চীনের শীর্ষ জাতীয় রাজনৈতিক উপদেষ্টা সংস্থা গণরাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলন-সিপিপিসিসি এবং চীনের শীর্ষ আইনসভা জাতীয় গণকংগ্রেস-এনপিসি’র বার্ষিক বৈঠক শনি ও রোববার বেইজিংয়ে মহাগণভবনে শুরু হয়েছে। এ দুটি বৈঠককে একত্রে ‘দুই অধিবেশন’ বলা হয়ে থাকে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংসহ শীর্ষস্থানীয় নেতারা সপ্তাহব্যাপী এ দু’টি অধিবেশনে যোগ দিয়েছেন।
চীনের রাজনৈতিক ক্যালেন্ডারে ‘দুই অধিবেশন’ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে কেন্দ্রীয় সরকার একটি কর্ম-প্রতিবেদন পেশ করে যা সাধারণত অতীতের অর্জনগুলো পর্যালোচনা করে এবং পরের বছরের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। সারাদেশ থেকে বেইজিংয়ে জড়ো হওয়া হাজার হাজার আইনপ্রণেতা এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টারা প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করবেন।
সিপিসির ২০তম জাতীয় সম্মেলনের পর এ বছরের ‘দুই অধিবেশন’ অধিক গুরুত্ববহন করে। চীনকে পর্যবেক্ষণ করতে এবং বুঝতে আগ্রহীদের কাছে দুই অধিবেশন একটি ভালো সুযোগ।
‘দুই অধিবেশন’ হলো চীনের শাসন ব্যবস্থায় এমন একটি প্ল্যাটফর্ম যেখানে বিভিন্ন অঞ্চল এবং গোষ্ঠী তাদের মতামত প্রকাশ করে এবং একটি ঐকমত্যে পৌঁছায়। আইন প্রণেতারা প্রস্তাব এবং পরামর্শ জমা দেন, যখন রাজনৈতিক উপদেষ্টারা প্রস্তাব পর্যালোচনা ও পরামর্শ প্রদান করেন।
অনেক তাৎপর্যপূর্ণ আইন, প্রবিধান এবং নীতির উদ্ভবে এখান থেকে যা বিভিন্ন সেক্টর এবং গোষ্ঠীর সাথে সম্পর্কিত - যেমন পরিবেশ সুরক্ষা থেকে দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্যসেবা, শহুরে সমস্যা থেকে গ্রামীণ সমস্যা- সবকিছু নিয়ে আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে এ দুটি অধিবেশনে।
চীনের বর্তমান উন্নয়ন সম্পর্কে জানতে, চীনের রাজনৈতিক ব্যবস্থা বোঝা এবং তার ভবিষ্যত পথের পূর্বাভাস সম্পর্কে জানতে দুই অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জানালা।
চীনাদের পাশাপাশি এ সময়ের মধ্যে, বিদেশীরা জানতে পারেন যে কোন বিষয়গুলো আলোচনায় আসছে, কোন বিষয়গুলো চীনা নেতাদের কাছে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগজনক, কোন উন্নয়ন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, কীভাবে চীন অন্যান্য দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে ইত্যাদি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পর চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। তাই চীনের ‘দুই অধিবেশন’ পর্যবেক্ষণ করা আসলে চীনা অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করা। এর একটি প্রধান কাজ হল চীনের বার্ষিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের মানচিত্র তৈরি করা, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি ঘোষণা করা।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ২০তম জাতীয় কংগ্রেস গত বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ‘আধুনিকীকরণের একটি চীনা পথের মাধ্যমে সমস্ত ফ্রন্টে চীনা জাতির পুনরুজ্জীবনকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য’ জোর দেওয়া হয়। এ বছরটিকে সেই নতুন যাত্রার প্রথম বছর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ‘দুটি অধিবেশনে’ যে নতুন কর্মপন্থা নেওয়া হবে তা কেবল চীনের জন্যই নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
চীনের গুরুত্বপূর্ণ ‘দুই অধিবেশন’কে ঘিরে জোরালো অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও নতুন প্রবৃদ্ধির আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। চীন নিজের অর্থনৈতিক জোরালো পুনরুদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতিকেও ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করবে বলে মনে করেন তারা।
টেপেস্ট্রি এশিয়া-প্যাসিফিকের প্রেসিডেন্ট ইয়ান বোজেক বলেন, তিনি চীনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার বিষয়ে খুবই আশাবাদী। কারণ করোনাকালেও দেশটি তার অর্থনীতির গতিকে ধরে রাখতে পেরেছে। চীনের ব্যবসা-বাণিজ্য এখন ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, এর রয়েছে বিশাল মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠি। এ সব কিছু চীনকে বড় অর্থনৈতিক সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে বলে মনে করেন ইয়ান বোজেক।
চীনের ম্যানুফেকচারিং সক্ষমতা, বিশ্বব্যাপী বিশাল সরবরাহ চেইন বিশ্ব অর্থনীতিকে আত্মবিশ্বাস, স্থিতিশীলতা ও ব্যাপকতা দেবে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফের এশিয়া-প্যাসিফিক ডিপার্টমেন্টের উপ-পরিচালক থমাস হেলব্লিং মনে করেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির একটি অন্যতম উৎস হিসেবে চীন নিজের অবস্থান ধরে রাখবে।
প্রকৃতপক্ষে, চীনে যে কোনো পরিবর্তন ঘটলে তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অন্যান্য দেশকে প্রভাবিত করবে। এটা বললে অত্যুক্তি হবে না যে অনেক আমেরিকান বহুজাতিক কর্পোরেশনের জন্য, তাদের যে কোনো বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চীনা ভোক্তাদের এবং নীতিগুলিকে বিবেচনায় নিতে হয়। এবং ‘দুটি অধিবেশন’ মূল্যবান তথ্য খুঁজে বের করার একটি বড় সুযোগ।
মার্কিন-চীন সম্পর্ক নিঃসন্দেহে বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। দুই অধিবেশন চলাকালে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন কাং চীন-মার্কিন সম্পর্ক বিষয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের উত্তর দেবেন।
এ সমস্ত কিছু মিলিয়ে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ‘দুই অধিবেশন’ আগামী সপ্তাহ জুড়ে বিশ্ববাসীর নজরে থাকবে- এটা খুবই প্রত্যাশিত।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।