চীনের সংস্কৃতি, চীনের ঐতিহ্য- ০০৩
2023-02-04 19:16:39

বর্ণাঢ্য লন্ঠন উৎসবে শেষ হলো চীনে বসন্ত উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা

৫ ফেব্রুয়ারি বর্ণাঢ্য লণ্ঠন উৎসবের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে চীনাদের বসন্ত উৎসব এবং খরগোশবর্ষ বরণের দুসপ্তাহব্যাপী আনুষ্ঠানিকতা। চীনা চান্দ্র ক্যালেন্ডারের প্রথম মাসের ১৫তম দিনে উদযাপিত হয় জমকালো এ লণ্ঠন উৎসব।

খরগোশ বর্ষ হওয়ায় এবার লণ্ঠন উৎসবে প্রাধান্য ছিল খরগোশ আকৃতির লণ্ঠনের। বিভিন্ন শহরে নানা বর্ণ আর আকৃতির লণ্ঠন শোভা ছড়ায়।

 

 

কোথাও কোথাও আয়োজন করা হয় লাইট শো ও ঐতিহ্যিক সাংস্কৃতিক উৎসব। নানা স্থানে মেলায় দর্শনার্থীদের উপভোগের জন্য স্থানীয় সুস্বাদু খাবার, লোকসংগীত এবং নৃত্য পরিবেশনেরও ব্যবস্থা করা হয়।

 

খেলাধুলা, চীনা কবিতা আবৃত্তি এবং ক্যালিগ্রাফি, ফানুস ওড়ানো, সিংহনৃত্যসহ বিভিন্ন বিনোদনের আয়োজন ছিল সর্বত্র। চীনের ঐতিহ্যবাহী খাবার ডাম্পলিং বা ইউয়ানসিয়াওসহ নানা খাবার তো ছিলই।

বৈচিত্র্যময় চীনা লোকশিল্প উপকরণে উত্তর চীনের শানসি প্রদেশে লণ্ঠন মেলার আয়োজন করা হয়। খরগোশ, ফুল, মহাকাশযান এবং চীনা রাশিচক্রের চিহ্নের মতো বিভিন্ন থিম-বিশিষ্ট অনেকগুলো লণ্ঠন শানসির কাওফিং শহরের ১২শো মিটারের বেশি রাস্তাকে আলোকিত করে। একই সঙ্গে ছিল ৫০০টি ড্রোন দিয়ে একটি অত্যাশ্চর্য লাইট শো। 

মেলায় দর্শনার্থীরাদের  উপভোগ জন্য স্থানীয় সুস্বাদু খাবার, লোকসংগীত এবং নৃত্য পরিবেশনেরও ব্যবস্থা ছিল। ২৮ জানুয়ারি শুরু হওয়া এই ইভেন্টটি শেষ হয় ১০ ফেব্রুয়ারি। 

এদিকে, লণ্ঠন উৎসবকে উপলক্ষে সাংহাইয়ের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য শৈলীতে সাজানো হয় শহরের বিভিন্ন স্থাপনা।  প্রায় ৮০টি খরগোশ আকৃতির লণ্ঠন ব্যবহার করা হয় সাংহাই কমপ্লেক্স ভবনে।

উৎসবের অংশ হিসেবে সাংহাইয়ে নববর্ষের মেলাও অনুষ্ঠিত হয়।  এতে খেলাধুলা, চীনা কবিতা আবৃত্তি এবং ক্যালিগ্রাফিসহ বিভিন্ন বিনোদনের আয়োজন ছিল।

পূর্ব চীনের ফুচিয়ান প্রদেশের বাসিন্দারা লণ্ঠন উৎসবকে ঘিরে তৈরি করে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী খাবার।  বসন্ত উৎসব উদযাপনের সমাপ্তির সংকেত দেয় লণ্ঠন উৎসব।

