দূরবর্তী পাহাড়াঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক স্যু জি ছংয়ের গল্প
2023-01-30 15:41:39

গত বছরের শেষ দিকে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির যুব লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ‘চীনের বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মউন্নয়ন শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থীদের পুরস্কার বিতরণ’ অনুষ্ঠান অনলাইনে আয়োজিত হয়। এ অনুষ্ঠানে চীনের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮৪২ জন আত্মউন্নত শিক্ষার্থীর মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন ছেলের নাম স্যু জি ছং, যিনি কুয়াংসি চুয়াং জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের গরিব পাহাড়াঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তবে, পরিশ্রম ও অধ্যয়নের মাধ্যমে সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন তিনি। স্নাতক হওয়ার পর তিনি পাহাড়াঞ্চলের বাচ্চাদের শিক্ষা দিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন। আজকের অনুষ্ঠানে আমরা যুব স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক স্যু জি ছংয়ের গল্প তুলে ধরবো।

 

স্যু জি ছংয়ের জন্মস্থান চীনের কুয়াংসি চুয়াং জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সংখ্যালঘু জাতির অধ্যুষিত গ্রামে। তার বাবা-মা কৃষক এবং পরিবারের আর্থিক অবস্থাও দুর্বল ছিল। ছোটবেলা থেকেই সে বাবা-মায়ের কষ্ট বুঝতে পারতো এবং পরিশ্রমের সাথে মন দিয়ে পড়াশোনা করতো। মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় সে বাড়ি ছেড়ে স্কুলের হলে বসবাস করা শুরু করে এবং রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি ও দাতব্য অর্থের সমর্থনে, তার গ্রামের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষার্থী হওয়ার গৌরব অর্জন করে।

 

সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর সে মাস্টার্স ডিগ্রীতে ভর্তির জন্য আবেদন করেনি, বরং নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ‘সিহাইকু’ পাহাড়াঞ্চলে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে কাজ শুরু করে। স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে স্থানীয় এলাকার ১৯টি জেলা ও উপজেলা সফর করেন তিনি এবং স্থানীয় ৩০০ জনেরও বেশি দরিদ্র বাচ্চার জন্য লক্ষাধিক ইউয়ান বৃত্তি সংগ্রহ করেন।

 

স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকের কাজ বেছে নেওয়ার মূল কারণ ছিল, নিজের প্রচেষ্টায় অন্যদের সাহায্য করা। ছোটবেলা থেকে অপরিচিত লোকদের অর্থ সহায়তায় তিনি পড়াশুনা করেছেন এবং উচ্চশিক্ষার খরচও বহন করতে পেরেছেন। নিজের অভিজ্ঞতা স্মরণ করে স্যু বলেন, যখন তিনি উচ্চ বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন তার ছোটবেলার বন্ধু তাকে ফোন করে জানায় যে, সে ইতোমধ্যে বিয়ে করে বাবা হয়ে গেছে। যারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ না করে কম বয়সে চাকরি নিয়েছে, তাদের জন্য অল্প বয়সে বিয়ে করা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। স্যু মনে করেন, শিক্ষা দারিদ্র্যমুক্তির সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। তাই তিনি আরো মনোযোগ ও পরিশ্রমের সাথে পড়াশোনা করতে থাকেন।

 

নিংসিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সিহাইকুতে স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকের কাজ গ্রহণের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে স্যু বলেন, “আমার কাজের মাধ্যমে দূরবর্তী এলাকার আরো বেশি বাচ্চার পাহাড় থেকে বের হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। তারা আরও দূর ও বিস্তৃত বিশ্ব দেখতে পাবে।”

 

শিক্ষক স্যু ও তাঁর সহকর্মীদের প্রচেষ্টায় নিংসিয়াং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের লংত্য জেলার একটি মাধ্যমিক স্কুল ও একটি প্রাথমিক স্কুলের এক হাজারের বেশি শিক্ষক ও শিক্ষার্থী ‘সমুদ্র পরিচয়’ শীর্ষক একটি লাইভ ক্লাসে অংশ নেন।

 

লংত্য জেলার চতুর্থ নম্বর মাধ্যমিক স্কুলে এক বছরের মতো স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করেন শিক্ষক স্যু। তার প্রচেষ্টায় ইন্টারনেট প্লাস শিক্ষা পদ্ধতিতে ‘সমুদ্র পরিচয় ক্লাউড ক্লাস’ চালু হয়। অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘চিয়াংকেং’ বিজ্ঞান গবেষণা জাহাজের সাথে যোগাযোগ করা হয়। স্থানীয় মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা সমুদ্র সম্পর্কে অনেক জ্ঞান ও তথ্য জানতে পারে এতে। তা ছাড়া, সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে নির্মিত সমুদ্র জাদুঘরের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সমুদ্রসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জ্ঞান অর্জনেরও চেষ্টা করেন তিনি।

 

স্বেচ্ছাসেবক স্যু চি ছং তাঁর দিনলিপিতে লিখেছেন: “প্রত্যেকটি বাচ্চা আমাদের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ। জীবনের কষ্টের কারণে তারা বাচ্চা হলেও বড়দের মতো জীবন কাটায়। আমরা চাই তারা বাচ্চাদের মতো জীবন কাটাবে।”

 

