আকাশ ছুঁতে চাই ৩
2023-02-02 20:07:38

 

অনুষ্ঠানে যা আছে

১. এক সুস্বাদু শিল্পের নির্মাতা

৩.  ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে নতুন রূপ দিচ্ছেন উ সুই

নারী ও শিশু বিষয়ক অনুষ্ঠান আকাশ ছুঁতে চাই থেকে সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা কথা বলি নারীর অগ্রযাত্রা, বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ, সাফল্য, সংকট সম্ভাবনা নিয়ে। আমরা কথা বলি সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মানুষের অধিকার নিয়ে।

এক সুস্বাদু শিল্পের  নির্মাতা

বিশ্বের প্রায় সব সমাজেই অনেক নারী রান্নাবান্নায় বেশ দক্ষতা প্রদর্শন করেন। অনেক পরিবারেই মায়েরা চমৎকার রান্না করেন। আবার অনেক নারী ফুল তৈরি করতে পছন্দ করেন। এই দুই শখকে মিলিয়ে নতুন একটি বিষয় সৃষ্টি করেছেন একজন নারী। তিনি তৈরি করছেন সুস্বাদু ফুলের কেক।

চীনের শানতুং প্রদেশের নারী সু হাইসিয়া । তিনি একজন প্যানকেক শিল্পী। কিন্তু তার তৈরি প্যানকেক কোন সাধারণ খাবার নয়। তিনি এমন সুন্দর ও বিচিত্র আকৃতিতে প্যানকেক তৈরি করেন যা দেখতে যেমন সুন্দর, খেতে তেমনি সুস্বাদু।

 

                                           

প্যানকেক দিয়ে তিনি তৈরি করেন ফুল। রংবেরংয়ের বিভিন্ন আকৃতির ফুল তৈরি করেন তিনি যা অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন। বিশ্বখ্যাত ডাচশিল্পী ভিনসেন্ট ভ্যানগঘের সুবিখ্যাত চিত্রকর্ম সানফ্লাওয়ার এর আদলে তিনি প্যাককেক দিয়ে তৈরি করেছেন ঠিক সেই রকম সূর্যমুখী ফুল যা অনেক মানুষের মন জয় করেছে।

সু গেল ১৫ বছর ধরে প্যানকেক বানাচ্ছেন। শানতুংয়ের লিনই শহরের মংইন কাউন্টির বাসিন্দা সু হাইসিয়ার বয়স এখন ৫৩ বছর। প্রথমে নিতান্ত শখের বসে এই  খাদ্য তৈরি করেন তিনি। পরে এটাকে পেশা হিসেবে বেছে নেন।

তিনি বলেন ‘আমাদের গ্রামে লোকে তিনবেলাই প্যানকেক খায়। কারণ এটি তাদের প্রধান খাদ্য। এজন্যই আমি প্যানকেক তৈরি ও বিক্রি করা শুরু করি।’

তার ব্যবসা বেশ ভালোভাবে এগিয়ে চলে। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার সময় ক্রেতারা সু’র তৈরি প্যানকেক উপহার হিসেবে নেয়া শুরু করেন। কারণ এগুলো দেখতে সুন্দর আবার খেতেও ভালো। উপহার হিসেবে এর কদর বাড়তে থাকে।

এই এলাকায় প্রচুর পিচফল জন্মায়। প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতেই পিচফলের গাছ আছে। সু তাই প্রথমে পিচ ফ্লেভারড প্যানকেক দিয়ে তার যাত্রা শুরু করেন।

তিনি এখন ৫০ এরও বেশি ধরনের প্যানকেক বানাচ্ছেন। রং করার জন্য তিনি প্রাকৃতিক বিভিন্ন ফল যেমন ড্রাগন ফ্রুট, কুমড়ো, তিল, লাল জুজুবি ইত্যাদি বেছে নিয়েছেন।

চার বছর আগে তার চিন্তা আসে প্যানকেকের ফুল বানানোর। সুর স্বামী চাও চিয়ান মনে করেছিলেন এটা সম্ভব হবে না। কারণ পিচ হলো মচমচে একটা ফল। এটা দিয়ে ফুলের আকৃতি দেয়া সম্ভব নয়। কিন্তু নিজের সৃজনশীলতায় এটাকে সম্ভব করেন সু।

