তুরস্ক ও সিরিয়ায় গত ৬ ফেব্রুয়ারি আঘাত হানে শক্তিশালী ভূমিকম্প। শতাব্দির সবচেয়ে ভয়াবহ এ দুর্যোগে সিরিয়ার আলেপ্পো এবং হামা শহর থেকে তুরস্কের দিয়ারবাকির পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকায় হাজার হাজার ভবন ধসে পড়ে। তুরস্ক ও সিরিয়ায় মৃতের সংখ্যা ২৭ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে তুরস্কে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২২ হাজার। দেশটিতে আহত হয়েছেন ৮০ হাজারের বেশি মানুষ। সিরিয়ায় ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজার ছাড়িয়েছে। তুরস্ক সরকার ৭ দিনের জাতীয় শোক ও দুর্গত ১০ প্রদেশে তিন মাসের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করে।
ভূমিকম্পের ৭ দিন পরও বহু মানুষ আটকা পড়ে রয়েছেন ধংসস্তুপের নিচে। চীন ও বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যোগ দিয়েছে উদ্ধার ও ত্রাণ কাজে। ভূমিকম্পের ৫ দিন পরেও তুরস্কে ধংসস্তুপ থেকে এক নারীকে উদ্ধার করে চীনা উদ্ধারকারী দল। ভূমিকম্পের পর ৭ দিনে গড়ালেও এখনো আটকা পড়া মানুষকে জীবিত উদ্ধারে সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন চীন ও আন্তর্জাতিক উদ্ধারকারী দলগুলো।
ভয়াবহ এ মানবিক দুর্যোগে চীনসহ সারা বিশ্ব দাঁড়িয়েছে তুরস্ক ও সিরিয়ার পাশে। চীন সরকার ত্বরিৎগতিতে দাঁড়ায় দুর্গত দেশদুটির পাশে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তুর্কি প্রেসিডেন্ট রেসেপ তাইপ এরদোয়ান ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আসাদকে শোক ও সমবেদনা-বার্তা পাঠান।
শোক বার্তায় সি চিন পিং জানান, তুরস্ক ও সিরিয়ায় শক্তিশালী ভূমিকম্পের আঘাতে ব্যাপক হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতিতে মর্মাহত হয়েছেন তিনি। চীন সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্য ও আহতদের জন্য সমবেদনা জানান সি চিন পিং।
তিনি আশা করেন দুই দেশের প্রেসিডেন্টদের নেতৃত্বে, দেশের সরকার ও জনগণ অবশ্যই দ্রুত দুর্যোগ মোকাবিলা করতে পারবে এবং বাসস্থান পুনর্নির্মাণ করতে পারবে। চীনের পক্ষ থেকে ত্রাণ ও উদ্ধার তৎপরতায় সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বাস দেন প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন কাংও শোক ও সমবেদনা জানিয়ে তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলুকে বার্তা পাঠান।
চীন সরকার শুধু শোক ও সমবেদনা জানিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। দ্রুত তুরস্ক ও সিরিয়ায় জরুরি ত্রাণ ও উদ্ধারকারী দল পাঠিয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবে দেশ দুটির জন্য ৭ কোটি ডলার মূল্যের জরুরি ত্রাণ সহায়তার ঘোষণা দেয় বেইজিং।
চীনের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও সহযোগিতা সংস্থার উপ-প্রধান তেং পো ছিং জানান, তুরস্কের জন্য ৪ কোটি ডলার ও সিরিয়ার জন্য ৩ কোটি ডলার মূল্যের জরুরি ত্রাণ সহায়তা বরাদ্দ করা হয়েছে। ভূমিকম্পের পরপরই চীন ২০০ টন গম পাঠায় তুরস্কে। আরও ৩ হাজার টন গম ও চাল পাঠানো হবে শিগগির। তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্গতদের জন্য চীনা সরকারের ত্রাণের প্রথম চালান শনিবার বিকালে ইস্তাম্বুল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছায়।