ফুচিয়ানে, ঐতিহ্যবাহী উৎসবটি চালের ডাম্পলিং বা ইউয়ানসিয়াও খাওয়ার মাধ্যমে পালন করা হয়, রঙিন ফানুস তৈরি করা হয় এবং অন্যান্য লোকজ রীতি পালন করা হয়, যার মাধ্যমে সৌভাগ্য এবং সমৃদ্ধির বয়ে আসে বলে বিশ্বাস করা হয়।

প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী।

------------------------------------------------

বসন্ত উৎসবে বিশ্বের ২৭ দেশে চীনের বইমেলা

চীনের ঐতিহ্যবাহী বসন্ত উৎসব উপলক্ষে চীনসহ সারা বিশ্ব জুড়ে নানা উদযাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন ছিল। এরই অংশ হিসেবে বিশ্বের বিশ্বের ২৭টি দেশে অনুষ্ঠিত হয় চীনা বইমেলা।

চায়না ন্যাশনাল পাবলিকেশন্স ইমপোর্ট অ্যান্ড এক্সপোর্ট গ্রুপ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ বই মেলার আয়োজন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, থাইল্যান্ড, নেপাল, সিঙ্গাপুর এবং জাপানসহ ২৭টি দেশে চলে এ মেলা।

মেলার বইগুলো বিদেশী পাঠকের রুচির সঙ্গে মানানসই করে বাছাই করা হয়। মেলাগুলোতে চার খণ্ডের সংকলন সি চিনপিং: দ্য গভর্ন্যান্স অফ চায়না, সিপিসি ২০তম জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিবেদন এবং অনেক পুরস্কার বিজয়ী সাহিত্যকর্ম অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

‘রিডিং চায়না’ থিমের সঙ্গে প্রদর্শনীতে ১৫০টিরও বেশি শিরোনাম দেয়া হয়, যার মধ্যে রয়েছে পুরস্কার বিজয়ী চীনা উপন্যাস এবং চীনা শাসন ব্যবস্থা সংক্রান্ত বই।

 

 

বিশ্বের দেশে দেশে চিত্তাকর্ষক এ মেলা দর্শকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করে।মেলায় দর্শনার্থীরা বসন্ত উৎসবের কাপলেট লেখা, লণ্ঠনের ধাঁধা অনুমান করা এবং ঐতিহ্যবাহী চীনা চিত্র আঁকার মাধ্যমে ঐতিহ্যবাহী চীনা সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা লাভ এবং উপভোগ করেন।

--------------------------------

চিরায়ত চীনা সাহিত্য

সহজ দার্শনিকতার কবি ইউয়ান হোংতাও

চীনের ইতিহাসে মিং রাজবংশের শাসনকালে মানে ১৩৬৮ থেকে ১৬৪৪ সালের মধ্যে চীনা শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতির বিশেষ বিকাশ ঘটে।

মিং আমলের একজন বিখ্যাত কবি ই্উয়ান হোংতাও। তারা তিন ভাই ছিলেন। তিনজনই কবি হিসেবে খ্যাতি পান। চিরায়ত চীনা সাহিত্যে তাদের তিন ইউয়ান ভাই বলে অভিহিত করা হয়। এদের মধ্যে অবশ্য ইউয়ান হোংতাও সবচেয়ে খ্যাতিমান।

চীনের হুকুয়াং এলাকার কুংআন শহরের স্থানীয় একটি অভিজাত পরিবারে ১৫৬৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন ইউয়ান হোংতাও। তার মৃত্যু ১৬১০ সালে। এ সময়টা চীনের ইতিহাসে ওয়ানলি পিরিয়ড নামে পরিচিত যা ১৫৭৩ থেকে ১৬২০ পর্যন্ত বিস্তৃত।