তিনি চারদিন ধরে চেষ্টা করেন। নানাভাবে কেকটাকে বাঁকা করে ফুলের পাঁপড়ির আকার দেয়ার জন্য পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে থাকেন। শেষ পর্যন্ত কিছুটা ফুলের মতো দেখতে হয় সেটা। এটুকু সাফল্য পেয়ে উৎসাহিত হয়ে ওঠেন তিনি। আসল ফুল দেখে দেখে নিখুঁতভাবে বানানোর চেষ্টা করতে থাকেন সু।

তিনি বলেন,  ‘ঠিক কখন এটা বাঁকানো যাবে তার একটা সঠিক সময় আছে। বেশি নরম বা ভেজা অবস্থাতেও নয় আবার বেশি শুকনো অবস্থাতেও নয়, ঠিক সময়ে এটাকে বাঁকিয়ে ফুলের মতো আকার দিতে হয়।

ক্রমাগত তিনমাস ধরে চেষ্টার পর সু তার কাজে দক্ষ হয়ে ওঠেন। লাল, হলুদ, কমলা, গোলাপি বিভিন্ন রঙের ফুল বানানো শুরু করেন তিনি। ক্রেতারা খুব উৎসাহের সঙ্গে তার তৈরি প্যানকেক কেনে। তার তৈরি এক ঝুড়ি প্যানকেকের দাম ৮৮ ইউয়ান। যা সাধারণ প্যানকেকের দশগুণ।

মা দিবস, নারী দিবসের মতো বিশেষ দিনগুলোতে তার তৈরি প্যানকেকের চাহিদা অনেক বেড়ে যায় কারণ সকলেই চায় প্রিয়জনকে নতুন কিছু উপহার দিতে।

চলতি বছর বসন্ত উৎসবেও তার অনেক ফুল বিক্রি হয়েছে। উৎসবের আগে সুর সঙ্গে যোগ দেন আরও কয়েকজন গ্রামবাসী নারী। সুর প্রতিষ্ঠানে কাজ করে এই নারীরা তাদের বাড়তি উপার্জনের পথ পেয়েছেন।এরা নিজের গেৃহকর্ম এবং শিশু ও বয়স্কদের যত্ন নিয়ে অবসর সময়টায় সুর প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে চলে আসেন। এতে গ্রামীণ নারীদের কর্মসংস্থান হচ্ছে ভালোভাবেই।

সু হাইসিয়া এভাবে ব্যতিক্রমী শিল্পের মাধ্যমে নিজের ও অন্যের জীবনে এনেছেন স্বাচ্ছন্দ্যর হাওয়া।

ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে নতুন রূপ দিচ্ছেন উ সুই

ওসি: চীনের এই ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প হলো খড়বুনন। এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে নিজের সৃজনশীলতায় উদ্ভাসিত করে গড়ে তুলেছেন এক প্রতিভাবান নারী। এই কারুশিল্পী একজন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার হিসেবে কাজ করছেন।

গমের খড়, শব্দটি শুনলে প্রথমেই মনে হয় এটি ফসলের বাড়তি অংশ যা শুধু পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু খড় দিয়েও যে সুন্দর শিল্প সৃষ্টি করা যায় একথা প্রমাণ করেছেন চীনের নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের নারী উ সুই। শুধু খড় নয়, গমের ডাঁটি, ফসল ঝাড়ার পর তুষ এবং অন্যান্য ফেলে দেয়া বস্তু দিয়েও তৈরি হতে পারে অনন্য সব শিল্প।

