কর্মসংস্থান নিয়ে পরিকল্পনা প্রসঙ্গ
2023-02-27 15:49:08

পেশা নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শিক্ষার্থীদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ব্যাপারে যথাসময়ে সঠিক পরিকল্পনা করা গেলে, সেটা পরবর্তী কালে কর্মসংস্থানের সুযোগ অনুসন্ধানে তাদের সাহায্য করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে: কীভাবে সঠিক পরিকল্পনা করা যায়? আজকের অনুষ্ঠানে কয়েকজন চীনা যুবকের গল্প ও এসংক্রান্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরবো।

 

চীনের সিনচিয়াং বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স শিক্ষার্থী লিউ সিয়াও লিন তৃতীয় বর্ষে অধ্যয়নকালেই উপযুক্ত পেশায় নিজেকে যুক্ত করার আগাম পরিকল্পনা করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনা, জন্মস্থানের সরকারি প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেওয়া। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য, গত বছরের জুলাই মাস থেকেই, রাষ্ট্রীয় সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করে সে।

 

ছেলে লুও রং হাও চীনের কৃষি ও বনবিদ্যা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করে। অনার্সের তৃতীয় বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের পেশাদার সহকারী অধ্যাপক পদের জন্য আবেদন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর পরিকল্পনা, স্নাতক হওয়ার পর, সহকারী অধ্যাপকের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করা।

 

চীনের বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিয়ানতি শিক্ষা কোম্পানির সহযোগী প্রতিষ্ঠাতা ম্যাডাম থাং সিয়াও ইয়ুনের ১৮ বছরের কর্মঅভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি মনে করেন, পেশার পরিকল্পনা আসলে জীবনের পরিকল্পনা। পেশার পরিকল্পনা মাধ্যমে আমরা কী ধরনের জীবন কাটাবো, কার সাথে পরিচিত হবো, এবং সমাজে কী ভুমিকা পালন করবো, তা মোটামুটি নির্ধারণ করে ফেলি। তাই, সঠিক পরিকল্পনা জরুরি।

 

ছাত্রী লিউ সিয়াও লিন নিজের স্বভাব-চরিত্র বিবেচনা করে, কয়েকটি সম্ভাব্য পেশাকে তাঁর পছন্দের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে। যেমন, জনসংযোগ আর বিক্রয়সম্পর্কিত চাকরি অন্তর্মুখী মেয়ে লিউ’র জন্য বড় চ্যালেঞ্জিং। সে মনে করে, নিজের স্বভাব-চরিত্রের সাথে মানানসই কাজ করা উচিত। তা না হলে পেশাজীবনে উন্নতি করা যায় না। বস্তুত, তাঁর ধারণা অসত্য নয়।

 

বন্ধুর পেশা-পরিকল্পনা সম্পর্কে মেয়ে লিউ বলে, যদি পেশার পরিকল্পনায় শুধু কল্পনা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে বিবেচনা করা হয়, বাস্তবতাকে বিবেচনায় না নেওয়া হয়, তবে চাকরি পাওয়া কঠিন হবে। তার একজন বন্ধু নিজের পেশার পূর্ব-পরিকল্পনা অনুসারে বিদেশে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু চীনে ফিরে নিজের পছন্দের চাকরি পায়নি। বিদেশে তাঁর সময় ও টাকা—দুটোই নষ্ট হয়েছে বলা চলে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে যেকেউ হতাশ হয়ে যেতে পারে। তাই, বাস্তবতার নিরিখে পরিকল্পনা করা উচিত।

 

ছেলে লুও রং হাও জানায়, তাঁর অনেক সহপাঠী পেশার পরিকল্পনা করার সময় নিজেদের প্রাধান্য, বহুমুখী দক্ষতা ও সংশ্লিষ্ট পেশার চাহিদা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেনি। অন্যদের দেখাদেখি তাঁরা পরিকল্পনা করেছে। কিন্তু তার ফল ভালো হয়নি। তারা তাদের পছন্দের চাকরি পায়নি।

 

চীনের ইউথ পত্রিকার জরিপ থেকে জানা গেছে, যদি পেশার ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা না থাকে, তাহলে চাকরি পেতে সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে উচ্চাকাঙ্খা হচ্ছে সবচেয়ে বড় সমস্যা। এ সম্পর্কে ম্যাডাম থাং সিয়াও ইয়ুন বলেন, পেশার পরিকল্পনায় দুটি বিষয় অতি গুরুত্বপূর্ণ: একটি হল নিজের পছন্দ এবং আরেকটি হল নিজের যোগ্যতা ও দক্ষতা। নিজের পছন্দের কাজে যদি কেউ দক্ষ হয়, তবে সে  কাজ পাওয়া তার জন্য সহজতর হয়। ভবিষ্যতেও সে সেকাজে ভালো করতে পারবে বলে আশা করা যায়।

