিশ বছরের প্রাচীন এ নৌকাকে নাম দিয়েছেন পাই ইউন, তার অর্থ সাদা মেঘ। যেখানে নৌকা তিনি কিনলেন, সেখান থেকে অকল্যান্ডের মধ্যে রয়েছে ৫ ঘণ্টার সমুদ্র যাত্রা। তাই এ যাত্রার মাধ্যমে এ নৌকার আগের মালিক চেই মোকে মৌলিক পালতোলা কৌশল শিখিয়েছেন। যখন তারা অকল্যান্ডে পৌঁছেছেন, তখন চেই মো প্রায় পালতোলা নৌকা চালানো শিখে গেছেন।

 

বিশ দিন পর চেই মো এ নৌকা চালিয়ে উত্তর নিউজিল্যান্ড ঘুরেছেন এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরে গেছেন। দশ বর্গমিটারের এ নৌকায় তার সব লাগেজ আছে। নিজের একটি ছোট বাড়ি চালিয়ে তিনি বাতাসের দিক, সমুদ্রের স্রোত, জোয়ারসহ নানা তথ্য শিখেছেন।

 

২০০৭ সালের ৬ জানুয়ারি চেই মো চীনের রি চাও শহর থেকে রওনা হয়েছেন। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে বের হয়ে জাকার্তা, মাদাগাস্কার, কেপ অব গুড হোপ, পানামা অতিক্রম করে মোজাম্বিক চ্যানেল, ক্যারিবিয়ান সাগর ক্রস করে ভারত মহাসাগর, আটলান্টিক মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর অতিক্রম করে ২০০৯ সালের ১৬ আগস্ট রি চাও শহরে ফিরে এসেছেন। মোট ৩৫,০০০ নটিক্যাল মাইল এ যাত্রায় তিনি পারি দিয়েছেন।

 

ক্যাপ্টেন, নাবিক, ডাক্তার, কুক, মেকানিক ও রক্ষণাবেক্ষণ কর্মী-সব দায়িত্ব চেই মো’কেই পালন করতে হয়েছে। তিনি বলেছেন, সমুদ্রে শুধু নিজের উপর নির্ভর করতে হয়। যার মানে তিনি সব কিছু করতে পারেন। তিনিও স্বীকার করেন, তার কষ্ট লাগে কখনও কখনও। বড় বড় ঢেউ আছড়ে পড়ে, ভয় লাগে, একাকীত্ব আছে, তবে এমন নিঃসঙ্গতা তিনি উপভোগ করেন। চিত্রশিল্পী হিসেবে তিনি নিঃসঙ্গতা পছন্দ করেন।

 

বর্তমানে নৌ যাত্রার মাধ্যমে তিনি যেমন স্বাধীনতা অর্জন করেছেন, তেমনি তিনি অন্য কিছুও লাভ করেছেন। যাত্রায় তিনি অনেক ছবি তুলেছেন। আইসবার্গ, লেজার, সামুদ্রিক পাখি, তিমি-সবই তার ছবিতে আসে। পাশাপাশি, তিনি জনপ্রিয় বিজ্ঞান রাষ্ট্রদূত হয়েছেন। তিনি আশা করেন, তার যাত্রার মাধ্যমে  আরও বেশি মানুষ সমুদ্র, প্রকৃতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর দৃষ্টি রাখবে।

 

পালতোলা নৌকা এখনও চীনে জনপ্রিয়। চেই মোকে নতুন স্বপ্ন দেখান। বিশ্বের অনেক বড় আকারের প্রতিযোগিতা ইউরোপে উদ্ভূত হয়।  যেমন: ট্যুর ডি ফ্রান্স ও অলিম্পিক গেমস ইত্যাদি। তিনি আশা করেন যে ভবিষ্যতে চীনের উদ্যোগে বিশ্ব পর্যায়ের পালতোলা নৌকা প্রতিযোগিতা আয়োজিত হবে।

 

পঞ্চাশোর্ধ চেই মো এখনও পালতোলা যাত্রা উপভোগ করছেন। তার মতে, চ্যালেঞ্জ করতে থাকুন, নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে থাকুন এবং সমুদ্রে প্রবাহিত দৃশ্য উপভোগ করতে থাকুন-এর চেয়ে ভালো আর কোনো কিছুই নেই।

 

(শিশির/এনাম/রুবি)