‘কিন্ডারগার্টেনের’ মতো বৃদ্ধাশ্রম
2023-02-23 18:44:31

 

আপনাদের ধারণায় বৃদ্ধাশ্রম কীরকম হতে পারে? বিরক্তিকর ও প্রাণহীন? আপনারা কি আগে কখনও ‘কিন্ডারগার্টেনের’ মতো বৃদ্ধাশ্রমের কথা শুনেছেন? আজকের অনুষ্ঠানে চলুন সবাই মিলে ‘কিন্ডারগার্টেনের’ মতো একটি বৃদ্ধাশ্রমে ঘুরে বেড়াবো।

 

চীনের হ্যনান প্রদেশে এমন একটি বৃদ্ধাশ্রম আছে, যেখানে বৃদ্ধবৃদ্ধারা ই-স্পোর্টস খেলেন, সংক্ষিপ্ত ভিডিও শুটিং করেন এবং লাইভ সম্প্রচারও করেন। ফ্যান চিনলিন নামের একজন তরুণ এই বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার পরিচালিত এই বৃদ্ধাশ্রম সাধারণ বৃদ্ধাশ্রমসংক্রান্ত মানুষের ঐতিহ্যগত ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে।

 

২৬ বছর বয়সী ফ্যান চিনলিন ইতোমধ্যেই ৫টি নার্সিং হোমের পরিচালক। তিনি শুধু বয়স্কদের ভালো যত্ন নেন না, বরং দাদা-দাদিদের অনেক মজাও দেন। তার বৃদ্ধাশ্রমে বাসরত বৃদ্ধবৃদ্ধারা ছোট ভিডিও তৈরি করতে, ই-স্পোর্টস খেলতে এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করতে শিখে ফেলেছেন। বয়স্ক হলেও, তাদের জীবন তরুণ-তরুণীদের মতো প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে এখানে।

 

ফ্যান চিনলিন, হ্যনান প্রদেশের সুই ছাং শহরের বাসিন্দা। তার মাথায় বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার চিন্তা আসে নিজের দাদীর অসুস্থতার অভিজ্ঞতা থেকে।

 

২০১৭ সালে, তার দাদি দুর্ঘটনাক্রমে বাড়িতে পড়ে গিয়েছিলেন এবং হাড় ভাঙ্গা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। তখন তার বাবা-মা কাজে ব্যস্ত ছিলেন, ফ্যান চিনলিন, যিনি তখন কলেজে ছিলেন, দাদীর যত্ন নিতে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে  যান। সেই সময় তিনি ভাবলেন যে, যদি একটি নার্সিং হোম বা বৃদ্ধাশ্রম খুলতে পারি এবং আমার দাদিকে সেখানে রাখতে পারি, তখন তার যত্নের অভাব হবে না।

 

ফ্যান চিনলিনের বাবা বয়স্কদের যত্ন নিতে অভ্যস্ত। তিনি  হ্যনান প্রদেশে বয়স্কদের জন্য প্রথম সরকারি মালিকানাধীন বৃদ্ধাশ্রম পরীক্ষামূলকভাবে পরিচালনা করার দায়িত্ব পান। তার বাবার প্রভাবে, ফ্যান চিনলিন নিজের বৃদ্ধাশ্রম খুলতে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ফ্যান চিনলিন নিজেই বয়স্কদের যত্ন নেওয়াসম্পর্কিত সার্টিফিকেট অর্জন করেন। তিনি একে একে মনস্তাত্ত্বিক পরামর্শদাতা, বয়স্ক যত্নকর্মী, নির্মাণ অগ্নিনির্বাপক, এবং বয়স্ক মূল্যায়নকারী হিসেবে কাজ করার লাইসেন্স পান। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষে পড়াকালীন তিনি বাবার বৃদ্ধাশ্রমে একটি সময়ের জন্য ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করেন। সেই সময়ে তিনি দেখতে পেলেন যে, ঐতিহ্যবাহী নার্সিং হোম বা বৃদ্ধাশ্রম তার নিজের কল্পিত নার্সিং হোম থেকে আলাদা। তিনি বলেন, ‘এটি সেই নার্সিং হোম ছিল না যা আমি তৈরি করতে চাই।’