 

পেশার পরিকল্পনায় সঠিক লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা জরুরি। কেউ কেউ নির্দিষ্ট কোনো কোম্পানিতে কাজ করার জন্য পরিকল্পনা করতে পারে। তবে, পেশার পরিকল্পনা আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত। যেমন, ইন্টারনেট কোম্পানিতে এআই প্রযুক্তির সাথে জড়িত কাজের জন্য পরিকল্পনাকে বলা যেতে পারে পেশার জন্য পরিকল্পনা। সেক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট কোম্পানি নয়, বরং নির্দিষ্ট পেশার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। প্রস্তুতিশেষে যে-কোনো কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পাওয়া যেতে পারে।

 

চীনের ইউথ পত্রিকার এক জরিপ থেকে জানা গেছে, ৯৫.৪ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থী মনে করেন, কর্মসংস্থানের পরিকল্পনার সাথে বাস্তবতার ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। এ সম্পর্কে সহকারী শিক্ষক লুও রং হাও বলেন, তাঁর একজন মাধ্যমিক স্কুলের সহপাঠী ভবিষ্যতের চাকরির জন্য সুস্পষ্ট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। তার লক্ষ্য, বেতন বিবেচনা করে চাকরি নেওয়া। যেমন, কম্পিউটার বিভাগের স্নাতক শিক্ষার্থীদের বেতন তুলনামূলক বেশি। তাই, সে এ বিষয়কে মেজর হিসেবে বেছে নিয়েছে। ফলে, সে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী থাকাকালেই অনেক ইন্টারনেট কোম্পানির অফার পেয়েছে।

 

ম্যাডাম থাং সিয়াও ইয়ুন কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। প্রথমত, জীবনের লক্ষ্য ঠিক করার জন্য দৃষ্টান্ত খুঁজে দেখা। আশেপাশের সুপরিচিত লোকদের কর্মজীবন এ ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত হতে পারে। তাদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করা। দ্বিতীয়ত, নিজের প্রাধান্য ও দুর্বলতা সঠিকভাবে জানা জরুরি। এভাবে কী কাজ সে ভালোভাবে করতে পারবে, তা জানা যাবে। তৃতীয়ত, নিজের প্রিয় কোম্পানিতে ইন্টারশিপের জন্য আবেদন করা। কর্মসংস্থানের জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ।

 

বসন্ত উত্সবের ছুটিতে রেলপথের যুব স্বেচ্ছাসেবকদের গল্প

চলতি বছরের বসন্ত উত্সব গত কয়েক বছরের চেয়ে একটু আলাদা ছিল। কারণ, জানুয়ারি মাসে চীনে কোভিড-প্রতিরোধক নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাই যারা টানা কয়েক বছর জন্মস্থানে ফিরে যেতে পারেননি, এ বছর তাদের যাওয়ার সুযোগ হয়। বসন্ত উত্সবের সময় এবার যাত্রীদের মোট সংখ্যা ২১০ কোটি পার্সনটাইমস ছাড়িয়ে যায়। এতো যাত্রী পরিবহন করা চীনের বিমানপথ, রেলপথ ও সড়কপথের জন্য জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। যাত্রীদের সুষ্ঠু যাত্রা নিশ্চিত করতে, রেলস্টেশনগুলোতে তাই অনেক যুব স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করা হয়। ব্যস্ত রেলস্টেশন, বিশাল ট্রেন মেরামত কারখানা, দূরবর্তী এলাকার ছোট রেলস্টেশন—সর্বত্রই স্বেচ্ছাসেবকদের আন্তরিক হাসি দেখা গেছে।  তাদের সাহায্যে যাত্রীরা উষ্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে ভ্রমণ করতে পেরেছেন।


যদিও স্বেচ্ছাসেবকদের বয়স কম, তবে তারা মনোযোগ দিয়ে পরিষেবা দিয়েছেন। ছেংতুং থেকে ছোংছিং মহানগরে যাওয়ার রেলপথে যুব স্বেচ্ছাসেবকরা ‘পর্যটক গাইড’-এর মতো যাত্রীদের সামনে রেলপথের বিভিন্ন স্টেশনের ভৌগোলিক অবস্থান ও দর্শনীয় স্থানের তথ্য তুলে ধরেন। অনেকে ট্রেনে বাচ্চাদের যত্নে সংশ্লিষ্ট পিতামাতাকে সহায়তা দিয়েছেন। ট্রেনের ‘নিরাপত্তা ক্লাসে’ বাচ্চাদের গান ও কার্টুনের মাধ্যমে নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট তথ্য জানানো হয়।