কবি ইউয়ান হোংতাও

হোংতাওর পরিবার ছিল সামরিক ঐতিহ্যবাহী। কিন্তু শৈশব থেকে শিল্প-সাহিত্য, কবিতার প্রতি আগ্রহী ছিলেন হোংতাও। পনেরো বছর বয়সে তিনি নিজে একটি সাহিত্য সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ২৪ বছর বয়সে ১৫৯৫ সালে তিনি বিশেষ চাকরির জন্য পরীক্ষা চিনশিতে অবতীর্ণ হন এবং কৃতিত্বের সঙ্গে পাশ করেন। সরকারি চাকরিও পান। তবে একবছর পর এই চাকরি একঘেয়ে লাগায় সেটি ত্যাগ করেন।

এ সময় তিনি ভ্রমণে বেরিয়ে পড়েন এবং মৌলিক দার্শনিক লি চির সঙ্গে তার আলাপ হয়। তিনি অনেক স্থানে ভ্রমণ করেন। একটি ভ্রমণে তার সঙ্গে যোগ দেন তার বড়ভাই। বড়ভাই ছিলেন বুদ্ধ-কনফুসিয়াস দার্শনিক ধারার একজন সাধক। এ ভ্রমণ হোংতাওর উপর বেশ প্রভাব বিস্তার করে। এই সময়ে লেখা কবিতাগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ চিয়েথুও। হোংতাও এবং তার দু’ভাইয়ের লেখা এক স্বতন্ত্রধারার সৃষ্টি করে। এই ধারায় বলা হয় ভালো কবিতা হলো খাঁটি অনুভূতি এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সমন্বয়।

হোংতাওয়ের বড়ভাই চোংতাও ১৬০০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর হোংতাও ছোট একটি দ্বীপে অবসর জীবন কাটান। তিনি ধ্যান এবং কবিতা লেখার মাধ্যমে তার জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো অতিবাহিত করেন। এ সময়ে লেখা কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয় তার কাব্যগ্রন্থ সিয়াওবি থাংচি।

রাজধানী

রাজধানী শহরের দেয়ালগুলো উজ্জ্বল

প্রশস্ত রাজপথে শোনা যায় লাল পোশাকধারী কর্মকর্তাদের চিৎকার

একজন শুভ্রকেশ নিঃস্ব প্রাজ্ঞ যাচ্ছেন

তার খচ্চরের জিন থেকে ঝুলছে কবিতার পুঁথি

তিনি কাজের সন্ধানে দ্বারে দ্বারে করাঘাত করছেন

দ্বাররক্ষীরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে পরিহাস করছে

দশ জায়গাতেই ব্যর্থ হলেন তিনি

রাস্তা দিয়ে তিনি চলছেন বিষন্ন বদনে।

ধনীদের মোসাহেবী করতে সর্বদা ভয় পেয়েছেন তিনি

শুনেছেন, তোমার চাটুকারিতা যথেষ্ট চটপটে নয়।

একচোখ কালো কাপড়ে ঢাকা

প্রায় অন্ধ বৃদ্ধ মানুষটি পথ চলেন।

কবি ইউয়ান হোংতাও গদ্য লেখাতেও বেশ খ্যাতি পেয়েছিলেন। জীবনের নির্মম সত্যকে তুলে ধরতে তিনি কখনও ভয় পাননি। আর এই সহজ দার্শনিকতাই তাকে চিরায়ত চীনা সাহিত্যে অমর করেছে।

প্রতিবেদন ও কবিতা অনুবাদ: শান্তা মারিয়া।

----------------------------------------------------------------------
চীনের সংস্কৃতি চীনের ঐতিহ্য

প্রতিবেদন: রওজায়ে জাবিদা ঐশী, শান্তা মারিয়া

অডিও সম্পাদনা: হোসনে মোবারক সৌরভ, রফিক বিপুল

প্রযোজনা ও উপস্থাপনা: মাহমুদ হাশিম।

সার্বিক তত্ত্বাবধানে: ইউ কুয়াং ইউয়ে আনন্দী।