দেহঘড়ি পর্ব-০১০
2023-03-19 20:54:30

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং চীনা জীবনধারা নিয়ে পরামর্শ ‘হেলথ টিপস’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

হেপাটাইটিস চিকিৎসায় টিসিএম

হেপাটাইটিস হলো লিভার বা যকৃতের প্রদাহ। লিভার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা পুষ্টি প্রক্রিয়াকরণ করে, রক্তকে পরিশোধন করে এবং সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে। লিভার যখন স্ফীত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন এর কার্যকারিতা হ্রাস পায়। ভারী অ্যালকোহল গ্রহণ, বিষাক্ত পদার্থ, কোনও কোনও ওষুধ ও কিছু রোগের কারণে হেপাটাইটিস হতে পারে।

হেপাটাইটিস সংক্রমণের পাঁচটি ধরন রয়েছে। এগুলো হলো হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি, হেপাটাইটিস-ডি এবং হেপাটাইটিস-ই। এসব ভাইরাল সংক্রমণ লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যার ফলে প্রদাহ হয়। এটা লিভার সিরোসিস বা লিভার ফাইব্রোসিস নামে পরিচিত। 

হেপাটাইটিস দূষিত খাবার ও পানি এবং অস্বাস্থ্যকর রান্নাঘরের মাধ্যমে ছড়াতে পারে। হেপাটাইটিস-এ ও ই ভাইরাস পানি বা খাদ্যের মাধ্যমে পরিবাহিত হয়। দূষিত পানিতে থাকা কাঁচা শেলফিশের মতো পদার্থ খাওয়ার কারণে কিংবা সঠিকভাবে হাত না ধোয়ার কারণে হেপাটাইটিস-এ বা হেপাটাইটিস-ই ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে কোনও ব্যক্তি। হেপাটাইটিস-বি ও হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস, রক্ত ও বীর্যের মতো শারীরিক তরল পদর্থের মাধ্যমে ছড়ায়। সেকারণে যৌনসংসর্গ কিংবা একাধিক ব্যক্তি একই ইঞ্জেকশনের সূঁই ব্যবহার করলে তার মাধ্যমে এ রোগ ছড়াতে পারে, অথবা একজন নারী জন্মের সময় শিশুর মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে দিতে পারে। যারা এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত তাদের মধ্যে হেপাটাইটিস একটি সাধারণ ঘটনা। 

হেপাটাইটিসের সাধারণ উপসর্গ

হেপাটাইটিস-বি বা হেপাটাইটিস-সি’র উপসর্গ সংক্রমণের কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস বা কোনও কোনও ক্ষেত্রে কয়েক বছরেও দেখা না দিতে পারে। কোনও কোনও মানুষ, বিশেষ করে শিশুরা হেপাটাইটিসের কোনও লক্ষণ অনুভব করেনা। সবচেয়ে সাধারণ হেপাটাইটিস উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে:

পেটের ডান দিকে ব্যথা অনুভব করা

লিভার এলাকায় ফুলে যাওয়া, পেট ফুলে যাওয়াএবং লিভারে তরল জমা হওয়া

জন্ডিস হওয়া এবং চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া

প্রস্রাব গাঢ় ও কালো হওয়া

মলের রঙ হালকা হয়ে যাওয়া কিংবা মাটির রঙ ধারণ করা

ক্লান্তি অনুভব করা

বমি বমি ভাব হওয়া

শরীরে জ্বর থাকা

ক্ষুধামন্দা দেখা দেওয়া

অস্থিসন্ধিতে ব্যথা অনুভূত হওয়া

সহজেই রক্তপাত হওয়া বা সহজেই ক্ষত হওয়া হেপাটাইটিসসি’র সম্ভাব্য উপসর্গ। ত্বকে ফুসকুড়ি বা চুলকানি, সামান্য ফোসকা, বা সোরিয়াসিসের মতো ত্বকের চুলকানিও হেপাটাইটিস সি’র লক্ষণ।

টিসিএম ব্যবস্থায় হেপাটাইটিসের উপসর্গ:

ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসা ব্যবস্থা বা টিসিএমে মনে করা হয়, অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলো লিভারের সঙ্গে একত্রে কাজ করে। এবং এর মধ্য দিয়ে রক্ত পরিষ্কার করতে এবং তা শরীরের বিভিন্ন অংশে পৌঁছে দিতে লিভারকে সাহায্য করে। তবে লিভার বা এসব সাহায্যকারী অঙ্গে মূল শক্তি বা ‘ছি’ কিংবা এর উষ্ণশক্তি ইয়াং অথবা ঠান্ডাশক্তি ইয়িনে কোনও ভারসাম্যহীনতা তৈরি হলে হেপাটাইটিস হতে পারে।

লিভারের ‘ছি’য়ের স্থবিরতার কারণে হেপাটাইটিস হলে বমি বমি ভাব হয়, ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, পেট ফুলে যায়। প্লীহা বা কিডনিতে ইয়াংয়ের ঘাটতিজনিত কারণে হেপাটাইটিস হলে ক্ষুধামন্দা দেখা দেয়, মল আলগা ও বর্ণহীন হয়ে যায়, দুর্বলতা অনুভূত হয় এবং বেশি হারে পেশী নষ্ট হয়। লিভার ও পিত্তথলিতে ক্লেদ ও তাপ জমার কারণে এ রোগ হলে জন্ডিস দেখা দেয়, চোখ ও ত্বক হলুদ হয়ে যায়, জ্বর আসে এবং বমি বমি ভাব অনুভূত হয়। লিভার ও কিডনিতে ইয়িন ঘাটতিজনিত কারণে হেপাটাইটিস হলে মাথা ব্যথা হয়, মাথা ঘোরে, নারীদের ঋতুচক্রে অনিয়ম দেখা দেয়, অস্থিসন্ধি শক্ত হয়ে যায়, ঘুম বিঘ্নিত হয় এবং কানে রিং বাজার মতো শব্দ হয়।

চিকিৎসা

বিভিন্ন ক্লিনিকাল ট্রায়ালে দেখা গেছে, যারা দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস-বি রোগী তাদের লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করতে পারে বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী চীনা ভেষজ ফর্মুলেশন। এছাড়া যেসব ভেষজ প্লীহার কার্যকারিতা বাড়ায়, সেগুলো শরীর থেকে ভাইরাস দূর করতে এবং যকৃতকে সুস্থ করতে সহায়তা করে। উপযুক্ত ডায়েট ও পুষ্টি লিভার ও অন্যান্য অঙ্গগুলোকে শক্তিশালী করা, সেগুলোর শক্তির মধ্যে ভারসাম্য আনা এবং অঙ্গগুলো থেকে বিষাক্ত পদার্থ দূর করার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। হেপাটাইটিস থেকে মুক্তি পেতে টিসিএম চিকিৎসকরা রোগীর লক্ষণ অনুযায়ী একটি ডায়েট ঠিক করে দেন। এর বাইরে তারা আরও কিছু উপদেশ দিয়ে থাকেন, যেমন পরিমিত পরিমাণ তরল পান করুন, অ্যালকোহল এড়িয়ে চলুন ইত্যাদি।

দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস-বি এবং হেপাটাইটিস-সি সংক্রমণের চিকিত্সা তুলনামূলকভাবে কঠিন, তবে অসম্ভব নয়। হেপাটাইটিস-বি’র জন্য প্রচলিত অ্যান্টিভাইরাল থেরাপির পাশাপাশি ভেষজ ব্যবহার ও আকুপাংচার লিভারের ক্ষতিরোধ করতে এবং তার কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে, যার ফলে রোগীরা দীর্ঘস্থায়ী ভাইরাল সংক্রমণ থেকে সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়ে উঠতে পারে। 

আকুপাংচার

দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস-বি সংক্রমণের রোগীরা এমন উপসর্গ প্রদর্শন করে, যা আকুপাংচার চিকিৎসকদের একটি নির্দিষ্ট সিনড্রোম প্যাটার্ন চিনতে সাহায্য করে। এর ফলে তারা লিভার ও অন্যান্য অঙ্গগুলোর শক্তির ঘাটতি ও ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য আকুপাংচার পয়েন্ট নির্বাচন করতে সক্ষম হন।


