আকাশ ছুঁতে চাই ৯
2023-03-16 16:09:25

১. চোখের আলোয় লিউ সিইয়াও

২.  নারী দিবস উদযাপন এবং চীনের নতুন দিক নির্দেশনা

৩. সব বাধাকে জয় করলেন চাং জুনলি

 

নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারীর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।

চোখের আলোয় লিউ সিইয়াও

অনুষ্ঠানের শুরুতেই শুনবো এমন একজন নারীর কথা যিনি দুর্ঘটনায় এক চোখে দৃষ্টি হারিয়েও ভেঙে পড়েননি। বরং গড়ে নিয়েছেন নিজের নতুন ক্যারিয়ার। আমার তৈরি একটি প্রতিবেদন শুনবেন এখন।

     

                                       

শৈশব থেকেই লিউ সিইয়াওয়ের ইচ্ছা ছিল নৃত্যশিল্পী হওয়ার। ৮ বছর বয়স থেকে নাচ শিখছিলেন। নৃত্যশিল্পী হিসেবে বেশ খ্যাতিও পান। কিন্তু ২০১৩ সালে এক দুর্ঘটনায় এক চোখ হারান লিউ। নকল চোখ পরেন তিনি। কিন্তু সেই চোখ দেখতে খুব একটা ভালো ছিল না, আসল চোখের মতো লাগছিলও না। সেই সময়টা খুব খারাপ গেছে লিউর। আয়নার দিকে তাকাতে পারতেন না। তার এখন একটা মাত্র চোখ এটা মেনে নিতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল তার। ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে মঞ্চে ওঠেন। কিন্তু একবার নাচের সময় তার কৃত্রিম চোখটি খুলে পড়ে যায়। দর্শকরা যেন আঁতকে না ওঠেন সেজন্য তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে চোখ আড়াল করেন তিনি। বিষয়টা ছিল অত্যন্ত বিব্রতকর। লিউ তার পেশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন।

তিনি কৃত্রিম চোখ তৈরি একজন শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য প্রশিক্ষণ শুরু করেন। এটা শেখা মোটেই সহজ ছিল না।

চীনে দুই রকম কৃত্রিম চোখ পাওয়া যায়। গতানুগতিক কৃত্রিম চোখ এবং কাস্টোমাইজড বা গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী কৃত্রিম চোখ।

লিউ সিইয়াও সিদ্ধান্ত নেন তিনি কাস্টোমাইজড কৃত্রিম চোখ তৈরি করবেন। তিনি প্রথমে ক্রেতাদের পর্যবেক্ষণ করেন। তাদের অক্ষিকোটর, চোখের রং, চেহারার গঠন ইত্যাদি স্টাডি করেন। এরপর তাদের চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ চোখ তৈরি করেন।এজন্য তাকে চোখের চিকিৎসা বিজ্ঞানও পড়তে হয়েছে।

লিউর পরিবার থেকে প্রথমে এই নতুন পেশাকে স্বাগত জানানো হয়নি। কারণ একজন প্রতিষ্ঠিত নৃত্যশিল্পী থেকে তিনি নতুন কারুশিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবেন কিনা তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু আগ্রহ, উদ্যম ও ধৈর্যের সঙ্গে নিজেকে এই পেশায় প্রতিষ্ঠিত করেছেন লিউ। গেল বছর বেইজিংয়ে তিনি তার স্টুডিও প্রতিষ্ঠিত করেন। অনলাইনে প্রচারও শুরু করেন। বেশ তাড়াতাড়িই গ্রাহকদের সাড়া পেয়েছেন লিউ।

কাস্টোমাইজড চোখের জন্য দাম পড়ে একটু বেশি। একটি চোখের খরচ ৬হাজার ৯৪৩ ইউয়ান। সকলের পক্ষে এটা কেনা কঠিন। তাই লিউ প্রতিমাসে কিছু চোখ বিনামূল্যে দান করেন।

