চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান ‘চলতি বাণিজ্য’
2023-03-17 16:30:49


চীন ও চীনের বাইরের দুনিয়ার ‘ব্যবসা-অর্থনীতি-বানিজ্যের হালচাল নিয়ে সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান

‘চলতি বাণিজ্য’

চলতি বাণিজ্যের ৯ম পর্বে থাকছে:

১. বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত চীন; চাঙ্গা হবে বাণিজ্য ও পর্যটন

২. ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় বহরে যুক্ত হচ্ছে চীনা সি-৯১৯ বিমান

৩. চীনের বাজার ধরতে মরিয়া টেসলা; আনছে নতুন মডেলের গাড়ি

বিদেশিদের জন্য উন্মুক্ত চীন; চাঙ্গা হবে বাণিজ্য ও পর্যটন

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: বিদেশিদের সব ধরনের ভিসা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ তথ্য জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, এই উদ্যোগের ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিসর আরও বাড়বে। এদিকে ফ্রান্স, ইতালি, ডেনমার্ক ও ব্রাজিলসহ বিশ্বের আরো ৪০টি দেশের সঙ্গে পর্যটন সেবা উন্মুক্ত করেছে চীন সরকার। ফলে এসব দেশে গ্রুপ ট্যুরও পরিচালনা করতে পারবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সিগুলো।

একপাশে চীনের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হেইলংচিয়াং আর অন্য পাশে রাশিয়া। চীনের অংশের নাম হেইহে আর রাশিয়ার অংশের নাম আমুর। চীন থেকে ভিন্ন নাম নিয়ে এ নদী বয়ে গেছে রুশ শহর ব্লাগোভেশচেঙ্কের দিকে। তবে এ দুই ভূ-খণ্ডকে যুক্ত করেছে এ নদীর উপর নির্মাণ করা একটি সেতু।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় সম্প্রতি খুলে দেওয়া হয়েছে চীন-রাশিয়া সীমান্তে প্রথম বারের মতো স্থাপন করা ব্লাগোভেশচেঙ্ক-হাইহে ব্রিজ ক্রসিং। কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়ার কেন্দ্রীয় কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান দিমিত্রি নভিকভ মনে করেন, এ উদ্যোগের ফলে  কেবল অর্থনীতি ও বাণিজ্যই লাভবান হবে না বরং দুই দেশের মানুষের যোগাযোগ, পর্যটন, সংস্কৃতি ও খেলাধুলার বিনিময় আরো বাড়বে।

দিমিত্রি নভিকভ, ডেপুটি চেয়ারম্যান, কমিউনিস্ট পার্টি অব রাশিয়া

“বর্তমানে করোনা বিষয়ক নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়ার ফলে দুই দেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক আরো গতি পাবে। বিশেষ করে দুই দেশের নাগরিকদের যাতায়াত ও বাণিজ্য আরো বাড়বে। ব্যবসায়ীক নানা কার্যক্রম দুই দেশের নাগরিকদের ব্যস্ততা বাড়লে পর্যটন বাড়বে, চীনারা রাশিয়ায় বেড়াতে আসবে, রুশরাও চীন সফর করবে।”

কেবল রাশিয়া নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের জন্য চীন সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছে বেইজিং। বিশেষ করে বিদেশী নাগরিকদের জন্য সব ধরনের ভিসা উন্মুক্ত করেছে চীন। সম্প্রতি চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই উদ্যোগের কথা উল্লেখ করে জানায়, এর ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিসর বাড়বে।

এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, ২০২০ সালের ২৮ মার্চের আগে ইস্যু করা ভিসাধারীরা এবং এখনো ভিসার মেয়াদ আছে এমন বিদেশীরা সরাসরি চীনে প্রবেশ করতে পারবেন। পাশাপাশি সব ধরনের শর্ত পূরণ করেন এমন নাগরিকদের যে কোন বন্দর থেকে ভিসা দেওয়া হবে। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, হংকং ও ম্যাকাও থেকে কুয়াংচৌ প্রদেশে গ্রুপ ট্যুরে ঘুরতে আসা বিদেশি এবং আসিয়ান দেশ থেকে কুয়াংসিচুয়াং স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চলে বেড়াতে আসা পর্যটকদের ভিসা ছাড়াই প্রবেশ সুবিধা বহাল রাখা হয়েছে।

এদিকে, দ্বিতীয় দফায় ফ্রান্স, ইতালি, ডেনমার্ক ও ব্রাজিলসহ বিশ্বের আরো ৪০টি দেশের সঙ্গে পর্যটন সেবা উন্মুক্ত করেছে চীন সরকার। ফলে এসব দেশে গ্রুপ ট্যুরও পরিচালনা করতে পারবে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও এজেন্সিগুলো। এই নারী পর্যটক বলছিলেন, এক সঙ্গে অনেকগুলো দেশ বেড়ানো যায় এমন পরিকল্পনা করছেন তারা। 

