চীনে প্রবীণদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় আছে। অবসর নেওয়ার পর বয়স্ক লোকেরা যাতে নিজেদের পছন্দমতো পড়াশোনা করতে পারেন, বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন, সেই লক্ষ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয়। বয়স্কদের মধ্যে এই বিশ্ববিদ্যালয় অনেক জনপ্রিয়।
চীনের সমাজকাঠামোর কারণে অনেকে অবসর নেওয়ার পরও শারীরিকভাবে মোটামুটি সুস্থ ও সবল থাকেন। চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তাদের হাতে অনেক সময় থাকে। সে সময়টা ভালোভাবে কাটানো তাদের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। এ সময় অনেকে বন্ধুদের সাথে ভ্রমণে বের হন। আবার অনেকে, নিজেদের কিছু শখ পূরণের জন্য নতুন কিছু শিখতে চান। এ প্রেক্ষাপটে চীনে অবসরপ্রাপ্তদের জন্য চালু করা হয় বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা প্রবীণদের বিশ্ববিদ্যালয়। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান এখন দিন দিন বাড়ছে। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা চীনের প্রবীণদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আলোচনা করবো।
শাংহাই মহানগরের ম্যাডাম লিউ গত বছর অবসর নিয়েছেন। তাঁর শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালো। তাই তিনি বাসায় বসে থাকতে চান না। তিনি প্রবীণদের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান তথা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নতুন বন্ধু বানাতে ও নতুন কিছু শিখতে আগ্রহী। তবে প্রবীণদের ক্লাস যে এতো জনপ্রিয় তিনি তা আগে জানতেন না। অনলাইন ক্লাসের জন্য নিবন্ধনের কাজ মাত্র ৫ মিনিটে শেষ করেন তিনি। আর অফলাইনে মানে ক্লাসরুমে সরাসরি থেকে শেখার সুযোগ নিতে তিনি ৩ ঘন্টা চেষ্টা করেন। তবে তাঁর প্রিয় সংগীত ও কন্ঠসংগীতের ক্লাসে কোনো খালি আসন নেই। এ সম্পর্কে ম্যাডাম লিউ বলেন, তিনি কয়েকটি প্রবীণ ক্লাসের খোঁজ-খবর নিয়েছেন। সবখানে একই অবস্থা। প্রিয় ক্লাসে ভর্তির জন্য তাকে নাকি ৩ বছর অপেক্ষা করতে হবে!
জরিপ থেকে জানা গেছে, অনেক প্রবীণ নিবন্ধনের সময় এমন সমস্যায় পড়েছেন। প্রবীণদের বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুলে আসনসংখ্যা বিদ্যমান চাহিদা মেটাতে পারছে না। কিছু কিছু স্কুলের অনলাইন ক্লাসের নিবন্ধন মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। আর অফলাইনের ক্লাসের নিবন্ধনের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় থাকতে হয়।
প্রবীণদের জন্য এমন ক্লাসে পড়াশোনা তাদের জীবনযাপনের একটি অংশে পরিণত হয়েছে। চীনের চিয়াংসু প্রদেশের নানচিং শহরের একজন নাগরিক সংবাদদাতাকে বলেন, সিনিয়র শিক্ষার্থীদের অনেকেই নির্দিষ্ট সময় পরও বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে চান না। তাই, নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত খালি আসন সৃষ্টি হয় না। আবার কোনো কোনো ক্লাসের শিক্ষার্থীর সংখ্যা নির্দিষ্ট আসনের চেয়ে বেশী।
চীনের কুয়াংতুং প্রদেশের শেনচেন শহরের জনাব ওয়ের বয়স ৬৩ বছর। তিনি টানা ৮ বছর ধরে স্থানীয় একটি প্রবীণ স্কুলে মার্শাল আর্ট ‘থাই চি’ শিখছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, কেবল শরীরচর্চা করার জন্য ক্লাসে যাওয়া নয়, বরং বন্ধুদের সাথে নিয়মিত দেখা করা তাঁর কাছে আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, অবসর নেওয়ার পর শুধু বাসায় বসে থাকতে ভালো লাগে না। প্রবীণদের ক্লাসে যোগ দেওয়ার পর, সমবয়সী বন্ধুদের সাথে ভ্রমণসহ অনেক কাজ করার সুযোগ হয়। সেটি তাঁর জন্য বেশ আনন্দের ব্যাপার। তা ছাড়া, প্রবীণদের ক্লাসের খরচও বেশি নয়। এক সেমিস্টার মাত্র কয়েক শ ইউয়ান। সেটি তাঁর জন্য কোনো আর্থিক বোঝা না। ‘থাই চি’ ক্লাস প্রবীণদের মধ্যে অনেক জনপ্রিয়। তাই সহজে এই ক্লাসে আসন পাওয়া যায় না।
