ফেব্রুয়ারি ২৮: দুই যুগে জনগণের হারানো আস্থা ফিরে পাওয়া যায় কি? ফুকুশিমা পরমাণু দুর্ঘটনা ঘটার ১২ বছর পর জাপানের ফুজি নিউজ নেটওয়ার্কে প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়। বাস্তবতা প্রমাণ করে যে জাপান সরকার জনগণের আস্থা ফিরে পাওয়া নয়, বরং হারানোর পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। গতকাল (সোমবার) চায়না মিডিয়া গ্রুপের (সিএমজি) এক সম্পাদকীয়তে এ মন্তব্য করা হয়েছে।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, জাপানের অর্থমন্ত্রী ইয়াসুটোশি নিশিমুরা পরমাণু বর্জ্য পানি সমুদ্রে নির্গমনের ব্যাপারে ফুকুশিমা প্রিফেকচারে ব্যাখ্যামূলক প্রেস ব্রিফিংয়ের আয়োজন করেন। আগের মতোই স্থানীয় মৎস্য খাতের ব্যক্তিরা এর দৃঢ় বিরোধিতা করেছে এবং তাদের অনুমতি ছাড়া জাপান সরকার বর্জ্য পানি সমুদ্রে নির্গমন করবে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। হাস্যকর ব্যাপার হলো যে বর্জ্য পানি সমুদ্রে নির্গমনের পরিকল্পনায় জনগণের সম্মতির মানদণ্ড কি? সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের উত্তরে ‘কোনো নির্দিষ্ট মানদণ্ড নেই বলে উত্তর দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী, যা জনমতকে উত্তেজিত করেছে।
দু’বছর আগে এপ্রিল মাসে জাপান সরকার ২০২৩ সালের বসন্তকাল থেকে ফুকুশিমা পরমাণু বর্জ্য পানি নির্গমনের ঘোষণা করেছে, যা দেশ-বিদেশে ব্যাপক সন্দেহ ও বিরোধিতা সৃষ্টি করেছে। ২০২২ সালের জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার প্রযুক্তি কর্মদলের বিদ্যমান পর্যালোচনার প্রেক্ষাপটে জাপান বর্জ্য পানি সমুদ্রে নির্গমনের পরিকল্পনা অনুমোদন করে। গত জানুয়ারিতে সে প্রযুক্তি কর্মদলের জাপানে পর্যালোচনা সফরের প্রাক্কালে আবার বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে বর্জ্য পানি সমুদ্রে নির্গমনের কথা ঘোষণা করে জাপান সরকার। তারপর জাপান পরিকল্পনাটির সংশ্লিষ্ট অবকাঠামো নির্মাণ বেগবান করে। তার এসব আচরণ আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্তৃত্ব লঙ্ঘনের পাশাপাশি জাপানি জনগণ ও আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি দায়িত্বহীনতার পরিচায়ক।
দক্ষিণ কোরিয়ার সমুদ্র বিজ্ঞান-প্রযুক্তি একাডেমি, পরমাণু শক্তি একাডেমির সম্প্রতি প্রকাশিত সর্বশেষ গবেষণা থেকে জানা গেছে, পরমাণু বর্জ্য পানি জাপানের পূর্বাঞ্চলের ফুকুশিমা জলসীমায় নির্গমন হলে তেজস্ক্রিয় উপাদান--ট্রিটিয়াম--উষ্ণ স্রোতের সঙ্গে পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়বে। আর তা দশ বছর পর উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরীয় জলসীমায় ছড়িয়ে পড়বে। ট্রিটিয়াম ছাড়া অন্যান্য উপাদানও ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্তমান প্রযুক্তিতে নির্মূল করা যায় না। তাই জাপান সরকার পরমাণু দূষিত পানি নিরাপদ বলে যে ব্যাখ্যা দিয়েছে, তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থার কর্মদল গত বছর এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, জাপানের বর্জ্য পানি সমুদ্রে নির্গমনের পরিকল্পনা সংস্থাটির নিরাপত্তা মানদণ্ডের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়।
তা ছাড়া, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশগুলোর ফোরামের নেতৃবৃন্দের অনানুষ্ঠানিক অধিবেশনে বিভিন্ন দেশের নেতারা জাপানের পরমাণু দূষিত পানি সমুদ্রে নির্গমনের পরিকল্পনার দৃঢ় বিরোধিতা জানিয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, এটি জাপানের ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, বরং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দ্বীপ দেশগুলোসহ বৈশ্বিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জাপানের উচিত বিজ্ঞান-ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।
তা ছাড়া, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের এক অধিবেশনে চীন ও রাশিয়া জাপানের সে পরিকল্পনার বিরোধিতা জানিয়েছে। জাপানের সে পরিকল্পনা সামুদ্রিক পরিবেশ, বাস্তুতন্ত্র এবং বিভিন্ন দেশের জনস্বাস্থ্য গুরুতর ক্ষতি করবে। জাপান তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ না করে একতরফাভাবে সে পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে।
দেশি-বিদেশি সন্দেহ ও বিরোধিতা উপেক্ষা করে জাপান সরকার অনুতাপহীন রয়েছে। জাপানের কিয়োডো বার্তা সংস্থা গত ২২ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছে, জাপান সরকার আগামী মে মাসে অনুষ্ঠেয় জি-৭ শীর্ষসম্মেলনের যৌথ বিবৃতিতে এমন কথা অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছে যে ‘ফুকুশিমার পরমাণু দূষিত পানি সমুদ্রে নির্গমন করলে তা শরীর ও পরিবেশের ক্ষতি করবে না। পাশাপাশি, এ বিষয়টি মোকাবিলার পদ্ধতি স্বচ্ছ, যাকে স্বাগত জানানো উচিত। তবে, একে অযৌক্তিক বলে মনে করে অনেক জাপানি গণমাধ্যম। কিয়োডো বার্তা সংস্থা জানায়, পরমাণু দূষিত পানি সমুদ্রে নির্গমন করার পরিকল্পনার দৃঢ় বিরোধিতা করছে চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ নানা দেশ। জি-৭’র অভ্যন্তরে মতৈক্য অর্জিত হতে পারেনি, তাই এসব কথা বিবৃতিতে অন্তর্ভুক্ত করা খুব কঠিন হবে। জাপানের এ আচরণে দেশটির সরকারের চরম স্বার্থপরতা প্রতিফলিত হয়েছে। জাপান সরকার আন্তর্জাতিক বাধা উপেক্ষা করে দূষিত পানি সমুদ্রে নির্গমন করলে আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত হবে আইনি পদ্ধতিতে যৌথ স্বার্থ রক্ষার অভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া।
(রুবি/এনাম)