চীনের কালোত্তীর্ণ ব্র্যান্ড নিয়ে যতকথা
2023-02-08 10:06:05

চীনের কালোত্তীর্ণ ব্র্যান্ড মানে- চীনে যে ব্র্যান্ডগুলোর সুদীর্ঘ সময়ে ইতিহাস এবং নিজস্ব সংস্কৃতি আছে। পাশাপাশি তার পণ্য তৈরির বিশেষ কৌশল রয়েছে এবং তা ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। এখন চীনে রয়েছে ১১২৮টি জাতীয় পর্যায়ের এবং ৩২৭৭টি স্থায়ীয় পর্যায়ের এমন পুরাতন ব্র্যান্ড। তা মূলত খাবার, রেস্টুরেন্ট হোটেল বা পরিষেবা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে ৭০১টি জাতীয় কালোত্তীর্ণ ব্র্যান্ড; এর ইতিহাস ১০০ বছরের বেশি এবং তার মধ্যে ৬০ শতাংশ ছিং বা মিং রাজবংশ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। প্রতি বছর এমন ব্র্যান্ডের আয় ২ ট্রিলিয়ন ইউয়ানের বেশি। মহামারি চলাকালেও ৭০ শতাংশ কালোত্তীর্ণ ব্র্যান্ড মুনাফা অর্জন করেছিল। ২০২২ সালে ৩৫ শতাংশ এমন ব্যান্ডের বিক্রির পরিমাণ ১০ কোটি ইউয়ানের বেশি হয় এবং ৭০ শতাংশ বিক্রি পরিমাণ ১ কোটি ইউয়ানের বেশি। 

 

সকাল ৮টা; বেইজিং ‘তাও সিয়াং ছুন’ নামে মিষ্টির দোকানে ৭/৮ মিটার লম্বার লাইন দেখা যায়। দোকানে ‘খরগোশ বর্ষ’ উপলক্ষ্যে খরগোশ আকারের মিষ্টি বিক্রি হচ্ছে। সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তাও সিয়াং ছুনের উপ-মহাব্যবস্থাপক ইয়ু তা চি জানান, তারাও ভাবতে পারেন নি যে- সবাই এ মিষ্টি এত পছন্দ করবে। চলতি বছরের শুরুতে তাদের বিক্রির পরিমাণ ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি হয় এবং ২০১৯ সালের সমান। অন্যদিকে, বেইজিংয়ে বিখ্যাত আচার জাতীয় খাবারের দোকান লিউ বি চুয়ের অবস্থাও প্রায় একই। আচার রসুন, ভিনেগার, হলুদ সস যে মশলা বা সাইড ডিশ আছে- সেখানে বিক্রি করা হয়। এটা বেইজিংবাসীর খুব পরিচিত এবং অনেকে বেইজিংয়ে বাইরে এগুলো কিনতে আসেন। ২০২৩ সালে তাদের সব দোকানে বিক্রির পরিমাণ ২০২২ সালের একই সময়ের তুলনায় ৩৮ শতাংশ বেশি হয়েছে।

 

কয়েক দশক আগে, যখন মানুষ ছবি তুলতো, তখন বিশেষ দোকানে যেতে হতো। এখন সবার মোবাইল ফোন বা ক্যামেরা আছে। তবে, দোকানে ছবি তোলা একটি উত্সব বা বিশেষ দিনের ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। তা পেই বেইজিংয়ের পুরাতন একটি ছবি তোলার দোকান। চলতি বছর প্রতিদিন দোকানে গড়ে ২৬৪৩জন এসেছে। এখানে বিক্রির পরিমাণ ২০২২ সালের তুলনায় ৪৫ শতাংশ বেশি হয়েছে। সবচেয়ে ব্যস্ত সময়ে তিন ঘণ্টার মতো অপেক্ষা করতে হয়!

 

শুধু বেইজিং নয়, চীনের প্রত্যেক জায়গায় নিজ নিজের পুরাতন বিখ্যাত ব্র্যান্ড আছে। চলতি বসন্ত উত্সবের সময়ে অনলাইনে চীনের কালোত্তীর্ণ ব্র্যান্ড সম্পর্কিত শব্দের অনুসন্ধান পরিমাণ ১২০ শতাংশ বেশি হয়েছে। অনলাইন কেনাকাটা উত্সবের সময়ে অনলাইনে এ ব্যান্ডের পণ্য বিক্রির পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়েছে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা সম্প্রসারণ পরিকল্পনা ২০২২-২০২৫ এ বলা হয়, চীনের ব্র্যান্ড তৈরি করা যাবে এবং চীনের কালোত্তীর্ণ ব্র্যান্ড লালন ও উন্নত করা যাবে।

 

২০২৩ চীনের কালোত্তীর্ণ ব্র্যান্ড কার্নিভাল অনুষ্ঠানে চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী ওয়াং ওয়েন থাও তার ভাষণে বলেন, এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আরও উচ্চ মানের পণ্য ও নতুন ভোগের পরিবেশ সরবরাহ করা হবে এবং ভোক্তাদের ঐতিহ্যিক ব্র্যান্ডের পণ্য কিনতে ভাল লাগবে।

 

বেইজিংয়ে এমন একটি কথা প্রচলিত আছে। মাথায় যা পরা হয় তা মা চু ইয়ানে কিনবে, পায়ে যা পরা হয় তা নেই লিয়ান শেংয়ে কিনবে, শরীরে যা পরা হয় তা রু ফু সিয়াংয়ে কিনবে এবং পেটে যা লাগানো আছে তা সি তা হেং থেকে আসে। আসলে এখানে ৪টি পুরাতন ব্র্যান্ডের কথা উল্লেখ করা হয় এবং তা টুপি কাপড় এবং জুতো সম্পর্কিত। শেষটা সি তা হেং চারটি  ব্যক্তিগত ব্যাংকের নাম। আগে মানুষ টাকা পেটের ওপর লাগিয়ে রাখতো।