তিনি এখন সাংহাই, কুয়াংচোওসহ বড় বড় শহরগুলোতে তার প্রতিষ্ঠানের শাখা খোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন। চোখ তৈরিতে অন্যদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন।

লিউর একচোখে দৃষ্টি না থাকলেও তিনি অন্তরের আলোয় আলোকিত করে তুলছেন অনেকের জীবন।

 

নারী দিবস উদযাপন এবং চীনের নতুন দিক নির্দেশনা

সম্প্রতি চীনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে আনন্দমুখর পরিবেশে। কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ আইনও জারি হয়েছে। নারী দিবসে চীনের বিভিন্ন আয়োজন ও এ বিষয়ে গৃহীত সিদ্ধান্ত বিষয়ে বিস্তারিত শুনে আসি আমার তৈরি  একটি প্রতিবেদনে।

অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীর গুরুত্বপূর্ণ অবদান এবং অর্জনকে স্বীকৃতি ও শ্রদ্ধা জানিয়ে গেল ৮ মার্চ চীনে ১১৩বারের মতো পালিত হলো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এ উপলক্ষে দেশজুড়ে বিভিন্ন সংগঠনের উদ্যোগে নানা রকম ইভেন্টের মাধ্যমে নারীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো হয়।

বেইজিংয়ের চায়না গার্ডেন মিউজিয়ামে প্রদর্শিত হয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নারীদের পোশাক। চেচিয়াং প্রদেশের সিয়ানচু শহরে ঐতিহ্যবাহী সিংহ নাচের নারী শিল্পী দল লায়ন ডান্স পরিবেশন করে। চিয়াংসু প্রদেশের লিয়ানইয়ুনকাং শহরে আয়োজন করা হয় নারীদের জন্য চাকরিমেলা।

দেশের বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে নারীদের জন্য ফুল সাজানো কর্মশালা, মেডিকেল চেকআপ, ক্রীড়া প্রতিযোগিতাসহ বিভিন্ন রকম আয়োজনের মাধ্যমে নারী দিবসকে উদযাপন করা হয়।

এদিকে, নারী শ্রমিকদের অধিকার ও স্বার্থ রক্ষায় চীনের ছয়টি বিভাগের দিকনির্দেশনা প্রকাশিত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক কর্মজীবী নারী দিবস উপলক্ষ্যে ৮ মার্চে চীনের মানবসম্পদ ও সামাজিক নিরাপত্তা মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনসহ ছয়টি বিভাগ যৌথভাবে, "কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নির্মূল" আইন এবং "কর্মক্ষেত্রে নারীকর্মী বিশেষ শ্রম সুরক্ষা ব্যবস্থা" জারি করেছে।

"কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নির্মূল" শীর্ষক আইনে মোট ২০টি বিধি রয়েছে। আর "কর্মক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের জন্য বিশেষ শ্রম সুরক্ষা ব্যবস্থা"-য় মোট ২৬টি বিধি রয়েছে।  এসব বিধির লক্ষ্য কর্মক্ষেত্রে নারীর অধিকার ও স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

১৯৪৯ সালে মহান কমিউনিস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন প্রতিষ্ঠার পর নারী পুরুষের মধ্যে বৈষম্য বিলোপ করা হয় এবং রাষ্ট্রীয় সকল ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করা হয়।

এরপর  সামাজিক সকল ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সংঘটিত সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ করা উদ্যোগ নেয় হয়।

অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে বৈশ্বিক নারী-পুরুষ সমতা রক্ষা ও নারীদের আরো উন্নয়ন নিশ্চিত করারও আহ্বান জানানো হয়। চীনের স্টেট কাউন্সিলের ন্যাশনাল ওয়ার্কিং কমিটি অন চিলড্রেন অ্যান্ড উইমেনের ভাইস চেয়ারম্যান লিন ই  নারী দিবসে বিশেষ আহ্বান জানান

