চীন যে-ভাবে জাতিসংঘের শক্তিশালী ভিত্তি-দেশ হয়ে উঠছে
2023-02-05 18:45:21

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশের সভাপতি চাবা করোসি গত ১ থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি চীন সফর করেন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিন কাংয়ের আমন্ত্রণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ এ সফরে আসেন। সফরকালে তিনি চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াংসহ চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সব অনুষ্ঠানে করোসি চীনকে জাতিসংঘের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার তথা ভিত্তি-দেশ হিসেবে অভিহিত করেন।

শুধু এবারেই নয়, গত সেপ্টেম্বরে চীনের ৭৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে জাতিসংঘের এ কর্মকর্তা অনুরূপ বক্তব্য দিয়েছিলেন।

জাতিসংঘের এ শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তার এমন বক্তব্য তো কথার কথা নয়। চীনকে জাতিসংঘের ভিত্তি-দেশ বলে করোসির মন্তব্যের যথার্থ কারণ রয়েছে।

চীন, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং জাতিসংঘের চার্টারে স্বাক্ষরকারী প্রথম দেশ। চীন দৃঢ়ভাবে জাতিসংঘ-কেন্দ্রিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা পরিচালিত আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকে সমর্থন করে আসছে এবং আরও শান্তিপূর্ণ ও উন্নততর বিশ্ব নির্মাণে সহায়তা করছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘ স্থায়ী শান্তির জন্য সকলের প্রত্যাশা বহন করে। প্রাচীনকাল থেকেই চীন বিশ্বাস করে যে শান্তি সবচেয়ে মূল্যবান।

জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার পর থেকে, চীন কোরীয় উপদ্বীপের পারমাণবিক সমস্যা, ইরানের পারমাণবিক সমস্যা, আফগানিস্তান, মিয়ানমার এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুসহ প্রধান আঞ্চলিক হটস্পট সমস্যাগুলোর রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে আসছে।

আজকের বিশ্বে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্ব এবং নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং এশিয়ার বার্ষিক সম্মেলন ২০২২’র বোয়াও ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গ্লোবাল সিকিউরিটি ইনিশিয়েটিভ-জিএসআই প্রস্তাব করেন।

জিএসআই জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে ব্যাপক স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি মানবজাতির শান্তি-সংকট সমাধানের জন্য চীনা প্রজ্ঞার প্রস্তাব দেয় এবং বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চীনা সমাধানের পথ দেখায়।

জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি-মুনও মনে করেন,বিশ্ব শান্তির নির্মাতা, বিশ্ব উন্নয়নে অবদানকারী, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং জনসাধারণের পণ্য সরবরাহকারী হওয়ার চীনের ধারণা জাতিসংঘের সনদের আদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

 

২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৬তম অধিবেশনে সাধারণ বিতর্কে প্রথমবারের মতো গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ-জিডিআই ধারণাটি তুলে ধরেন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং।

এ উদ্যোগের লক্ষ্য হল অগ্রাধিকার হিসাবে উন্নয়নের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা, একটি জন-কেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, সকলের জন্য সুবিধা, উদ্ভাবন-চালিত উন্নয়ন, মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান।  

জিডিআই প্রাথমিক ফলাফল এরইমধ্যে পাওয়া গেছে। এ পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি দেশ এবং জাতিসংঘসহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা জিডিআই-কে সমর্থন করেছে এবং প্রায় ৭০টি দেশ জিডিআই-এর বন্ধুদের গ্রুপে যোগ দিয়েছে।

এদিকে, প্রেসিডেন্ট সি চিনপিংয়ের আরেকটি বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-বিআরআই ১০ বছর আগে প্রস্তাবিত হওয়ার পর থেকে জনকল্যাণ ও সহযোগিতার প্রচারের জন্য একটি জনপ্রিয় আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। এটি বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ দেশ এবং এক তৃতীয়াংশ আন্তর্জাতিক সংস্থাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের নির্বাহী পরিচালক নাটালিয়া কানেম বলেন, বিশ্বের জনসংখ্যা ৮ বিলিয়ন ছাড়িয়ে যাওয়ায় চীনের উন্নয়ন ও অবদান অনেক দেশকে উপকৃত করবে।

২০১৭ সালে জেনেভায় জাতিসংঘ কার্যালয়ে মূল বক্তব্যে প্রেসিডেন্ট সি চিনপিং জানান, চীন তার ১.৩ বিলিয়নের বেশি মানুষের মৌলিক জীবনযাত্রার চাহিদা পূরণ করেছে এবং ৭০০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে বের করে এনেছে, যা মানবাধিকারের বৈশ্বিক কারণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

এশিয়ায় লাওস, কম্বোডিয়া এবং মিয়ানমারের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য বিমোচনে সহযোগিতা করেছে চীন। আফ্রিকান দেশগুলিকে জল সংরক্ষণের অবকাঠামো তৈরিতে সাহায্য করা, কৃষি সহযোগিতার জন্য প্রদর্শনী অঞ্চল স্থাপন করাসহ নানাভাবে সহায়তা দিয়েছে চীন।

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে, চীন অবকাঠামো নির্মাণ, কৃষি এবং চিকিৎসা পরিচর্যায় প্রযুক্তিগত সহযোগিতা সহায়তা প্রকল্প পরিচালনা করেছে।

লাতিন আমেরিকায়, চীন প্রাপক দেশগুলোর স্থানীয় জনগণকে দারিদ্র্য দূর করতে সহায়তা করার জন্য কৃষি প্রযুক্তি প্রদর্শন কেন্দ্র তৈরি করেছে।

চীনের দারিদ্র্য নিরসনের অভিযানের বিষয়ে মন্তব্য করে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, এই অর্জনগুলোই, দারিদ্র্যের কষাঘাত কমানোর জন্য সবচেয়ে বড় অবদান।

এ ছাড়াও বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলা এবং গত তিন বছর ধরে কোভিড মহামারি মোকাবেলায় চীন একক দেশ হিসেবে এবং জাতিসংঘের সহযোগী সদস্য দেশ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে- যার প্রায় সবকটিই জাতিসংঘ সমর্থিত।

আর এ সবকিছুই চীনকে জাতিসংঘের একটি ভিত্তি-দেশ হয়ে উঠতে সহায়তা করেছে।

মাহমুদ হাশিম

ঢাকা স্টেশন, চীন আন্তর্জাতিক বেতার।