 

তারপর ফ্যান চিনলিন চীনের বিভিন্ন জায়গার বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করা শুরু করেন এবং ছোট ভিডিও তৈরি করে নিজের যোগাযোগ-মাধ্যমের আকাউন্টে পোস্ট করতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘এতো বেশি বৃদ্ধাশ্রম পরিদর্শনের পর আমার বৃহত্তম অনুভূতি হলো যে, বয়স্কদের বস্তুগত জীবন উন্নতি হওয়ার পর তাদের আধ্যাত্মিক পরিষেবার চাহিদা আরও বেশি হবে। বিভিন্ন জায়গায় বৃদ্ধাশ্রমগুলো এই দিকে উন্নয়নের চেষ্টা করছে, কিন্তু মাঝেমাঝে বয়স্কদের প্রকৃত মানসিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না।’

 

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর ফ্যান চিনলিন দুটি নার্সিং হোমের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন। নিজের অনুশীলনে তিনি নতুন বিষয় আবিষ্কার করেন। একদিন, একজন বৃদ্ধা তাকে বলেছিলেন যে, তিনি ‘ই-গেম’ শিখতে ও খেলতে চান। তিনি তাকে যে, তার নাতি ই-গেম খেলতে পছন্দ করে। যদি তিনি নিজেই এটি শিখে ফেলেন, তাহলে নাতির ছুটির সময় তার সাথে খেলতে পারেন। সেই সময়ে ফ্যান চিনলিন বুঝতে পেরেছিলেন যে, সমস্ত বয়স্ক মানুষ স্কোয়ার ডান্স নাচ এবং থাই চি করতে পছন্দ করেন না। কিছু বয়স্ক মানুষ নিজেকে  'বৃদ্ধ শিশু' বলে মনে করেন, তারা ছোটদের জিনিস শিখতে ও খেলতে চান।

 

২০২০ সালের জুলাই মাসে ফ্যান চিনলিন সেলফোন নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে একজোড়া বৃদ্ধার স্ল্যাপস্টিকের দৃশ্য শুটিং করে স্বল্প ভিডিও প্লাটফর্মে পোস্ট করেন। অপ্রত্যাশিতভাবে ভিডিওটি খুব ভাল সাড়া পায়। নেটিজেনরা একের পর এক কমেন্ট করতে থাকেন এবং বয়স্ক হওয়ার পর এমন একটি বৃদ্ধাশ্রমে থাকার আগ্রহ প্রকাশ করেন।

 

ফ্যান চিনলিন বলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে অনেকেরই বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে কিছু পূর্বধারণা রয়েছে। তারা মনে করেন যে, বৃদ্ধাশ্রমের পরিবেশ নোংরা, অগোছালো, বিশৃঙ্খল, এমনকি বয়স্কদেরও সেখানে গালাগালিও দেওয়া হয়। আমি আশা করি যে, আমার ভিডিওর মাধ্যমে, সবাই বৃদ্ধাশ্রম সম্পর্কে একটি ভালো ও প্রকৃত ধারণা পাবেন।’

 