পর্যটক

“এখন ঘুরতে যাওয়ার অনেকগুলো পছন্দের তালিকা পাওয়া যাবে। বিশেষ করে ইউরোপীয় দেশগুলো খুব কাছাকাছি। কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়েই এসব দেশে পৌছে যাওয়া যায়।”

এই ঘোষণার পরই সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে সম্পৃক্ত এয়ারলাইন টিকেটিং ও হোটেল বুকিং সেবাও উন্মুক্ত করা হয়েছে। এই ঘোষণার পরই বিদেশে পর্যটন বিষয়ক ওয়েব অনুসন্ধানের সংখ্যা এক লাফে ৭৭ শতাংশ বেড়েছে। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশে পর্যটনের বিষয়ে খোজ খবর নেওয়ার পরিমাণ অন্তত ৪গুণ বেড়েছে বলে জানায় ভ্রমণ প্ল্যাটফর্ম তোংছেং ট্র্যাভেল।

কুয়ান চিয়ান, ট্র্যাভেল এজেন্সি কর্মী, কুয়াংচৌ সিটি

“দ্বিতীয় দফায় ব্রাজিল, চিলি ও উরুগুয়ের নাম আছে। বিশেষ করে আর্জেন্টিনা সফরের পর এবার পর্যটকরা এসব দেশেও ঘুরতে যেতে পারবে। আর্জেন্টিনার নাম আছে প্রথম ধাপে অনুমোদন পাওয়া ২০টি দেশের মধ্যে। আমরা এখন দক্ষিণ আমেরিকার দেশ সফরের একটি দীর্ঘ ট্যুর প্ল্যান করতে যাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, দীর্ঘ অবকাশের ব্যাপারে এসব দেশে ঘুরতে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা এখন বেশ বাড়বে।”

এই অনুমতি দেওয়ার পর ১৫ মার্চ থেকে মোট ৬০ টি দেশে যেতে পারবেন চীনা নাগরিকরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, গেল কয়েক মাসে চীনের পর্যটনখাত খুব দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করায় আরো বেশি দেশে চীনা পর্যটকদের ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছে চীন। এই পদক্ষেপের মাধ্যমে কেবল চীনের অভ্যন্তরীণ পর্যটনখাতই চাঙ্গা হবে না বরং এসব দেশের পর্যটনও চীনা পর্যটকদের মাধ্যমে লাভবান হবে।

ভিনদেশে চীন:

ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় বহরে যুক্ত হচ্ছে চীনা সি-৯১৯ বিমান

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: দেশের সীমানা ছাড়িয়ে এবার ইথিওপিয়ার রাষ্ট্রীয় বিমান সংস্থায় যুক্ত হচ্ছে চীনের ক্যারিয়ার সি-নাইন ওয়ান নাইন। চীনের তৈরি এই যাত্রীবাহী বিমান নিজেদের বহরে যুক্ত করার কথা ভাবছে ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স।

আফ্রিকা অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স। এই এয়ারলাইন্সের বহরে আছে এয়ারবাস, বোইংসহ খ্যাতনামা বিমান প্রস্তুতকারক কোম্পানির তৈরি করা এয়ারক্র্যাফ্ট। বর্তমানে দীর্ঘ ও মধ্যম রুটের, অভ্যন্তরীণ ও আঞ্চলিক রুটে আকাশ পথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন করে তারা। সম্প্রতি চীনের কমার্শিয়াল এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন অব চায়না’র তৈরি করা সি-নাইন ওয়ান নাইন মডেলের যাত্রীবাহী বিমান কেনার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে তারা। এয়ারলাইন্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেসফিন তাসেউ জানান, গুণগত ও সক্ষমতার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হলেই চীনা বিমানগুলোকে বহরে নেওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। বর্তমানে চীনের ৫টি গন্তব্যে যাওয়া আসা করে ইথিওপিয়ার পতাকাবাহী বিমান।

মেসফিন তাসেউ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইথিওপিয়ান এয়ারলাইন্স গ্রুপ

“আমরা যখনই কোন নতুন মডেলের এয়ারক্র্যাফ্ট বহরে যুক্ত করতে চাই তখনই একটা মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যাই। আমরা দেখি বিমানগুলো কোন ধরনের, সক্ষমতা কেমন। আমরা যেভাবে মূল্যায়ন করি তাতে মনে হয় চীনের তৈরি করা বিমানগুলো এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারবে। আমাদের কাছে যুতসই মনে হলে এগুলো নেওয়ার সম্ভাবনা আছে।“