 

শেনচেন উত্তর স্টেশনে ‘ইংছুনহুয়া’ স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মীরা ইউনিফর্ম পরে সোজা লাইনে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের স্বাগত জানায়। একদিনে কয়েক হাজার বার ‘স্বাগতম’ কথাটা বলতে হয় তাদের। দলের যুব কর্মী কেং বি ছেং বলেন, “যাত্রীদের স্বীকৃতি ও কৃতজ্ঞতা আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো উপহার।” বসন্ত উত্সবের সময় সবাই দ্রুত জন্মস্থানে ফিরে যেতে চান। তাই তাদের সুষ্ঠু যাত্রা নিশ্চিত করতে স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা কাজ করেছেন। তারা নিজেদের পরিবারকে কিন্তু তখন খুব বেশি একটা সময় দিতে পারেননি! কিন্তু যাত্রীদের হাসি ও কৃতজ্ঞ চেহারা তাদের আনন্দ দিয়েছে।

 

রেলস্টেশনের স্বেচ্ছাসেবক কর্মীদের পাশাপাশি, রেল-মেরামতকারী কর্মীরাও বসন্ত উত্সবের সময় অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। তারা রেলপথের নিরাপদ যাত্রার স্তম্ভ। যে কোনো ট্রেনের সমস্যা থাকলে তারা দিনরাত ধরে কারখানায় মেরামতকাজ করে থাকেন। যাত্রীরা হয়তো কখনো মেরামতকারীদের সাথে দেখা করার সুযোগ পান না, তবে তারা বিভিন্ন লাইনে বিভিন্ন ট্রেনের নিরাপদ যাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে থাকেন।

 

চীনের মোহান বন্দর থেকে লাওসের মোতিং বন্দর পর্যন্ত নিয়মিত মালবাহী ট্রেন চলাচল করে। বিভিন্ন পণ্যের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করতে ট্রেনের সাথে স্বেচ্ছাসেবক কর্মী থাকা প্রয়োজন। বসন্ত উত্সবের ছুটিতেও তারা সাধারণ কর্মদিনের মতো কাজ করেছেন, ট্রেনে দু’দেশের মধ্যে যাওয়া-আসা করেছেন।

 

চলতি বছরের বসন্ত উত্সব চলাকালে খুনমিং বিয়ারিং টেস্টিং স্টেশনের কর্মীরা ব্যস্ততার মধ্যে কাজ করেন। এ স্টেশনের কর্মী ইয়াং ইয়ু চিয়াও বলেন, “অতীতে আমি কেবল বসন্ত উত্সবের যাত্রায় একজন যাত্রী ছিলাম। তবে, চাকরি নেওয়ার পর আমি রেলপথের একজন কর্মী। যদিও ছুটির দিনে আমি পরিবারের সদস্যদের সাথে মিলিত হতে চাই, তবে অন্য যাত্রীদের সময়মতো বাড়ি ফেরা নিশ্চিত করতে আমাকে কাজে থাকতে হয়। তাদের সুষ্ঠু যাত্রা নিশ্চিত করা আমার মূল কাজ।”

 

বসন্ত উত্সবের যাত্রা শেষ হয়েছে, তবে রেলপথে বিভিন্ন কাজে জড়িত কর্মীদের কাজ শেষ হয়নি। ফুচিয়ান প্রদেশের লংইয়ান স্টেশনের যুব স্বেচ্ছাসেবক চেং ইয়ো লিন বলেন, “বসন্ত উত্সবের ছুটি শেষ হয়েছে, আবার নতুন সেমিস্টারও শুরু হয়েছে। তাই জন্মস্থান থেকে বড় শহরে যাওয়া বাচ্চা ও প্রবীণের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তাদের লাগেজ বেশি এবং বাচ্চাদের নিয়ে যাত্রা অনেক কষ্টকর। তাই আমরা এমন যাত্রীদের যাতায়াতে সাহায্য দিতে চেষ্টা করি।”

 

গত ৩০ বছর ধরে রেলপথের স্বেচ্ছাসেবকরা বসন্ত উত্সবের সময় কাজ করে আসছেন। তাদের কাজে ফুটে ওঠে স্বেচ্ছাসেবার চেতনা।

 

 (সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)