এর মধ্যে ৮৪ টন ওজনের ৪০ হাজার কম্বলের প্রথম চালানটি রয়েছে। চীনের অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী যেমন, তাঁবু, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফ মেশিন, আল্ট্রাসনিক ডায়াগনস্টিক সরঞ্জাম, মেডিকেল ট্রান্সপোর্ট যানবাহন এবং ম্যানুয়াল হাসপাতালের বিছানা শিগগির তুরস্কে পাঠানো হবে।
সিরিয়াকে পাঠানো চীনা রেডক্রস সোসাইটির প্রথম দফা চিকিৎসা সামগ্রী বৃহস্পতিবার দামেস্কে পৌঁছেছে। সিরিয়ায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত শি হোং ওয়েই, সিরিয়ার আঞ্চলিক পরিচালনা ও পরিবেশ উপমন্ত্রী মুয়াতাজ ও সিরিয়ান আরব রেড ক্রিসেন্টের চেয়ারম্যান খালিদ হুব্বা বিমানবন্দরে এসব সামগ্রী গ্রহণ করেছেন। শি হোং ওয়েই এ সময় বলেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সিরিয়ার পাশে থাকবে চীন। মুয়াতাজ চীনের সাহায্যের জন্য কৃতজ্ঞতা জানান।
ভূমিকম্পের একদিনের মাথায় ৮ ফেব্রুয়ারি চীনের ৮২ সদস্যের সরকারি উদ্ধারদল ২০ টন জরুরি ত্রাণসহ পৌঁছে যায় তুরস্কে। তারা সার্বাক্ষণিকভাবে উদ্ধার ও ত্রাণকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এ পর্যন্ত এ দলটি একজন গর্ভবতী নারীসহ ৪ জনকে ধংসস্তুপ থেকে জীবিত উদ্ধার করেছে। এদের মধ্যে একজনকে উদ্ধার করা হয় ভূমিকম্পের ৫ দিন পর। চীনের সরকারি উদ্ধার দলের এ তৎপরতা ব্যাপক প্রশংসা ও অভিনন্দন পায় তুরস্ক ও আন্তর্জাতিক মহলে।
এ ছাড়া রেডক্রসসহ চীনের বেসরকারি উদ্ধারদল রাম ইউনিয়ন রেসকিউ টিম, ব্লু স্কাই রেসকিউ টিম, হংকং বিশেষ প্রশাসনিক অঞ্চলের ৫৯ সদস্যের উদ্ধার দল তুরস্কে উদ্ধারকাজ চালাচ্ছে। এদের মধ্যে রাম ইউনিয়ন রেসকিউ টিম ৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করেছে।
তুরস্ক ও সিরিয়ায় গত সোমবারের ভূমিকম্পকে শতাব্দির সবচেয়ে ‘ভয়াবহ বিপর্যয়’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি-জেনারেল এবং মানবিক বিষয়ক জরুরি ত্রাণ সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথস তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশে শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থল সোমবার এখানে যা ঘটেছিল, তা এই অঞ্চলে ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ঘটনা’।
গ্রিফিথস বলেন, চীনসহ ১০০টিরও বেশি দেশ তুরস্কে জরুরি উদ্ধারদল পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন এর চেয়ে অনেক বেশি। জাতিসংঘ সংস্থাগুলো ভূমিকম্প দুর্গতদের জন্য অর্থ সংগ্রহের আবেদন জানাবে এবং প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সাহায্য করবে।
চীনের মতোই বিশ্বের অনেক দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সিরিয়ার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা নিষেধাজ্ঞা ও দেশটির তেল ও গ্যাসক্ষেত্রের ওপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণ দেশটিতে ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে। তাই দেশ দুটির পাশে দাঁড়ানোর পাশাপাশি মানবিক কারণে সিরিয়ার ওপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও নিয়ন্ত্রণ তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সিরিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত ইমাদ মুস্তাফা।
মাহমুদ হাশিম
ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।