চীনের ‘আকাশের চোখ’-ফাস্ট
2023-03-03 16:30:18

 

চীনের কুইচৌ প্রদেশে অবস্থিত পাঁচশ’ মিটার ক্যালিবারের অ্যাপারচার স্ফেরিক্যাল টেলিস্কোপ অর্থাত্ ফাস্ট হল- বিশ্বের বর্তমানে বৃহত্তম রেডিও টেলিস্কোপ। যাকে বলা হয় চীনের ‘আকাশের চোখ’। এই চোখ মহাকাশের অনেক রহস্য, তথা উপকরণ এবং প্রাণের উত্স যাচাই ও অনুসন্ধান করতে পারে। যা একটি ‘আকাশের পরীক্ষাগারের মত’।

মানুষের নানা কাজে প্রতিনিয়ত অনেক রেডিও তরঙ্গ সৃষ্ট হয়। যা মহাকাশ থেকে আসা নানা ধরনের সিগনাল গ্রহণে বাধা সৃষ্টি করে। ১৯৯৩ সালের আন্তর্জাতিক রেডিও সম্মেলনে চীনসহ দশটি দেশ প্রস্তাব দেয় যে, একটি সুপার বড় ক্যালিবারের অ্যাপারচার স্ফেরিক্যাল টেলিস্কোপ স্থাপন করা যেতে পারে।

পরের বছর নান রেন তুং নামে চীনা বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে চীনের মহাকাশ খাতের বিজ্ঞানীরা (FAST) ফাস্ট প্রকল্প চালু করেন। ‘চীনের আকাশের চোখ’ অসম্ভব দূরবর্তী দৃশ্য দেখা ও বৈচিত্র্যময় মহাজাগতিক তরঙ্গ ও সিগনাল গ্রহণ করা শুরু করে। যা একটি নতুন সম্ভাবনার দিক উন্মোচন করে।

 

১৯৯৪ সালে জনাব নান রেন তুং জাপানে অধ্যাপনার কাজ করতেন। তখন তাঁর বেতন ছিল চীন দেশের বেতন-কাঠামোর তুলনায় তিনশ’ গুণ বেশি। তবে সেই মহান দায়িত্ব পালনের জন্য তিনি জাপান ছেড়ে চীনে ফিরে আসেন। তিনি বলেন, অন্য দেশের নিজের বড় সরঞ্জাম আছে। চীনের নেই, আমাদের চেষ্টা করতে হবে। ঠিক এই কথার জন্য প্রায় ৫০ বছর বয়সী নান রেন তুং ফাস্ট প্রকল্পের স্থান বাছাই করার জন্য অনেক চেষ্টা শুরু করেন।

তিনি হাতে বাঁশের লাঠি, নোংরা পানি এবং ঠান্ডা খাবার খান, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে তিনি কুইচৌ প্রদেশের সব নিচু ভূমি পরিদর্শন করেন। একবার তিনি পাহাড়ে বন্যার মুখোমুখি হন। মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি হৃদরোগের কিচু ওষুধ খেয়ে মৃত্যুর হাত থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসেন।

 

এগারো বছর! তিনি ফাস্ট প্রকল্প নির্মাণের জায়গা ঠিক করার জন্য এগারো বছর চেষ্টা করেন। এত বছর ধরে যেসব কঠিন অবস্থা দূর করা হয়, তা আমরা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারি না। তবে, তিনি একবারও কঠিনতার কাছে নতি স্বীকার করেন নি। অবশেষে ৩৯১টি জায়গা বিবেচনা করে তিনি ফাস্ট টেলিস্কোপ নির্মাণের সবচেয়ে ভালো জায়গা নির্ধারণ করেন। চীনের ‘আকাশের চোখ’ নির্মাণের আশা দেখা যাচ্ছিল, নান রেন তুং মনে আশা পোষণ করে পরিকল্পনা করেন এবং কাজ করেন। তবে, তাঁর জীবন যেন ধীরে ধীরে শেষ দিকে যাচ্ছিল।

 

২০১৫ সালে ৭০বছর বয়সী নান রেন তুং ফুসফুসের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। অস্ত্রোপচার শেষ হওয়ার মাত্র তিন মাস পর তিনি ব্যথা নিয়ে আবারও নির্মাণস্থলে ফিরে আসেন। তখন তাঁর স্বরতন্ত্রীর সমস্যা দেখা দেয়, কথা বলা অনেক কষ্টের মনে হয়, তবুও তিনি কঠিন কণ্ঠে নির্মাণ কাজের প্রতিটি বিস্তারিত বিষয় জিজ্ঞেস করেন, বৈজ্ঞানিক সমস্যার সমাধানে পথ দেখান। তিনি বলেন, ফাস্ট প্রকল্পের ছোট সমস্যা হলে, আমরা কিভাবে জনগণকে জবাব দেবো। কথাটি শুনতে সহজ হলেও, তা শুনে সবাই কাঁদে। ২০১৬ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ফাস্টের প্রধান অংশের নির্মাণকাজ শেষ হয়। যদিও তাঁর শারীরিক অবস্থা ভীষণ খারাপ ছিল, তবুও তিনি বেইজিংয়ের হাসপাতাল থেকে আবার কুই চৌ প্রদেশে ফিরে যান। নিজের ২০ বছরের চেষ্টা বহনের এই মহান বৈজ্ঞানিক প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটি দেখেন।

 

সব কিছু তাঁর আকাঙ্ক্ষার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছিল। তবে তাঁর জীবন শেষ মুহূর্তে চলে গেছে। জীবনের শেষ সময়ে নান রেন তুং একটি কবিতা লিখেন: সুন্দর মহাকাশ, তার রহস্য, তার সৌন্দর্য দিয়ে, আমাদের ডাকে, আমাদের মাঝামাঝি জীবন থেকে বের হয়ে যায়, আমরা তার অসীম কোলে ছুটে যাই। এসব অক্ষর মহাকাশের বুকে তাঁর আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়।

২০২০ সালের ১১ জানুয়ারি, ফাস্ট দেশের যাচাইয়ের মানদণ্ডে পাস হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। ২০২১ সালের ৩১ মার্চ ফাস্ট বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।

 

নির্মাণ কাজের শুরু থেকে চালু হওয়া পর্যন্ত, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং সবসময় ফাস্টের ওপর অনেক গুরুত্বারোপ করেন।

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সি চিন পিং কুইচৌ পরিদর্শনের সময় ফাস্টের সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি প্রশংসা করে বলেন, ফাস্ট হল মহাকাশ পর্যবেক্ষণের মহান চোখ, দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। তিনি সবাইকে নান রেন তুংকে দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণ করা এবং বিশ্বের বিজ্ঞান মহলে আরো বড় সাফল্য অর্জন করায় উত্সাহ দেন।

চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত, এই চীনের আকাশের চোখ মহাকাশে ৬৬০টি নতুন পালসার আবিষ্কার করেছে। যা বিশ্বে পালসার আবিষ্কার করা সবচেয়ে দক্ষ সরঞ্জামে পরিণত হয়েছে।

 

এখন ‘চীনের আকাশের চোখ’ সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে আছে। অতি উচ্চ সংবেদনশীলতার সুবিধায় তা জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে স্কাইওয়াচারের গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর পর্যবেক্ষণের সময় ৫৩০০ ঘন্টা ছাড়িয়েছে। যা বিশ্বের একই যন্ত্রের চেয়ে অনেক বেশি। যা জ্যোতির্বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সমর্থন দিয়েছে।

সম্প্রতি চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং মৌলিক গবেষণার বিষয়ে সরকারের এক আলোচনাসভায় বলেন, চীন সক্রিয়ভাবে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান মহলের উন্মুক্ত, আস্থা, সহযোগিতা জোরদার করবে, আরো বেশি নিজস্ব উদ্ভাবন এবং কেন্দ্রীয় প্রযুক্তি অর্জনের মাধ্যমে মানবসভ্যতার অগ্রগতির জন্য নতুন অবদান রাখবে। মানবজাতি অভিন্ন উন্নয়নের সমস্যা সমাধান করতে চাইলে, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও বিনিময় খুব প্রয়োজন। চীন আন্তর্জাতিক মৌলিক গবেষণা সহযোগিতার মঞ্চ স্থাপন করবে, বিশ্বের জন্য উন্মুক্ত বৈজ্ঞানিক গবেষণার তহবিল স্থাপন করবে, দেশের বৈজ্ঞানিক পরিকল্পনা জোরদার করবে, জলবায়ুর পরিবর্তন, জ্বালানি নিরাপত্তা, জৈব নিরাপত্তা এবং মহাকাশ ব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেশ-বিদেশের সহযোগিতা জোরদার করবে।

(শুয়েই/তৌহিদ/সুবর্ণা)