দেহঘড়ি পর্ব-০০৪
2023-02-05 19:07:14

‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং চীনা জীবনধারা নিয়ে পরামর্শ ‘হেলথ টিপস’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

বাত প্রতিরোধ ও ব্যথা উপশমে টিসএম

আর্থ্রাইটিস বা বাত হলে হাড়ের জয়েন্ট বা অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ হয়। এর প্রধান লক্ষণগুলো হলো অস্থিসন্ধিতে ব্যথা, শক্ত হওয়া ও ফুলে যাওয়া। এছাড়া বাত হলে অস্থিসন্ধিতে জড়তা তৈরি হয় এবং এর চারপাশের ত্বকের লালভাব দেখা দেয়। এক শ’রও বেশি ধরনের বাত আছে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ ধরনগুলো হলো অস্টিওআর্থারাইটিস, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং গাউট গেঁটে বাত।

অস্টিওআর্থারাইটিস: অস্টিওআর্থারাইটিস হলো সবচেয়ে সাধারণ ধরনের বাত। অস্থিসন্ধির কার্টিলেজ বা তরুণাস্থিতে ক্ষয়ের কারণে এ বাত হয়। এই ক্ষয় প্রক্রিয়া সাধারণত বয়সের সাথে সাথে ঘটে। তবে অস্থিসন্ধির ওপর চাপ বাড়ায় এমন কারণ যেমন এর অতিরিক্ত ব্যবহার, আঘাত বা স্থূলতা এ রোগকে ত্বরান্বিত করতে পারে ।

রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস: রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস একটি অটোইমিউন বা স্বতঃঅনাক্রম্য রোগ। এ রোগ হলে রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাই অস্থিসন্ধিতে আক্রমণ করে।

গেঁটে বাত: গেঁটে বাত হলো এক ধরনের বিপাকীয় বাত। অস্থিসন্ধিতে ইউরিক অ্যাসিডের স্ফটিক জমা হওয়ার কারণে এ বাত হয়। এটি সাধারণত পায়ের বুড়ো আঙুলের অস্থিসন্ধিতে হয়। এ রোগে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়, অস্থিসিন্ধ শক্ত হয়ে যায় এবং ফুলে ওঠে।

ঐতিহ্যবাহী চীনা চিকিৎসাব্যবস্থা বা টিসিএমে মনে করা হয় বাত ‘পাই সিনড্রোম’ নামের একটি ব্যাধির অন্তর্গত। পাই সিনড্রোমের জন্য দায়ী বায়ু, ঠাণ্ডা, ক্লেদ ও তাপ। লিভার ও কিডনিতে ‘ছি’ বা অন্তর্নিহিত শক্তির ঘাটতির কারণেও এ রোগ হতে পারে।

একজন রোগী কোন ধরনের বাতে আক্রান্ত সঠিকভাবে সেটি নির্ণয়ের জন্য লাইসেন্সপ্রাপ্ত টিসিএম চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া প্রয়োজন। বিভিন্ন টিসিএম পদ্ধতি যেমন আকুপাংচার, কাপিং বা সিঙ্গা লাগানে, থুইনা ও মুখে খাওয়া ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করে বাতের চিকিৎসা করা যেতে পারে। এই চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর লক্ষ্য হলো রোগসৃষ্টিকারী উপাদানগুলো দূর করা এবং শরীরে কিংবা আক্রান্ত এলাকায় শক্তি ও রক্তের স্বাভাবিক সঞ্চালন বাড়ানআ। আকুপাংচার ও ভেষজ ওষুধ লিভার ও কিডনির কার্যকারিতা বাড়াতে পারে, যার কারণে এসব অঙ্গে শক্তির ঘাটতি দূর হয়।

বাতের চিকিৎসায় প্রায়ই আকুপাংচার ব্যবহৃত হয়। ২০০৪ সালে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, আকুপাংচার অস্থিসন্ধির কার্যকারিতা বাড়াতে এবং ব্যথা উপশমে সক্ষম। রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসে আকুপাংচারের কার্যকারিতার ওপর ২০১৮ সালে পরিচালিত আরেক গবেষণায় দেখা যায়, শুধু আকুপাংচার কিংবা অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতির সঙ্গে আকুপাংচার কোনও বিরূপ প্রভাব ছাড়াই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ব্যাথা উপশম করতে পারে।