লিন ই জানান, চীনা নারীরা জীবনের সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছেন, দেশ গঠনে অবদান রাখছেন।

 চীন রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী-পুরুষ সমতাকে উৎসাহিত করে উল্লেখ করে লিন ই বলেন, একইসঙ্গে চীন নারীদের ক্ষমতায়নের ব্যাপারেও ভূমিকা পালন করে। চীনের অন্তত ৪০ মিলিয়ন নারীর জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ডিজিটাল অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে ৫৭ মিলিয়ন চাকরির সুযোগ তৈরি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, চীনের আধুনিকায়নের লক্ষ্যে চীনা নারীদের জীবনমান উন্নয়নে বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়েছে।

সব বাধাকে জয় করলেন চাং জুনলি

কয়েক দশক ধরে বিছানায় শুয়েই ছবি আঁকছেন পয়তাল্লিশ বছর বয়সী চাং জুনলি।  শুয়েশুয়েই একেছেন পাঁচ শতাধিক ছবি। ছয় বছর বয়সে আর্থাইটিস রোগের কারণে প্রতিবন্ধিতা হয় তার সঙ্গী । শারীরিক অসুস্থতার মধ্যেই এঁকে চলেছেন এই নারী। প্রতিবন্ধকতাকে পিছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এই নারী দেখিয়েছেন আগ্রহ ও ইচ্ছাশক্তিতেই এগিয়ে যাওয়া যায় অনেকদূর। চাং জুনলিকে নিয়ে আরও বিস্তারিত শুনবো আফরিন মিমের প্রতিবেদনে।

বিছানায় শুয়ে রঙ তুলিতে আঁকছেন ছবি। এক এক করে পাঁচশ’র বেশি ছবি বিছানায় শুয়েই এঁকে শেষ করেছেন তিনি। বলছিলাম উত্তর চীনের শানসি প্রদেশের থাইয়ুয়ান শহরের পয়তাল্লিশ বছর বয়সী চাং জুনলির কথা।  

চাং জুনলি  একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী। মাত্র ছয় বছর বয়সে আর্থাইটিস রোগের শিকার হোন তিনি। এরপর আট বছর বয়স থেকে  হারান চলাচল করার ক্ষমতা। এরপর শুরু হয় তার কঠিন সময়।

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআকির প্রতি নেশা ছিল চাংয়ের। ছোটবেলার সেই স্বপ্নকে হারতে দিতে চাননি তিনি। দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছাকে বিছানায় শুয়েই বাস্তবায়ন করেছেন । 

নিজের কল্পনার জগতের অনেক  কিছু ফুটিয়ে তোলেন তার আঁকা ছবিতে। নিজের আঁকা ছবির মাধ্যমে হারিয়ে যান সেসব স্থানে। তিনি বলেন, "আমি সুন্দর জিনিস পছন্দ করি -- সুন্দর দৃশ্য, ফুল, ঘাস এবং যা আমার হৃদয়কে স্পর্শ করতে পারে। যেখানে আমি কখনোই যেতে পারিনি ,সেসব জায়গাকে ক্যানভাসে আঁকি। এটি আমার ব্রাশের মতো ক্যানভাসের উপর দিয়ে আমাকে ভ্রমণে নিয়ে যায়, " ।

নিজ শহরের লাইব্রেরিতে নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী করেছেন চাং। যেখানে চাংয়ে আঁকা ৮০টি ছবি স্থান পায় । সেসব ছবির ভাষা মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের।

শারীরিক  অসুস্থতার জন্য নিয়মিত চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন চাং।  প্রচন্ড শারিরীক ব্যথাতেও ছবি আঁকা বন্ধ করেননি তিনি। আত্মবিশ্বাস ও সাহস নিয়ে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম উদাহরণ এই চাং জুনলি।

সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।

অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। বিশ্ব নারী দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাই চিয়েন।

সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া