দেহঘড়ি পর্ব-০০৩
2023-01-29 19:26:44


‘দেহঘড়ি’র এ পর্বে থাকছে ট্যাডিশনাল চাইনিজ মেডিসিন বা টিসিএম নিয়ে আলোচনা ‘ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসাধারা’, চীনের হাসপাতাল-পরিচিতি ‘চিকিৎসার খোঁজ’ এবং চীনা জীবনধারা নিয়ে পরামর্শ ‘হেলথ টিপস’।

 

#ঐতিহ্যবাহী_ চিকিৎসাধারা

মাইগ্রেনের চিকিত্সায় টিসিএম

মাইগ্রেন এমন এক ব্যাধি যার কারণে তীব্র মাথাব্যথা হয়। এই ব্যথা কয়েক ঘন্টা থেকে তিন দিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং স্বাভাবিক ক্রিয়াকলাপকে গুরুতরভাবে ব্যহত করে। বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ মাইগ্রেনে আক্রান্ত। পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মাইগ্রেনের মাথাব্যথার সম্ভাবনা তিনগুণ বেশি। মাইগ্রেনের উপসর্গের মধ্যে থাকে মাথার মধ্যে থরথর করা, স্পন্দন বা ছুরিকাঘাতের মতো ব্যথা, বমি বমি ভাব এবং অধিক সংবেদনশীলতা। মাইগ্রেন কয়েক ঘন্টা বা দিনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বিকাশ লাভ করে এবং ব্যক্তিভেদে এর উপসর্গ বা অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়।

মাইগ্রেন কেন হয়?

বর্তমান চিকিৎসাতত্ত্বে মাইগ্রেনের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয় মস্তিষ্কের কোষে অস্বাভাবিক স্নায়বিক ক্রিয়াকলাপকে। এটি বংশগত কারণেও হতে পারে। কারণ মাইগ্রেনের সংবেদনশীলতা পরিবার, বিশেষ করে মা থেকে কন্যাদের মধ্যে ছড়ায়। সম্ভবত হরমোনের ওঠানামার কারণে সৃষ্ট রাসায়নিক প্রতিক্রিয়া রক্তনালীগুলোকে সংকুচিত করে, যার ফলে মাথায় চাপ ও কম্পন-যন্ত্রণা বাড়ে এবং স্নায়ুর সংবেদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। কারপাল টানেল সিন্ড্রোম বা কব্জির স্নায়ুর ওপর চাপের সঙ্গেও সম্পর্ক রয়েছে মাইগ্রেনের। টিএমজে বা চোয়ালের ব্যাধি এবং মেনিয়ার’স রোগও মাইগ্রেন সৃষ্টি করতে পারে। মেনিয়ার’স রোগ হলো কানের একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা যা মাথা ঘোরা, কানের মধ্যে শব্দ এবং বমি বমি ভাব সৃষ্টি করে। এছাড়া, অক্সিপিটাল স্নায়ু সংকুচিত হওয়ার কারণে সৃষ্ট অক্সিপিটাল নিউরালজিয়াও মাথা ও ঘাড়ের পিছনে মাইগ্রেনের মতো ব্যথা সৃষ্টি করতে পারে।

মাইগ্রেনের চিকিৎসায় আকুপাংচার ও টিসিএম

টিসিএম তত্ত্বের ভিত্তি হলো ‘ছি’ বা প্রধান জীবনীশক্তি যা মেরিডিয়ান নামক চ্যানেল দিয়ে শরীরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। দুই ধরনের ‘ছি’র মধ্যে ইয়াং হলো তাপশক্তি আর ইয়িন হলো শীতল শক্তি। ‘ছি’র সঙ্গে রক্তও এই চ্যানেলগুলোর মধ্য দিয়ে চলাচল করে এবং চ্যানেলের অনেকগুলো মাথায় গিয়ে মিলিত হয়। একটি অঙ্গ-ব্যবস্থায় কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা ও স্থবিরতা অন্যান্য অঙ্গ-ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী মাইগ্রেনের জন্য লিভার, প্লীহা ও কিডনি ব্যবস্থার স্থবিরতা ও ঘাটতিকে দায়ী বলে মনে করা হয়। এ স্থবিরতার কারণে লিভার থেকে ‘ইয়াং’ শক্তি মাথার দিকে প্রবাহিত হয়। বেশি  পরিমাণে ভুল ধরনের খাবারের গ্রহণ এই অঙ্গগুলোতে শ্লেষ্মা তৈরি করতে পারে। অন্যদিকে অ্যালকোহল ও তীব্র গন্ধ ও স্বাদযুক্ত খাবার অতিরিক্ত তাপশক্তি সৃষ্টি করতে পারে। টিসিএম চিকিত্সায় লিভারের তাপশক্তি কমানো এবং শ্লেষ্মা দূর করতে নির্দিষ্ট আকুপাংচার পয়েন্টে সূচ প্রবেশ এবং ভেষজ ব্যবহার করা হয়।