খড় দিয়ে নানা রকম সামগ্রী তৈরির কারুশিল্প চীনের অনেক স্থানেই আছে। খড়ে বোনা ঝুড়ি, হ্যাট, মাদুরসহ বিভিন্ন সামগ্রীর ব্যবহার আবহমান কাল থেকেই প্রচলিত। চীনের চেচিয়াং প্রদেশে হ্যমুদু স্থানে নিউলিথিক যুগের ধ্বংসাবশেষ থেকে খড়ে বোনা সামগ্রী পাওয়া গেছে। চোও রাজবংশের সময় খ্রিস্টপূর্ব ১১শ শতকেও তার মানে তিন হাজার বছর আগে খড়ের কারুশিল্প প্রচলিত ছিল বলে প্রাচীন বইপত্রে জানা যায়।

 এই কারুশিল্প চীনের অবস্তুগত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাতেও রয়েছে। এই ঐতিহ্যের একজন উত্তরাধিকার হলেন উ সুই। তিনি তার পরিবারের ষষ্ঠ প্রজন্ম যিনি এই উত্তরাধিকার বহন করছেন।

তিনি নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের হ্যলান কাউন্টির বাসিন্দা। এই কারুশিল্পে উ সুইয়ের হাতে খড়ি হয় ছয় বছর বয়সে তার চাচার কাছে। চাচা ছিলেন একজন কারুশিল্পী এবং পঞ্চম প্রজন্মের উত্তরাধিকারী।

ছোটবেলায় তিনি নিবিড়ভঅবে পর্যবেক্ষণ করেন চাচা কিভাবে খড়,ঘাস, তালপাতা ইত্যাদি দিয়ে নানা রকম সামগ্রী বুনছেন।

উ বলেন, ‘ছোটবেলায় আমার ঘাসফড়িং ধরার শখ ছিল। আমার চাচা শিখিয়ে দেন কিভাবে খড় দিয়ে ঘাস ফড়িংয়ের জন্য খাঁচা বানাতে হয়।সেটাই আমার প্রথম খড় বুননের কাজ শেখা।’

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর উ এই শিল্পে আরও দক্ষতা অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি বেইজিংয়ে একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন । এই প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন রকম কারুশিল্পের প্রচার ও প্রসারে কাজ করে।

সুই এখানে শুধু ঐতিহ্যবাহী শিল্ধারাকে সংরক্ষণের জন্যই কাজ করছেন না, বরং একে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজও সফলভাবে করছেন।

তিনি খড়বুননের মাধ্যমে নতুন নতুন সামগ্রী তৈরি করছেন যা তার সৃজনশীলতারও পরিচয়। খড় দিয়ে দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রীর পাশাপাশি ঘর সাজানোর বা সৌখিন কোন সামগ্রীও তৈরি করছেন তিনি।

সুই মনে করেন, একসময় এ ধরনের কারুশিল্প মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের অংশ ছিল। কিন্তু পরে কারখানার তৈরি সামগ্রী সহজলভ্য ও দামে কম হওয়ায় তা বেশি জনপ্রিয়তা পায়। এখন আবার পরিস্থিতি বদলেছে। মানুষ প্রকৃতির কাছে ফিরে আসছে। এখন কারুশিল্পের চাহিদা বাড়ছে। 

বর্তমানে চীনে অবস্তুগত সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এক লাখের বেশি সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারী আছেন দেশ জুড়ে, বিভিন্ন শহর ও গ্রামে।উ সুইয়ের মতো সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারীরা ধারণ করছেন ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে।

সুপ্রিয় শ্রোতা আকাশ ছুঁতে চাই অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায়ে পৌছে গেছি আমরা।

অনুষ্ঠানটি কেমন লাগছে সে বিষয়ে জানাতে পারেন আমাদের কাছে। আপনাদের যে কোন পরামর্শ, মতামত সাদরে গৃহীত হবে। আমাদের অনুষ্ঠানে আমরা সবসময় কথা বলি নারীর সাফল্য, সংকট, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে।

আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি আমি শান্তা মারিয়া। আবার কথা হবে আগামি সপ্তাহে। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন। চাই চিয়েন।

 

সার্বিক সম্পাদনা : ইয়ু কুয়াং ইউয়ে আনন্দী

লেখা, গ্রন্থনা ও উপস্থাপনা: শান্তা মারিয়া

অডিও সম্পাদনা: রফিক বিপুল