প্রবীণদের স্কুলে নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ বাড়াতে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, আসনসংখ্যা বাড়ানো। আরেকটি হচ্ছে নতুন নতুন বিষয় চালু করা। তবে টানা কয়েক বছর ধরে শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে, শিক্ষকদের ওপর চাপও বেড়েছে এবং ক্লাসের কর্মীদের সংখ্যা আর ক্লাসের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। এ সমস্যা মোকাবিলায় কোথাও কোথাও আসনসংখ্যা কমানোও হয়েছে।
বস্তুত, প্রবীণ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। চীনের প্রবীণ পরিষদের প্রকাশিত ‘চীনের বয়স্কদের শিক্ষা উন্নয়ন প্রতিবেদন’ থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত চীনে বয়স্কদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ৭৬ হাজারেরও বেশি। আর অনলাইন ক্লাসসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বয়স্ক শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১.৩ কোটিরও বেশি। তবে, এ সংখ্যা চীনের ৬০ বছর বয়সের উপরের লোকসংখ্যার মাত্র ৫ শতাংশ।
প্রবীণদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা মেটাতে ২০২২ সালের অগাস্ট মাসে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদের কর্মপ্রতিবেদনে বিভিন্ন বিভাগ, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবীণদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর লক্ষ্য, ২০২৫ সালের মধ্যে প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি প্রবীণ-স্কুল গড়ে তোলা।
চীনের চিয়াংসি প্রদেশের নানছাং শহরের সিহু এলাকার প্রবীণদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কন্ঠসঙ্গীত, চীনা ক্যালিগ্রাফি, ঐতিহ্যিক ব্রাশ দিয়ে ছবি আঁকা, চীনা অপেরা এবং ইওগাসহ ১৫টি বিভাগের ৩২টি ক্লাস চালু হয়েছে। তাতে ২৮ জন পেশাদার শিক্ষক রয়েছেন এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যাও ১২০০ জনের বেশি। এ সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট সুন সিয়াও মিং বলেন, স্কুলের বিভিন্ন বিভাগ পড়াশোনার সর্বোচ্চ সময় নির্ধারিত হয়েছে ৩ থেকে ৪ বছর। এভাবে সময়মতো শিক্ষার্থীরা স্নাতক হয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন। তখন নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারবে। ফলে প্রবীণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আসনসংখ্যার মধ্যে ভারসাম্যহীনতা অনেকটা দূর হবে। স্নাতক হওয়ার পর শিক্ষার্থীরা নতুন মেজর বেছে নিতে পারেন, তবে একই মেজরে আর থাকতে পারবেন না।
চীনের পিপলস বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ ও লোকসংখ্যা একাডেমির অধ্যাপক হুয়ান পিং ছিং বলেন, চীনে প্রবীণদের জন্য শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে অনেক প্রবীণ-বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয়েছে। তবে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা, শিক্ষক, আর শিক্ষার উপকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ে উন্নতির সুযোগ অনেক। বিশেষ করে, সরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ-বিশ্ববিদ্যালয় বেশি জনপ্রিয়। আবার বেসরকারি পর্যায়ে ভালো প্রবীণ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুবই কম। সমাজের বিভিন্ন মহলে এ ব্যাপারে আরো বেশি প্রচেষ্টা চালাতে পারে। এ সম্পর্কে অধ্যাপক হুয়ান পিং ছিং বলেন, সরকারি প্রবীণ-বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার খরচ কম এবং শিক্ষার মান ভালো। তাই বয়স্কদের মধ্যে তা বেশি জনপ্রিয়। তবে, প্রবীণদের চাহিদা মেটাতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সক্ষম নয়। তাই সমাজের বিভিন্ন মহলের যৌথ উদ্যোগে প্রবীণদের জন্য আরো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু করা অতি জরুরি ব্যাপার। সরকার যদি কিছু সুবিধাজনক নীতি চালু করে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথভাবে প্রবীণদের জন্য আরো বেশি স্কুল প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে প্রবীণদের চাহিদা মেটানো সম্ভব।