স্বাভাবিক ব্যথানাশের পাশাপাশি আকুপাংচার মাইগ্রেনের ব্যথা সারাতেও কাজ করে। এছাড়া অঙ্গ-ব্যবস্থার ভারসাম্যহীনতা দূর করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে এ রোগ থেকে রক্ষা করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাইগ্রেনের রোগীরা আকুপাংচার চিকিত্সা নিলে এ রোগের আক্রমণের পৌনঃপুনিকতা ও আক্রান্ত থাকার সময় দুটোই কমে। সেজন্য আকুপাংচারকে মাইগ্রেনের একটি মূল্যবান চিকিত্সা বিকল্প বলে মনে করা হয়।

প্রাকৃতিক প্রতিকার

কতগুলো প্রাকৃতিক উপায়ে মাইগ্রেন থেকে মুক্তি পাওয়া যায় এবং এ রোগ প্রতিরোধও করা যায়। খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে মাইগ্রেনের ব্যথা তো বটেই অন্যান্য কিছু গুরুতর মাথাব্যথার উপশম ও প্রতিরোধও সম্ভব। চলুন এমন উপায়গুলো সম্পর্কে জেনে নেই:

মাইগ্রেনের জন্য দায়ী খাবার এড়িয়ে চলুন। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে নাইট্রেট বা এমএসজি যোগ করা হয় এমন খাবারসহ প্রক্রিয়াজাত খাবার। আপনি যদি মাইগ্রেনের ঝুঁকিতে থাকেন, তাহলে দুগ্ধজাত খাবার, বিশেষ করে খুব নোনতা বা পুরনো পনির, চকলেট অত্যন্ত ঠান্ডা পানীয় ও ডেজার্ট এড়িয়ে চলুন। শুকনো ফল ও মটরশুটি এবং আচারও সমস্যা হতে পারে আপনার জন্য।

উচ্চ ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার, বিশেষ করে বাদাম, বীজ ও উচ্চ মানের ডিমের উপর জোর দিন। আর নিয়মিত কাঁচা আদার চা খান। বমি বমি ভাব এবং বমি দূর করার উপাদান রয়েছে আদায়। এছাড়া মাইগ্রেনের অন্যান্য প্রভাবও উপশম করতে পারে আদা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাইগ্রেনের উপসর্গ কমাতে আদা সুমাট্রিপ্টান ওষুধের মতোই কার্যকর।

ল্যাভেন্ডার বা পেপারমিন্টের মতো এসেনসিয়াল অয়েল ব্যবহার করে দেখুন। এটা মাথার তালুতে মালিশ করলে মাইগ্রেনের ব্যথা উপশম হতে পারে।

শ্বাস, শারীরিক নড়াচড়া ও ধ্যানের সমন্বয় আছে এমন একটি মৃদু প্রকৃতির ব্যায়াম শুরু করুন। এটা প্রমাণিত যে, যোগব্যায়াম মাথাব্যথা উপশমে সহায়ক। এ ধরনের ব্যায়াম শরীরকে সম্পূর্ণরূপে শিথিল করতে সহায়তা করে। এটি শরীর এবং মস্তিষ্কের ডান ও বাম দিকের মধ্যে আরও ভাল ভারসাম্য আনে।

 

#চিকিৎসার_খোঁজ

ওয়েস্ট চায়না হাসপাতাল

ওয়েস্ট চায়না হাসপাতাল সিচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েস্ট চায়না মেডিকেল কেন্দ্রের অন্তর্গত একটি হাসপাতাল। এটি কেবল চীনের বৃহত্তম হাসপাতাল নয়; একক ক্যাম্পাস বিবেচনায় এটি গোটা বিশ্বের মধ্যেও বৃহত্তম হাসপাতাল। বেশ কয়েক বছর ধরে চীনের শীর্ষ তিনটি হাসপাতালের একটি হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে ওয়েস্ট চায়না হাসপাতাল।