#চিকিৎসার_খোঁজ

ওয়েস্ট চায়না কলেজ অব স্টোমাটোলজি

ওয়েস্ট চায়না কলেজ অব স্টোমাটোলজি দক্ষিণপশ্চিম চীনে অবস্থিত সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েস্ট চায়না মেডিকেল সেন্টারের অধীন একটি চিকিৎসাসেবা ও চিকিৎসাশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এটি ছিল দন্তরোগ বিষয়ে চীনের প্রথম প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। ‘রেনজি ডেন্টাল ক্লিনিক’ নামে ১৯০৭ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এর ৫ বছর তারপর ১৯১২ সালে চীনের প্রথম ডেন্টাল হাসপাতালে রূপান্তরিত হয়। চীনের আধুনিক দন্তবিদ্যার জন্মস্থান হিসাবে পরিচিত এ প্রতিষ্ঠানটি দন্তচিকিৎসা ও দন্তবিজ্ঞানের উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

 গত এক শতাব্দি ধরে ওয়েস্ট চায়না কলেজ অব স্টোমাটোলজি দন্তবিদ্যায় চীনের উচ্চ শিক্ষার মক্কা হিসাবে খ্যাতি উপভোগ করছে। এটি শুধু দেশের শীর্ষ শিক্ষাবিদ ও দন্তবিজ্ঞানের নেতৃস্থানীয় পণ্ডিতদেরই লালন করে না, বরং যারা দেশের স্টোমাটোলজি কলেজগুলোর নেতৃত্ব দেয় তাদের মেরুদণ্ড হিসাবে ভূমিকা পালন করে। ওয়েস্ট চায়না কলেজ অব স্টোমাটোলজি শিক্ষা, চিকিৎসা ও গবেষণার একীকরণ এক মডেল গড়ে তুলেছে। এই কলেজে রয়েছেন ৪১৭ জন ফ্যাকাল্টি ও স্টাফ, যাদের মধ্যে ১২৮ জন সিনিয়র ফ্যাকাল্টি মেম্বার, ৩৮ জন পিএইচডি পর্যায়ের শিক্ষক এবং ৫৭ জন মাস্টার্স পর্যায়ের শিক্ষক। এ প্রতিষ্ঠানে ২৪টি গবেষণা উপ-ইউনিটসহ ৫টি বিভাগ রয়েছে, যেগুলো হলো স্টোমাটোলজি, ওরাল মেডিসিন, ওরাল ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারি, প্রস্টোডন্টিক্স ও অর্থোডন্টিক্স। এখানে ক্লিনিক্যাল সায়েন্স অব স্টোমাটোলজি এবং বেসিক সায়েন্স অব স্টোমাটোলজিতে ডক্টরাল পর্যায়ের শিক্ষাদান করা হয়। এখান থেকে দেওয়া হয়, ৫ বছরের ব্যাচেলর ডিগ্রি, ৭ বছরের মাস্টার্স ডিগ্রি এবং ৪ বছরের ডক্টরাল ডিগ্রি।

ওয়েস্ট চায়না হসপিটাল অব স্টোমাটোলজি দীর্ঘদিন ধরে চীনের শীর্ষ হাসপাতালগুলোর একটি হিসাবে গণ্য হয়েছে।  একটি ৫৪ হাজার ৫৪০ বর্গ-মিটারের ক্লিনিকাল ভবন, সাড়ে ৩শ ডেন্টাল ইউনিট এবং ২৬০টি ইন-পেশেন্ট শয্যা নিয়ে গঠিত এ প্রতিষ্ঠানটি চীনের দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের দন্তরোগ ও ম্যাক্সিলোফেসিয়াল সার্জারির কেন্দ্র হিসাবে কাজ করে। এখানে রয়েছে অত্যাধুনিক ডায়াগনস্টিক ও থেরাপিউটিক চিকিত্সার সম্পূর্ণ সুবিধা। এ  হাসপাতালের বহির্বিভাগ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৪ লাখ রোগী চিকিৎসা নেয় এবং ৪ হাজার রোগী ভর্তি হয়, যাদের মধ্যে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার রোগী শল্যচিকিৎসা গ্রহণ করে।


‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।