 

 এর মধ্যে জুতোর দোকান নেই লিয়ান শেং প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৩ সালে। কোম্পানির ব্যবস্থাপক চেং স্যু জানিয়েছেন, অনেক মানুষ বিশেষ করে যুবকরা মনে করে- দোকানে শুধু ঐতিহ্যিক জুতো বিক্রি হয়। আমরা তাদের এমন ধারণা ভেঙ্গে দিতে চাই। যুব নকশাকার নিয়োগের পর ২০ বা তার চেয়ে কম বয়সী ভোক্তার জন্য সেকেন্ডারি লাইনের ব্র্যান্ড তৈরি করা হয়, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে সহযোগিতা করে কো-ব্র্যান্ডেড জুতো তৈরি করেসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে কোম্পানিটি। অবশ্যই নবায়ন মানে ঐতিহ্য ত্যাগ করা নয়। ২০০৮ সালে নেই লিয়ান শেংয়ের কাপড়ের জুতো তৈরির কৌশলকে জাতীয় অবৈষয়িক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। যা তৈরিতে ৪০ ধরনের যন্ত্র এবং ৯০টি পদক্ষেপ নিতে হয়। অভিজ্ঞ একজন কর্মীর জুতোর সোল তৈরি করতে তিনদিন সময় লাগে। মেশিন দিয়ে হাতের মতো কাজ করা যায় না।

 

অনেক বিদেশি চীনা ভাষা বলতে না পারলেও তারা ‘পিয়ান চাই হুয়াং’ এ তিন শব্দ বলতে পারে—বলেছেন পেয়ান চাই হুয়াং কোম্পানির সিইও।

চীনের ফু চিয়ান প্রদেশের চাং চৌ শহরের আঞ্চলিক ভাষায় সব বিষাক্ততার কারণে ফোলা ও ব্যথাকে বলা হয় হুয়াং। পিয়ান মানে বড়ি। তাই পিয়ান চাই হুয়াং মানে- এক বড়ি এই ওষুধ খেলে সব ফোলা ও ব্যথা দূর হবে। পিয়ান চাই হুয়াং-এ ওষুধের ইতিহাস ৫০০ বছরের প্রাচীন। শুধু চীনে নয় তা বিদেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। চলতি বছরের প্রথম মাসের প্রথম দশ দিনে এ ওষুধ বিক্রির পরিমাণ ২০২২ সালের সারা বছরের পরিমাণের ১০ ভাগের এক ভাগ হয়। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরেও বিক্রি হচ্ছে এ ওষুধ।

 

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিজস্ব পুরাতন ব্র্যান্ডের সংরক্ষণ কাজে সমর্থন করে সরকারগুলো। যেমন, জাপানে ২০২২ সালে ১৩০০টি কোম্পানি তাদের ১০০ বছরের জন্মদিন পালন করেছে। ২০২২ ফরচুন ম্যাগাজিনের টপ ৫০০-এর জার্মান কোম্পানির মধ্যে অর্ধেকের ইতিহাস ১০০ বছরের বেশি। বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক সত্তা, দ্বিতীয় বৃহত্তম ভোগ্য বাজার ও বৃহত্তম পণ্য বাণিজ্যের দেশ হিসেবে চীন নিজের পুরাতন ব্র্যান্ড তৈরি ও স্বীকৃতি দিতে পারে। সম্প্রতি চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সাধারণ বাজার তত্ত্বাবধান ব্যুরো, জাতীয় সাংস্কৃতিক পুরাকীর্তি নিদর্শন ব্যুরো, জাতীয় মেধাস্বত্ত্ব ব্যুরো একযোগে ‘চীনের কালোত্তীর্ণ ব্র্যান্ডের’ দৃষ্টান্ত স্থাপন ও ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয় ইতিহাস, ব্যবস্থাপনা ও নবায়ন- এই তিন দিক থেকে চীনের পুরাতন ব্র্যান্ডের মধ্যে শ্রেষ্ঠটি বাছাই করা যাবে।

 

শাংহাইয়ের ফিনিক্স পুরাতন একটি সাইকেলের ব্র্যান্ড। এখন কোম্পানিটি লিথিয়াম ব্যাটারি-চালিত সাইকেল আমেরিকা, জাপান ও ইউরোপের দেশগুলোতে বিক্রি করা হচ্ছে। দামও ঐতিহ্যিক সাইকেলের তুলনায় দশ-বারো গুণ বেশি। কোম্পানির ব্র্যান্ড পরিচালক সু লি জানান, ২০১৯ সালে কোম্পানি আবিষ্কার করে যে, লিথিয়াম ব্যাটারির সাইকেল জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। তাই তারা গবেষণা, উত্পাদন ও বিক্রির জন্য বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। পাশাপাশি, লিথিয়াম ব্যাটারির গবেষণা ও পরীক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে মেধাস্বত্ব অর্জন করেছে।

 

যে কোনো ব্র্যান্ডের জন্য পণ্যের গুণগত মান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। তাই পুরাতন ব্র্যান্ডগুলোকে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ হিসেবে সংরক্ষণ ও লালন করতে হবে। অন্যদিকে, পণ্যের মান উন্নয়ন এবং নবায়ন জোরদারে উত্সাহ ও সমর্থন দিতে হবে।

(শিশির/তৌহিদ/রুবি)