চীনের সঙ্গে দীর্ঘ দিনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আছে ইথিওপিয়ার। বিশেষ করে সময় ও পরিস্থিতির বিচারে যে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে দুই দেশের সম্পর্ক। বর্তমানে দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল অবস্থানে আছে।

বিশেষ করে চীনের ৫টি গন্তব্যে যাওয়া আসা করে ইথিওপিয়ার পতাকাবাহী বিমান। তবে যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের সঙ্গে মালামাল পরিবহনের দিকেও নজর দিচ্ছে ইথিওপিয়া। তাই সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুণগত মানের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে আফ্রিকার সবচেয়ে বেশি লাভজনক এই এয়ারলাইন্সটিতে চীনা বিমান যুক্ত করার সমুহ সম্ভাবনা আছে। 

চীনের বিমান পরিবহনখাত সংশ্লিষ্টদের মত, কমার্শিয়াল এয়ারক্র্যাফ্ট কর্পোরেশন অব চায়না’র তৈরি করা সি-নাইন ওয়ান নাইন মডেলের যাত্রীবাহী বিমানের জন্য এটি হবে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন। বিশেষ করে দুই দেশের এভিয়েশন শিল্পের জন্য এই ক্যারিয়ার সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে বলে মনে করেন তারা। পাশাপাশি তাদের মতে, পশ্চিমা বিশ্বের বোয়িং বা এয়ারবাসের মতো কোম্পানির সঙ্গে টেক্কা দিয়ে সামনের দিনগুলোতে আকাশ পথের বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটবে বলেও মনে করেন তারা। 

কোম্পানি প্রোফাইল:

চীনের বাজার ধরতে মরিয়া টেসলা; আনছে নতুন মডেলের গাড়ি

সাজিদ রাজু, চীন আন্তর্জাতিক বেতার: চলতি বছরের শুরুটাই হয় বিপুল সংখ্যক গাড়ি বিক্রির মাধ্যমে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিদ্যুৎচালিত গাড়ি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান টেসলার বছর শুরু এক নতুন অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। টেসলা বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নতুন মডেলের বৈদ্যুতিক গাড়ির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। টেসলার পক্ষ থেকে বলা হয়, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে চীনে অন্তত ৬৬ হাজার গাড়ি বিক্রি হয়েছে এই কোম্পানিটির। এ সংখ্যা গেল বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশের বেশি।

গেল বছর সাংহাইয়ের ন্যাশনাল এক্সিবিশন অ্যান্ড কনভেনশন সেন্টারে অনুষ্ঠিত ৫ম চায়না ইন্টারন্যাশনাল ইমপোর্ট এক্সপো -সিআইআইইতে প্রথম বারের মতো প্রদর্শনীতে অংশ নেয় টেসলা।

টেসলা বলছে, জানুয়ারির শুরুর দিকে টেসলা দুটি জনপ্রিয় মডেলের গাড়ির দাম কমিয়ে দেয়। বিশেষ করে ইলেক্ট্রিক থ্রি ও ওয়াই মডেলের গাড়ি দুটির দাম কমানো হয়। টেসলা জানায়, থ্রি ও ওয়াই মডেলের গাড়ির দাম কমিয়ে রাখা হয় ২০ হাজার ৪৮ হাজার ইউয়ানের মধ্যে। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষ এ দুই মডেলের গাড়ি কিনতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।  

কোম্পানির পক্ষ থেকে বলা হয়, বিশেষ করে চীনা চান্দ্র বর্ষের ছুটিতে চীনের টেসলার শোরুম ও সরবরাহ কেন্দ্রে ছিলো চীনা ক্রেতাদের উপচে পড়া ভিড়।

চায়না প্যাসেঞ্জার কার অ্যাসোসিয়েশন –সিপিসিএ’র সাধারণ সম্পাদক কুই তোংশু জানান, দীর্ঘ মেয়াদে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় চীনের গাড়ির বাজার বিশেষ করে পরিবেশবান্ধব জ্বালানী চালিত গাড়ির বাজার অনেক ভালো। চীনের নাগরিকদের মধ্যে গাড়ি কেনার প্রবণতা ও সক্ষমতা দ্রুত গতিতে বাড়ছে।

সংস্থাটির হিসেবে ২০২৩ সালের এখন পর্যন্ত নতুন ধরনের জ্বালানী চালিত গাড়ি বিক্রির সংখ্যা বেড়ে ৮ দশমিক ৫ মিলিয়নে পৌঁছেছে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে চীনেই প্রথম গিগাফ্যাক্টরি স্থাপন করে টেসলা। সাংহাইয়ে স্থাপন করা এই গিগাফ্যাক্টরি থেকে ২০২২ সালে বাজারে ছাড়া হয় ৭ লাখ ১০ হাজার গাড়ি, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি।