আকাশ ছুঁতে চাই: পর্ব ৪
2023-02-09 15:07:48

১.  ইউয়ান রিশ্য:  শৈশব থেকে পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখছেন যে নারী

২. শ্যন ইউয়ানের শিল্প ভুবন

৩. গ্রামবাসীকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন মহান দম্পতি

 

নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারীর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।

শৈশব থেকে পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখছেন যে নারী

পরিবেশরক্ষায় শৈশব থেকে অবদান রেখে রোল মডেলে পরিণত হয়েছেন এক চীনা তরুণী। চলুন শোনা যাক তার গল্প।

ইউয়ান রিশ্য। ২৯ বছর বয়সী এক তরুণী। নিজের কাজ ও দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে তিনি তার আশপাশের মানুষের কাছে হয়ে উঠেছেন রোল মডেল। একদম শিশু বয়েস থেকেই পরিবেশ রক্ষা এবং সবুজ উন্নয়নে কাজ করে চলেছেন ইউয়ান রিশ্য।

 

                                           

ছবি: শিশু বয়সেই পরিবেশ রক্ষায় অবদান রেখে প্রশংসা পান ইউয়ান রিশ্য

২০২১ সালে তিনি চীনের পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখা রোল মডেল ১০০ সেব্চ্ছাসেবীর অন্যতম হিসেবে নির্বচিত হওয়ার গৌরব পান। ২২ বছর ধরে পরিবেশ সুরক্ষায় অবদান রাখছেন ইউয়ান।

কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষার্থী থাকার সময় তিনি প্রথমে পরিবেশ রক্ষায় কাজ শুরু করেন। তিনি জানতে পারেন যে পুরনো ব্যাটারি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর।  তার খেলনায় ব্যবহৃত পুরনো ব্যাটারিগুলো তিনি ডাস্টবিনে ফেলে না দিয়ে এক জায়গায় জমা করেন। এগুলো তিনি একটি প্রতিষ্ঠানে পাঠান যারা পুরনো ব্যাটারি রিসাইকেল করে। এই কাজের জন্য তিনি ওই স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানটির একজন শিশু লেফটেন্যান্ট প্লাটুন লিডার হন। তার এই প্রশংসাপত্র লাভে স্কুলের অন্য শিশুরাও অনুপ্রাণিত হয়।

ইউয়ান বলেন, ‘প্রশংসাপত্রটি স্কুলের অনুষ্ঠানে পড়ে শোনানো হয়। এতে অন্য শিশুরাও ভীষণ উৎসাহিত হয়ে ওঠে।’

পরিবেশ রক্ষার জন্য তিনি পেপার রিসাইক্লিং করার উদ্যোগ নেন মাত্র ছয় বছর বয়সে। তিনি বন্ধুদের নিয়ে একটি দল গঠন করে। তারা ক্লাসরুমে ‘গ্রিন ব্যাংক’ নামে একটি বাক্স রাখেন। সেখানে বাতিল কাগজ জমা করতে থাকেন।

এই পুরনো বাতিলকাগজগুলো বিক্রি করে সেই অর্থ দিয়ে গাছের চারা কিনে তারা গাছ লাগানোর কাজ করেন। শিশুদের এই উদ্যোগ প্রচারিত হয় মিডিয়ায়। ফলে অন্যান্য স্কুলের শিশুরা উৎসাহিত হয়ে ‘গ্রিন ব্যাংক’ স্থাপন করা শুরু করে।

একবছরের মাথায় ৯০ হাজার শিক্ষার্থী ৬ লাখ ৫০ হাজার টুকরো কাগজ রিসাইক্লিংয়ের জন্য সংগ্রহ করে।

২০১৪ সালে ইউয়ান বেইজিংয়ের রোল মডেল হিসেবে মনোনয়ন পান। বেইজিং পাবলিসিটি ডিপার্টমেন্ট তার বিষয়ে বলে যে, ইউয়ান এবং তার বন্ধুদের উদ্যোগের ফলে ১৩০টি গাছ কাটা পড়ার হাত থেকে বেঁচে গেছে। এই গাছগুলোকে কাগজ বানানোর জন্য কেটে ফেলার পরিকল্পনা ছিল।

২০০১ সালে ইউয়ান ফোর্ড কনজারভেশন অ্যান্ড এনভারনমেনটাল গ্র্যান্ট পান। ইউয়ানের সঙ্গে অনেক পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে পরিচয় হয়।

পরিবেশরক্ষার একজন নিবেদিত কর্মী ওয়েই কুই ইংয়ের সহযোগিতায় ইউয়ান একটি স্থানকে বনভূমিতে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

২০০৫ সালে চায়নিজ ইয়ং পায়োনিয়ারস কংগ্রেসে একজন প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিয়ে সারাদেশে অনেক বন্ধু পান ইউয়ান।

সকলের সহযোগিতায় একটি স্থানকে বনভূমিতে পরিণত করার কাজে এগিয়ে চলেন ইউয়ান। ২০১১ সালে ইউয়ান বেইজিংয়ে ক্যাপিটাল নরমাল ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। গ্র্যাজুয়েশনের পর রাজধানিীর তুংছাং  জেলার তংশিখোও প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক হন।

বর্তমানে ইউয়ান তার ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পরিবেশ রক্ষায় কাজ করে চলেছেন। ইউয়ান বলেন, ‘শিশুরা একটু একটু করে শিখছে এবং পরিবেশ সুরক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে।’

এভাবে পরিবেশ রক্ষায় অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন ইউয়ান রিশ্য।

 

শ্যন ইউয়ানের শিল্প ভুবন

নারীর চোখে নারীর জীবন মূর্ত হয়েছে নারী শিল্পী শ্যন ইউয়ানের শিল্পকর্মে। এই শিল্পীকে নিয়ে আমার তৈরি একটি প্রতিবেদন রয়েছে এখন।

ছবি: শিল্পী শ্যন ইউয়ান

বেইজিংয়ের রেড ব্রিক আর্ট মিউজিয়ামে চলছে নারী শিল্পী শ্যন ইউয়ানের শিল্প প্রদর্শনী। এখানে নারীর চোখে প্রতিফলিত হয়েছে নারীর জীবন সংগ্রাম তার আত্মিক ও মানসিক শক্তি এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার গল্প।

শ্যন ইউয়ান একজন নারী এবং শিল্পী হিসেবে অনেক চড়াই উৎরাই পার হয়েছেন। করোনা মহামারীর সময় তিনি তার প্রিয়জনকে হারান। করোনার সময় শুধু তার জীবন নয়, পালটে যায় গোট বিশ্বের জীবন। সে সময় পালটে যায় সম্পর্কের অনেক বাঁক। সৃষ্টি হয় নতুন মাত্রা।

এই প্রদর্শনীর কিউরেটর হোও হানরুর মতে, শ্যনের শিল্পকর্মগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছে কল্পনার নতুন দিগন্ত। গৃহ নারীর কাছে সবসময়েই পুরুষের চেয়ে অন্যরকম একটি বার্তা নিয়ে আসে। শ্যন তার শিল্পকর্মে গৃহকে রূপায়িত করেছেন নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে।

এই প্রদর্শনীতে শ্যনের ছয়টি বিশালকার শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে। এরমধ্যে পাঁচটি সৃষ্টি হয়েছে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে। কয়েকটিতে করোনা মহামারীর মধ্যে নারীর সংগ্রামী জীবনকে তুলে ধরা হয়েছে।

শ্যন ইউয়ানের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী চলবে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।

গ্রামবাসীকে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন মহান দম্পতি

চীনের এক চিকিৎসক দম্পতি মানবসেবার মহান ব্রত গ্রহণ করেছেন। তারা তাদের পরিবার হিসেবে গ্রহণ করেছেন পুরো একটি গ্রামকে। বসন্ত উৎসবের ছুটিতেও থেমে থাকেনি তাদের মানবসেবার মহান ব্রত।

এই দম্পতিকে নিয়ে আমার তৈরি একটি প্রতিবেদন রয়েছে এখন।

প্রায় তিনদশক ধরে গ্রামবাসীকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছেন দু’জন পল্লী চিকিৎসক। তারা দম্পতি। বিয়ের পর থেকে তারা একসঙ্গে একটি টিম হিসেবে কাজ করে চলেছেন। এমনকি বসন্ত উৎসবের ছুটিতেও তাদের সেবা দান থেমে থাকেনি। সাও হ্যহুয়াই এবং খ তুংফং দম্পতি নিজের পরিবারের সদস্যদের মতোই মনে করেন গ্রামবাসীকে।

চীনের চিয়াংসি প্রদেশের নানছাং এর একটি ছোট্ট গ্রাম শাংবান। এখানে স্বামী সাও হ্যহুয়াই এবং স্ত্রী খ্য তুংফাং  দম্পতির সংসার। তবে তারা মনে করেন পুরো গ্রামটিই তাদের বাড়ি। গ্রামবাসীরাও তাদের নিকটজনের মতো মনে করেন।

১৫০ বর্গমিটার স্থানে ছোট একটি ক্লিনিক রয়েছে তাদের। এখানে জ্বর, পেটের অসুখ, সাধারণ রক্তপরীক্ষা, ব্লাড সুগার, ইউরিন পরীক্ষা এবং ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রামস পরীক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। বছরে তারা এই ক্লিনিকের জন্য ৩০হাজার ইউয়ান ভর্তুকি পান।

অনেক সময় এই দম্পতি গ্রামবাসীর চিকিৎসার জন্য কোন ফি নেননা। ঔষধও কম মূল্যে বিক্রি করেন।

এই দম্পতির মেয়ে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক এবং ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

সম্প্রতি এই দম্পতি এবং তাদের ছোট ক্লিনিকটি হয়ে উঠেছে তিন হাজার গ্রামবাসীর জন্য ভরসার কেন্দ্র। অনেকেই জ্বরে আক্রান্ত হয়ে এখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন। প্রতিদিন ৮০ থেকে ১০০ রোগী দেখতে হয়েছে স্বামী স্ত্রীকে।

জ্বর, ঠান্ডা ও ডায়রিয়ার চিকিৎসায় নিজস্ব কিছু  মেডিসিনও রয়েছে তাদের।

শহরে উন্নত জীবন ও ক্যারিয়ার গড়ার অনেক সুযোগ পেয়েছিলেন তারা। কিন্তু গ্রামবাসীর জন্য চিকিৎসা সেবা প্রদানকেই নিজেদের জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছেন এই দুই মহান চিকিৎসক।

সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।

অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা সবসময় কথা বলি নারীর সাফল্য, সংকট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে।

আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাই চিয়েন।

সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া

অডিও সম্পাদনা: রফিক বিপুল