যখন তিনি স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসেবে দূরবর্তী এলাকার স্কুলে পড়ানোর কাজ করতেন, তখন স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক দল নিয়ে স্থানীয় ৩০০ জনেরও বেশি দরিদ্র ছাত্রছাত্রীর জন্য লক্ষাধিক ইউয়ানের দান সংগ্রহ করেন এবং হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর জন্য বই ও স্টেশনারিসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র ক্রয় করে বিতরণ করেন। তাঁর প্রয়াসে দূরবর্তী এলাকার স্কুলেও শ্রেষ্ঠ শিক্ষার্থী বৃত্তি চালু করা হয়।  প্রতি বছর দেড় শ শ্রেষ্ঠ ছাত্রছাত্রীকে সে ব্যবস্থার আওতায় বৃত্তি দেওয়া হয়। সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও দরিদ্র এলাকার ছাত্রছাত্রীদের সাথে যোগাযোগ করে সময়মতো তাদের পড়াশোনায় সহায়তা দেন।

 

শিক্ষক স্যু’র পরিশ্রমী প্রয়াসে তাঁর লক্ষ্য ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হয়েছে। নিংসিয়া হুই জাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী ইনছুয়ান শহরের লংত্য জেলার চার নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের এক ছেলে স্যু’র ক্লাসের শিক্ষার্থী। সে মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক হওয়ার পর চাকরি নিতে চায়। তবে, স্যুর পরামর্শ শুনে সে বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়। এটা ছিল স্যুর জন্য বেশ আনন্দদায়ক ব্যাপার।

 

সহকারী শিক্ষকের কাজ শেষ করে নিংসিয়া অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ স্বেচ্ছাসেবক-শিক্ষকের পুরস্কার লাভ করেন স্যু চি ছং। ২০১৯ সালের শেষ দিকে তিনি সিয়ামেন শহরে ফিরে যান। তবে, কোভিড মহামারীর মধ্যেও, নিংসিয়া লংত্য জেলার চার নম্বর মাধ্যমিক স্কুলের খোঁজ-খবর নিতেন তিনি।

 

লংত্য জেলার কোভিড সনাক্ত রোগীদের খবর দেখে তিনি অনেক উদ্বিগ্ন হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে যৌথ প্রচেষ্টায় তিনি লংত্য জেলার জন্য ৩০০০টিরও বেশি মাস্ক ও ২০ বক্স জীবাণুনাশক সংগ্রহ করেন। সেগুলো দ্রুত নিংসিয়াতে পাঠানোরও ব্যবস্থা করেন। নিংসিয়া লংত্য জেলার দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার জন্য অর্থ সংগ্রহের চেষ্টাও করেন স্যু।

 

সঙ্গে সঙ্গে তিনি সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে স্থানীয় হাসপাতালে গিয়ে বিভিন্ন সহায়তামূলক কাজ করেন তিনি, যেমন চিকিত্সকদের বাচ্চাদের লেখাপড়ায় সহায়তা দেওয়া, কোভিড রোগীদের মানসিক সহায়তা দেওয়া, ইত্যাদি।

 

স্যু চি ছংয়ের জন্মস্থান ভিয়েতনাম সীমান্ত থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। কোভিড মহামারী দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে, সীমান্ত এলাকার প্রতিরোধক কাজ বেশ কঠিন ও চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। তিনি অনলাইন স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জন্মস্থানের কোভিড প্রতিরোধক কাজে সহায়তা দিতে থাকেন। তিনি মনোযোগ দিয়ে জন্মস্থানের মহামারী প্রতিরোধক কাজে নিজের অবদান রাখতে থাকেন।

 

২০২০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লংত্য জেলার ৩ জন কোভিড রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। ৩১ মার্চ  নিংসিয়া স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে টানা ২৮ দিনের মতো নতুন কোভিড রোগী সনাক্ত না হবার রেকর্ড হয়। সেটি ছিল শিক্ষক স্যু’র জন্য একটি সুখবর।

 

সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাওয়ার পর তিনি ক্যাম্পাসের যুব শিক্ষক দলে যোগ দেন। সেখানে নিংসিয়া অঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকদের কাজ তুলে ধরা হয়। গত কয়েক বছরে তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকতার কাজ এবং নিংসিয়া অঞ্চলের দারিদ্র্যমুক্তির গল্প বলেছেন। তাঁর উত্সাহে আরো শতাধিক যুব শিক্ষার্থী পশ্চিমাঞ্চলের স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষকের কাজের জন্য আবেদন করে। তারা চীনের গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে নিজেদের অবদান রাখতে আগ্রহী।

 

সিয়ামেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার আগে কর্মসংস্থানের পরিকল্পনা সম্পর্কে স্যু বলেন, সিপিসি’র বিংশতম জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধি লিউ স্যু সিয়াং তাঁর জন্য দৃষ্টান্ত। তিনিও দরিদ্র পাহাড়াঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর জন্মস্থানে ফিরে একজন মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষকে পরিণত হন। তাঁর শিক্ষকতার জীবনে পাহাড়াঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত ছাত্রছাত্রীদের পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি মোট ৮টি মোটর সাইকেল নষ্ট করেন। স্যু চি ছংও কুয়াংসি স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে নিজের জন্মস্থানের স্কুলে ফিরে যেতে চান। নিজের দক্ষতা দিয়ে জন্মস্থানের নির্মাণ ও উন্নয়নে আরো বেশি অবদান রাখবেন বলে আশা করেন স্যু।(সুবর্ণা/আলিম/মুক্তা)