বাতের টিসিএম চিকিৎসায় কোন ভেষজ ব্যবহারের পরামর্শ দেওয়া হবে, সেটা নির্ভর করে বাতের ধরনের ওপর। তবে এ রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত কয়েকটি সাধারণ ভেষজের মধ্যে রয়েছে হলুদ, লাইকোপোডিয়াম জাপোনিকাম, ওক্স নি বা নিউ সি, ইউকোমিয়ার ছাল ও পিওনিয়া ট্যাক্টি লোরা পল।

বাত প্রতিরোধ ও এর ব্যথা উপশমে আরও কিছু পরামর্শ:

•    ঠান্ডা খাবার ও পানীয় এড়িয়ে চলুন। এগুলো শরীরের মূল শক্তি বা ছি ও রক্ত সঞ্চালনকে প্রভাবিত করে এবং শরীরে ক্লেদ জমায়, যার ফলে বাত বাড়ে।

•    ‘ছি’ ও রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে অস্থিসন্ধিগুলোকে উষ্ণ রাখুন। তবে তাপজনিত বাতের ক্ষেত্রে এটা এড়িয়ে চলুন।

•    অস্থিসন্ধির চারপাশের পেশীগুলোকে শক্তিশালী করার জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম করুন। সাঁতারের মতো ব্যায়াম অস্থিসন্ধির জন্য কম চাপযুক্ত হতে পারে।

•    বিশেষভাবে তৈরি স্যুপ খান। এ স্যুপ বানাতে প্রয়োজন ২০ গ্রাম ইউকোমিয়ার ছাল, ১৫ গ্রাম আচিরানথিস শিকড়, ৫টি আদার টুকরো, ৩টি শুকনো বরই, ৯ গ্রাম উল্‌ফবেরি বা কুওছি, ৩শ গ্রাম মুরগির মাংস ও ২ লিটারের মতো পানি।

1.   ভেষজগুলো পরিস্কার পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে নিন।

2.   তারপর উষ্ণ পানি দিয়ে মাংসগুলো ধুয়ে নিন।

3.   একটি পাত্রে পানি নিয়ে তার মধ্যে ভেষজ ও মাংস ঢেলে দিন।

4.   পানি ফুটন্ত অবস্থায় পৌঁছানো পর্যন্ত বেশি আঁচে জ্বাল দিতে থাকুন। তারপর জ্বাল কমিয়ে আরও ঘন্টা দুয়েক সিদ্ধ করতে থাকুন।

5.   রান্না শেষ হওয়ার ২০ মিনিট আগে রান্নার পাত্রে উল্ফবেরি ঢেলে দিন।

6.   এরপর স্বাদমতো লবণ যোগ করুন।

হয়ে গেল বাতের ব্যথা উপশমকারী স্যুপ।

নিয়মিত এই স্যুপ খেলে রোগ সৃষ্টি করতে পারে এমন বায়ু ও ক্লেদ দূর হয় এবং হাড় ও রগ শক্তিশালী হয়। যারা দীর্ঘস্থায়ী বাতের ব্যথায় ভুগছেন, বিশেষ করে পিঠের নীচে ও হাঁটুর ব্যথায়, তাদের জন্য এই স্যুপটি বেশি উপকারী।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

উহান ইউনিয়ন হাসপাতাল

উহান ইউনিয়ন হাসপাতাল একটি সমন্বিত গণহাসপাতাল। ১৮৬৬ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ১৫৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালটি ২০০০ সাল থেকে হুয়াচুং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন থুংচি মেডিকেল কলেজে অধিভুক্ত এবং এটি পরিচালিত হয় চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশনের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায়। ফুতান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট প্রকাশিত ‘চীনের হাসপাতাল র‌্যাংকিং’ অনুযায়ী, বিভাগগুলোর সমন্বিত সামর্থের বিচারে উহান ইউনিয়ন হাসপাতাল চীনের শীর্ষ ১০টি সেবা স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের একটি।