ওয়েস্ট চায়না হাসপাতালে ৩৬টি ক্লিনিকাল বিভাগ, ১৫টি চিকিৎসা-প্রযুক্তি বিভাগ এবং ২৫টি উন্মুক্ত পরীক্ষাগার রয়েছে। প্রতিবছর ৩৫ লাখ থেকে ৫০ লাখ রোগী এই হাসপাতাল থেকে সেবা নেয়। ২০১১ সালের হিসাবে দেখা যায়, ৩৫ লাখেরও বেশি রোগী হাসপাতালটির বহির্বিভাগ থেকে সেবা গ্রহণ করে এবং ১ লাখ ৭৩ হাজার রোগী ভর্তি হয়। ওই বছর ৯৩ হাজার ৯শ’র বেশি অস্ত্রপচার সম্পন্ন হয় এখানে।

ওয়েস্ট চায়না হাসপাতাল ৪ হাজার ৩শ শয্যা-বিশিষ্ট। এখানে কর্মরত স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা হাসপাতালে ৬ হাজার ১শ’ যাদের মধ্যে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপকই সাড়ে ৫শ জন। এখানে রয়েছে ১টি রাষ্ট্রীয় পরীক্ষাগার, শিক্ষা মন্ত্রালয়ের ২টি মূল পরীক্ষাগার, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৯টি মূল বিভাগ, ‘২১১ প্রকল্প’সহ ২টি জাতীয় বিভাগ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ৫টি মূল কর্মসূচি, ১৬টি মূল বিভাগ এবং প্রাদেশিক স্তরের ২৫টি মূল পরীক্ষাগার।

ওয়েস্ট চায়না হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কেন্দ্র ৩১ বিভাগে চিকিৎসাশিক্ষা প্রদান করে। বিভাগগুলোর আওতায় ক্লিনিকাল মেডিসিনে ডক্টরেট এবং ক্লিনিকাল ও বেসিক মেডিসিনে পোস্ট-ডক্টরাল পর্যায়ের শিক্ষা দেওয়া হয়।

 

হেলথ টিপস

এটা সর্বজনবিদিত যে, চীনা জীবনযাপন পদ্ধতি অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। আপনি যদি চীনাদের মতো একটি সুস্থ জীবন যাপন করতে চান তাহলে মেনে চলতে পারেন তাদের জীবনযাপন পদ্ধতি-সম্পর্কিত পরামর্শ।

নিয়মিত শারীরিক অনুশীলন করুন

চীনা জীবনযাপন পদ্ধতিতে বিশ্বাস করা হয়, শারীরিক ভারসাম্যহীনতা ও ব্যথা ডেকে আনে স্থবিরতা। তাই শরীরকে সুস্থ ও ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে প্রয়োজন নড়াচড়া করা; সেই নড়াচড়া হতে হবে হালকা, তবে নিয়মিত। এমন হালকা ও টেকসই প্রকৃতির নড়াচড়ার অন্যতম উপায় হলো থাই চি, যোগ, ছিকুং, হাঁটা ও হালকা জগিংয়ের মতো অনুশীলন।

বর্তমানে ব্যস্ত আধুনিক জীবনযাত্রার কারণে, আমরা প্রায়শই তীব্র নড়াচড়ার অনুশীলনগুলো বেছে নিই। এগুলো স্বল্পমেয়াদী লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করতে পারে বটে, তবে দীর্ঘ মেয়াদে এটা শরীরের জন্য অতটা ভালো নয়।

ঋতু-উপযোগী খাবার খান

ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ জীবনযাপন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ এই পৃথিবীর জন্যও। আমাদের দেহ যে সব উৎস থেকে অত্যাবশ্যকীয় শক্তি ও পুষ্টি গ্রহণ তার মধ্যে অন্যতম হলো এই পৃথিবী, বিশেষ করে এখানে উৎপন্ন যেসব খাবার আমরা খাই সেগুলো। এ কারণে সুস্বাস্থ্যের জন্য সুষম খাদ্য গ্রহণ করা অপরিহার্য।

আমাদের শরীরে অত্যাবশ্যকীয় শক্তি যাতে বাড়ে, সেজন্য চীনা জীবনযাপন পদ্ধতিতে ঋতুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ খাবার খাওয়ার প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। অর্থাৎ যেখানে, যে মৌসুমে, যে খাবার পাওয়া যায় সেটা খাওয়া উচিৎ। তাই আপনি বিশ্বের কোথায় আছেন এবং কোন ঋতুতে আছেন, তার উপর নির্ভর করে খাবার তালিকাগুলো পরিবর্তন করে নিতে হবে।

 

 ‘দেহঘড়ি’ অনুষ্ঠান সম্পর্কে আপনাদের মতামত ও পরামর্শ জানতে চাই আমরা। আমাদের ফেইসবুক পেইজ facebook.com/CMGbangla অথবা ওয়েবসাইট bengali.cri.cn’র মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনাদের মতামত বা পরামর্শ।