“আমরা সহায়তা চাই, আমরা আর সহ্য করতে পারছি না। পশ্চিমা দেশ সিরিয়ার মানুষকে শাস্তি দিচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা বাতিল করতে হবে।” গত ৭ ফেব্রুয়ারি, সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে ভূমিকম্প কবলিত আলেপ্পো শহরে একজন শিক্ষক আয়িশা আল হিলু সিরিয়ার উপর যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশের একতরফা অবরোধ ব্যবস্থা নিয়ে ক্রুদ্ধভাবে অভিযোগ করেন।
৬ ফেব্রুয়ারি, তুরস্ক ও সিরিয়ার সীমান্তে দু’বার ৭.৮ মাত্রার বড় ভূমিকম্প আঘাত হানে। সিরিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ভূমিকম্পে সিরিয়ায় ১২৫০জন নিহত ও ২০৫৪জন আহত হয়েছে। আলেপ্পো শহরে ৫০টির বেশি ভবন ধ্বংস হয়েছে এবং হতাহতের সংখ্যা আরও বাড়ছে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার মানুষ মানবিক সংকটের মুখে পড়েছে এবং এই ভূমিকম্পে সেই অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। ভূমিকম্পের পর ত্রাণ কাজ জরুরি একটি ব্যাপার। সময় দিয়ে জীবন রক্ষা করা যায়। তবে সিরিয়ায় নানা সমস্যা দেখা যাচ্ছে।
সিরিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দীর্ঘসময় ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে সিরিয়ায় ত্রাণ সরঞ্জামের অভাব দেখা দিয়েছে এবং ত্রাণ কর্মীদের কাজ করতে দ্বিগুণেরও বেশি সময় লাগে। মানুষকে দুই হাত দিয়ে ধ্বংসাবশেষ সরাতে হচ্ছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিংক ট্যাংকের মধ্যপ্রাচ্য গবেষণালয়ের গবেষক এমা বিয়ার বলেন, সিরিয়ায় যাবার রাস্তাগুলো গুরুতরভাবে নষ্ট হয়েছে। তাই ত্রাণ সামগ্রী পাঠাতে দেরি হচ্ছে। অবরোধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর গাড়িতে জ্বালানিও নেই।
এমন জরুরি অবস্থায় সিরিয়া আরব রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ নানা সংস্থা- যুক্তরাষ্ট্রকে যত দ্রুত সম্ভব একতরফা নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। তবে, তীব্র ঠান্ডায় গৃহহীন মানুষ, ধ্বংসাবশেষের নিচে হতাশার কান্না, আন্তর্জাতিক সমাজের আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের বিবেক জাগাতে পারছে না। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস স্পষ্টভাবে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র শুধু স্থানীয় মানবিক অংশীদারের মাধ্যমে সহায়তা দেবে এবং সিরিয়ার আসাদ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবে না।
সাম্প্রতিক দিনে চীনসহ বিশ্বের নানা দেশ ও অঞ্চল তুরস্ক ও সিরিয়ার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছে এবং সহায়তা দিয়েছে। বিশ্ব ঐক্যবদ্ধ থেকে ভূমিকম্প মোকাবিলায় ত্রাণ কাজ করে এবং যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তা হতাশাজনক, তবে আশ্চর্যজনক নয়।
২০১১ সালে সিরিয়ায় যুদ্ধ শুরু হলে যুক্তরাষ্ট্র বার বার সামরিক হস্তক্ষেপ করেছে এবং দেশের উপর কঠোর অবরোধ আরোপ করেছে। এমনকি সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ তেল উৎপাদন এলাকা দখল করে ৮০ শতাংশ তেল লুটপাট করেছে। সিরিয়ার মজুদ করা খাদ্য চোরাচালান করেছে এবং খাদ্য-সম্পদ পুড়িয়ে ফেলেছে। দস্যুর মতো আচরণ স্থানীয় মানুষের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে এনেছে।
সিরিয়া নয়, গেল কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র নিজের আধিপত্য রক্ষায় নিষেধাজ্ঞার অপব্যবহার করছে। যখন ইরান ও সিরিয়ায় কোভিড-১৯ মহামারি দেখা দেয়, তখন মার্কিন সরকার লক্ষ লক্ষ মানুষের চিকিৎসা ও ওষুধের সংকট উপেক্ষা করে একতরফা অবরোধে অবিচল থাকে। যখন আফগানিস্তান পুনর্গঠনে তহবিলের অভাব দেখা দেয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ৭০০ কোটি ডলার সম্পদ ফ্রিজ করে এবং তার মধ্যে একটি অংশ বের করে নাইন-ইলেভেন ঘটনার ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার পরিকল্পনা করে। বিশ্বের সবচেয়ে ধনী একটি দেশ দরিদ্র দেশের অর্থ কেড়ে নেয়। দেখতে দেখতে ধ্বংসস্তূপের নিচে মরিয়া মধ্যপ্রাচ্যের মানুষ মূল্যবান প্রাণ রক্ষার সময় হারিয়ে ফেলে। মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের পাশে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে মার্কিন আচরণ প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায়।
বিপর্যয়ের মুখে, আশা করা যায়, মার্কিন রাজনীতিবিদ- যারা মানবাধিকার ও মানবিকতার কথা বলেন, তারা বাস্তব কাজের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য মানুষকে সমর্থন দিতে পারবেন। একতরফা অবরোধ তুলে নিয়ে মানবিক সহায়তার দরজা খুলবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগকে মানবসৃষ্ট দুর্যোগে পরিণত করা ঠিক হবে না।
(শিশির/তৌহিদ/রুবি)