চীনের চতুর্দশ পাঁচশালা পরিকল্পনায় দেশের প্রবীণদের পরিষেবা ও পেনশন পরিষেবা ব্যবস্থা গঠনে বিস্তারিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে প্রবীণদের জন্য আরো বেশি শিক্ষাসম্পদ ও পরিষেবা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সহযোগিতা করে প্রবীণদের শিক্ষার চাহিদা মেটানোর প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাপক হুয়ান বলেন, বর্তমানে চীনের প্রবীণদের বিশ্ববিদ্যালয় নানা রকমের, যেমন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের স্কুল, আবাসিক এলাকার প্রবীণদের স্কুল, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত প্রবীণদের স্কুল, বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও গ্রামাঞ্চলের প্রবীণদের স্কুল, ইত্যাদি। যদি সমাজের বিভিন্ন মহলের শক্তি একসাথে করা যায়, তবে প্রবীণদের পড়াশোনায় আরো বেশি সম্পদ সংগ্রহ করা সম্ভব।
নানছাং শহরের সিহু এলাকার প্রবীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট সুন সিয়াও মিং বলেন, “বয়স্কদের ভালো করে শিক্ষা দিতে স্কুলের ক্লাসরুম নতুন করে সাজিয়েছি এবং নতুন কিছু শিক্ষাকোর্সও যুক্ত করেছি। অনেক বয়স্ক শিক্ষার্থী বলেন, তাদের বিদেশ ভ্রমণকালে ইংরেজি ভাষা না-জানার কারণে অনেক অসুবিধা হয়। তাদের কথা বিবেচনা করে আমরা একটি ইংরেজি ক্লাস চালু করেছি এবং প্রবীণদের ভ্রমণের কথা বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট সংলাপ ও কথাবার্তার বিষয় ঠিক করেছি। এভাবে আরো বেশি প্রবীণ সহজে ইংরেজি ভাষা শিখতে পারছেন।”
আসলে প্রবীণদের শিক্ষার লক্ষ্য কেবল তাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করা নয়, বরং তাদের জ্ঞানের পরিসীমা বাড়ানো। এভাবে যুগের উন্নয়নের সাথে সাথে প্রবীণদের চিন্তাভাবনাও উন্নত করা সম্ভব। ডিজিটাল পেমেন্ট, মোবাইল ফোন দিয়ে গাড়ি বুকিং করা বা হাসপাতালে যাওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় যদি তারা না-শেখেন, তবে আধুনিক সমাজে প্রবীণদের জীবন অনেক কষ্টের হবে। প্রবীণদের স্কুলে এসব চাহিদা বিবেচনা করে প্রশিক্ষণ কোর্স চালু হয়েছে। এখন অনেক প্রবীণ এসব স্কুলের কারণে স্মার্টফোন ব্যবহারের পদ্ধতি শিখেছেন। সেটি তাদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আনন্দের ব্যাপার।
বেইজিং নোর্মল বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার প্রশাসন একাডেমির অধ্যাপক চাং শেং জুন বলেন, প্রবীণদের চাহিদা ও ক্লাসে আসনসংখ্যার অসঙ্গতি মোকাবিলায় আরো বেশি অনলাইন ক্লাস ও শিক্ষা প্ল্যাটফর্ম সৃষ্টি করতে হবে। বেইজিং হাইতিয়ান এলাকার প্রবীণদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২২ সালের শরত্কালীন সেমিস্টারে অনলাইন আর অফলাইনের ক্লাস একসাথে চালু হয়েছে। ৭৬টি বিভাগের অনলাইন লাইভ ক্লাস রয়েছে। অনলাইন ক্লাস চালু করার পর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০০০ জনেরও বেশি হয়েছে।
মোদ্দাকথা, প্রবীণদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন আবাসিক এলাকার সমর্থন প্রয়োজন। যদি সকল আবাসিক কমিউনিটিতে একটি করে প্রবীণ-বিশ্ববিদ্যালয় চালু করা হয়, তাহলে বয়স্ক লোকজন বাড়ির কাছে পড়াশোনার সুযোগ পেতে পারে। সেটি হবে তাদের জন্য বেশ ভালো উদ্যোগ এবং প্রবীণদের শিক্ষার টেকসই ও স্বাস্থ্যকর উন্নয়নে সহায়ক।
(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)