চীনের হুপেই প্রদেশের রাজধানী উহানের চিয়াংহানে অবস্থিত ৬ হাজার শয্যা-বিশিষ্ট এই হাসপাতাল চারটি ক্যাম্পাস নিয়ে গঠিত। এগুলো হলো এর প্রধান ক্যাম্পাস, ক্যান্সার সেন্টার, পশ্চিম ক্যাম্পাস ও চিন ইয়িনহু ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসগুলোতে ৪৯টি ক্লিনিকাল ও চিকিৎসা প্রযুক্তি বিভাগ রয়েছে। এগুলোর মধ্যে হেমাটোলজি, কার্ডিওলজি, জেনারেল সার্জারি, ইউরোলজি ও অ্যানেস্থেসিওলজিসহ ১০টি শাখা জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে বিবেচিত হয়।

কার্ডিওভাসকুলার সার্জারি, প্লাস্টিক সার্জারি, অর্থোপেডিকস, গাইনোকোলজি ও প্রসূতিবিদ্যা, গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, এন্ডোক্রাইনোলজি ও থোরাসিক সার্জারিসহ ২৫টি বিভাগকে জাতীয়ভাবে মূল ক্লিনিকাল বিভাগ বলে বিবেচনা করা হয়।

চীনের খ্যাতিমান চিকিৎসকদের একটি কেন্দ্র হয়ে উঠেছে উহান ইউনিয়ন হাসপাতাল। এখানে কর্মরত সব মিলিয়ে ৭ হাজার ৭১৮ জন, যাদের মধ্যে ৬ হাজার ৮৫৯ জন চিকিৎসা পেশাজীবী, ৭২৩ জন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসা পেশাজীবী এবং ৮৬ জন কর্মচারী। এখানকার পেশাজীবীদের মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন প্রদেশ-স্তরের প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচীর ৭৩জন বিজয়ী, ২ জন প্রদেশ-স্তরের বিখ্যাত শিক্ষক এবং আরও অনেক পুরস্কার ও খেতাব জয়ী চিকিৎসক।

এই হাসপাতালে রয়েছে সর্বাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি। প্রতি বছর এখান থেকে সেবা গ্রহণ করে প্রায় ৬৭ লাখ রোগী। এদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ রোগী ভর্তি হয়ে সেবা নেয় এবং প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার রোগীর এখানে অস্ত্রপচার হয়।

 

হেলথ টিপস

এটা সর্বজনবিদিত যে, চীনা জীবনযাপন পদ্ধতি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। আপনি যদি চীনাদের মতো একটি সুস্থ জীবন যাপন করতে চান তাহলে মেনে চলতে পারেন তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি-সম্পর্কিত পরামর্শ।

ঋতু-উপযোগী খাবার খান

ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ এই পৃথিবীর জন্যও। আমাদের দেহ যে সব উৎস থেকে অত্যাবশ্যকীয় শক্তি ও পুষ্টি গ্রহণ তার মধ্যে অন্যতম হলো এই পৃথিবী, বিশেষ করে এখানে উৎপন্ন যেসব খাবার আমরা খাই সেগুলো। এ কারণে সুস্বাস্থ্যের জন্য সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অপরিহার্য।

আমাদের শরীরে অত্যাবশ্যকীয় শক্তি যাতে বাড়ে, সেজন্য চীনা জীবনযাপন পদ্ধতিতে ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ খাবার খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ যেখানে, যে মৌসুমে, যে খাবার পাওয়া যায় সেটা খাওয়া উচিৎ। তাই আপনি বিশ্বের কোথায় আছেন এবং কোন ঋতুতে আছেন, তার উপর নির্ভর করে খাবার তালিকাগুলো পরিবর্তন করে নিতে হবে।

প্রকৃতিতে শ্বাস নিন

শ্বাস-প্রশ্বাস শরীরের একটি অনৈচ্ছিক ক্রিয়া। আমাদের শরীর গভীর শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ প্রত্যাশা করে, যদিও সাধারণত আমরা সেটা করিনা। পুনরুদ্ধারমূলক শ্বাস-প্রশ্বাসের একটি দুর্দান্ত উপায় হলো প্রতিদিন ধ্যান অনুশীলন করা, যা আপনার মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যকে ঠিক রাখতে সহায়তা করে।

আপনি যদি শহরে বাস করেন, একটি সবুজ স্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করুন এবং সেখানে গভীর শ্বাস-গ্রহণ অনুশীলন করুন। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রকৃতিতে সময় কাটালে বিভিন্নভাবে তা আমাদের স্বাস্থ্য এবং সুস্থতার উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

 

 ‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।