তারপর ফ্যান চিনলিন বৃদ্ধাশ্রমের দৈনিক কার্যকলাপের ওপর সিরিজ ভিডিও তৈরি করেন এবং সেগুলো নিজের সংক্ষিপ্ত ভিডিও অ্যাকাউন্টে পোস্ট করেন। বিপুলসংখ্যক ভক্তের দৃষ্টি সেদিকে আকৃষ্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাকাউন্ট থেকে আয় হতে থাকে। ফ্যান চিনলিনের মনে তখন একটি নতুন ধারণা সৃষ্টি হয়। তিনি সংক্ষিপ্ত ভিডিও প্লাটফর্ম থেকে প্রাপ্ত আয় বয়স্কদের সেবায় কাজে লাগাতে শুরু করেন। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্যান চিনলিন তার পঞ্চম বৃদ্ধাশ্রম তৈরি করার জন্য প্রস্তুতি নেন। এই বৃদ্ধাশ্রমে সমস্ত বয়স্ক লোকদের বিনামূল্যে ভর্তি করা হয়। ফ্যান চিনলিন বৃদ্ধাশ্রমের দৈনন্দিন জীবন ভিডিও করে যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করতে থাকেন এবং এ থেকে অর্জিত টাকা দিয়ে বৃদ্ধাশ্রমের ব্যয় নির্বাহ করেন।

 

তাঁর বৃদ্ধাশ্রমে শুধুমাত্র আরামদায়ক পরিবেশই নেই, সাথে সাথে সেখানে ই-গেম খেলার রুম, ভিআর রুমসহ নানান রুম রয়েছে। ফলে এটি একটি ‘নেট সেলিব্রিটি’ বৃদ্ধালয়ে পরিণত হয়। ‘বৃদ্ধ শিশুরা’ এখানে যুবকদের বিনোদনমূলক কার্যকলাপ শিখেছেন, এমনকি ইন্টারনেট স্ল্যাং বলতেও শিখেছেন এবং এতে অনেক মজাও পাচ্ছেন। কিছু নেটিজেন রসিকতা করেন বলেন যে, ফ্যান চিনলিন বৃদ্ধাশ্রমকে একটি ‘কিন্ডারগার্টেনে’ পরিণত করেছেন।

 

‘সেলফ-মিডিয়া প্লাস বৃদ্ধাশ্রম’ মডেলের অপারেশনটিও অনেক সন্দেহের সম্মুখীন হয়। কিছু লোক মনে করেন যে, ফ্যান চিনলিন নিজের জন্য অর্থোপার্জনে বৃদ্ধদের ব্যবহার করছেন। ‘কীভাবে কিছু মানুষের এই ভুল ধারণা দূর করা যায়, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। কিন্তু আমি অটল থাকি। আমি আশা করি যে, এর মাধ্যমে আরও বয়স্ক লোক এটি দেখতে পাবেন, বিশেষ করে যাদের প্রকৃত প্রয়োজন আছে, তারা আমাদের সেবা সম্পর্কে জানতে পারবেন।’ ফ্যান চিনলিন আরও বলেন যে, তিনি এটিকে সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক করতে চান না। তিনি বলেন, ‘আমি একজন মিডিয়া ব্যক্তি এবং একজন পরিসেবাকারী হতে চাই, যিনি সত্যিই বয়স্কদের সেবা করার শিল্পকে প্রচার করতে পারেন, একজন ব্যবসায়ীর সাথে জড়িত ব্যক্তি নন।’

 

ফ্যান চিনলিনের বৃদ্ধাশ্রমের একটি স্লোগান আছে, আর তা হলো: বৃদ্ধরা যেখানে আছেন, সেখানেই তাদের বাড়ি। তার মতে, পেনশন শিল্প বা বয়স্কদের সেবা করা মানেই প্রবীণদের প্রয়োজন পূরণে কাজ করা। বয়স্করা বাড়িতে থাকতে বা বৃদ্ধাশ্রমে তাদের সমবয়সীদের সাথে থাকতে চান। অবশ্যই বয়স্কদের পছন্দকে সম্মান করতে হবে। ফ্যান চিনলিন মনে করেন, বৃদ্ধাশ্রম এমন একটি জায়গা, যেটি বয়স্কদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সাহায্য করতে পারে।  বয়স্করা যেকোনো উপায় বেছে নিয়ে তাদের বার্ধক্য কাটাতে পারেন। এটাই বয়স্কদের সেবা করার অর্থ।